পুরান ঢাকার রোজা আর রোজার ঈদের কথা আপনেগো কাছে কই। মোগলরা ঢাকায় পাও ফালানের লগে লগেই রোজা আর রোজার ঈদ তেহারের সুরত পাওন শুরু করছে। মানুর হাতে পয়সা আইছে। আমির-ওমরাহগো চালচলন-খানাপিনা দেখছে, হিকছে। মোগলগো খানাপিনা সবতের আগে কবজা করছে ঢাকাইয়াগো বাওর্চিখানা।
মাহে রমজান আহনের আগে সুবরাইতের বাদে রোজার ইন্তেজাম শুরু হয়া যাইত। মরদানারা রোজার বাজার আগেই সাইরা রাখত। রমজানের চান উঠনের লগে লগেই মজিদ থেকা সাইরেন বাজায়া জানাইত, আইজকা বাদ এশা তারাবি পইড়া রমজান শুরু। মা-বইনেরা বিহান রাইতের সরগাই খাওনের খানা রান্দন শুরু করত। আর ডাকত সরগাইআলারা, ‘ওটঠো, রোজদারো। সারগাই খা লো, রাত দো বাজ গায়া।’ (‘ওঠো, রোজাদাররা। সাহ্রি খাও, রাত দুইটা বাজে।’) পুরান ঢাকার মানু বিহান রাইতের খাওন ঠান্ডা খায় না। মা-বইনেরা সব খানা দুপফরেই রাইন্দা রাখত। বিহান রাইতে খালি গরম করত। আর রাইত একটায় লাকড়ির চুলা জ্বালায়া ভাত রানত। গরিব বা পয়সাআলা যা-ই হোক, সরগাইয়ের ওক্তে মাছ-সবজি খাইত না। খাইত গোস্তের সাদা কোর্মা, কালিয়া, কোপ্তা আর চাপ। গরম ভাতে দুই ফোঁটা কাঁচা ঘি। বুড়া মানুরা দুধে ভিজায়া খাইত সিরমাল আর নিমসুকা রুটি-পেস্তাবাদাম, কিচমিচ আর জাফরান দিয়া। সেরবেরেন, দুধ-ভাত-ক্যালা, আমের, কদুর বা আনারসের মোরোব্বা।
জোহরের পর শুরু হইত রোজা খুলাইয়ের ইন্তেজাম। ঘরে মেয়েলোকেরা শরবত, ঘুমনি, ফলুরি, আলুর চপ, ওসনা বুট, কাঁচা বুট আদ্রক কুচি দিয়া রোজা খুলাইয়ের ইন্তেজাম করত। নানান রকম ফলফলারি, খিরাই, খাজুর, ফালুদা থাকত; আর শুক্কুরবারে বিরানি হইত। পুদিনা পাতা দিয়া মুড়ির ভর্তা না হইলে ঢাকাইয়াগো চলে না। ঘরে যত কিছুই বানাউক, চকবাজারের রোজা খুলাই ঘরে আইবই। কওয়াবের বয়ান আর কী কমু—শিক কওয়াব, বটি কওয়াব, জালি কওয়াব, আস্ত মুরগির কওয়াব, খিরি কওয়াব, গুরদা কওয়াব, সুতি কওয়াব, খাসির রানের কওয়াব, হান্ডি কওয়াব, পাসান্দে কওয়াব—পসন্দমতো ইফতারের দস্তরখানে থাকতই। আর আছিল শরবতের বাহার। লেম্বুর শরবত তো হইতই, আরও হইত তোকমা, বেল, ইসুবগুল, পোস্তদানা, মাঠা আর মিহিদানার শরবত। সবতের থেকা সেরার সেরা আছিল বাদামের শরবত। ঘন দুধ, মধু, বাটা বাদাম, পেস্তা, কাজু আর জাফরান দিয়া শরবত বানায়া কিচমিচ আর বাদাম, পেস্তার কুচি দিয়া সাজায়া দস্তরখানে হাজির করা হইত। বড় বাপের পোলা, দইবড়া, হালিম, এক-দুই কেজি ওজনের জিলাপি, নিমকপাড়া, সামুসা-আরও কত কিসিমের খাওন, কয়া শ্যাষ করা যাইব না। আর খাইত চিড়া-ওখড়া, যা খালি রমজান মাসেই পাওয়া যাইত।
বিটিশ আমলে সব বাড়িতেই কুয়া আছিল। পয়সাআলারা কলমিসোরায় পানি ঠান্ডা করত। আর সবতে ঠান্ডা করত মাটির ঠিলায় পানি ভইরা রসসি বাইন্দা কুয়ায় ডুবায়া রাইখা। বাঙ্গি-তরমুজবি কুয়ায় ডুবায়া রাখত ঠান্ডা রাখনের লেগা।
ঢাকার নওয়াব সাবগো আমল থেকা রোজদারগো ঘুম ভাঙাইবার লেগা মরদরা কাশিদা গাইতে বাইর হইত, আর বাড়ি বাড়িত থেকা বকশিশ উঠাইত। কাশিদা গাইত রোজার তিরিশ দিনরে দশ দিন কইরা ভাগ কইরা। পয়লা দশ দিন চানরাতি আমাদ, মইধ্যের দশ দিন খোশ আমদিদ, বিশ রোজার বাদে দশ দিন আলবিদা। আর আছিল ঈদ কাশিদা। ঈদের মিছিলে এই কাশিদা খুশির ফোয়ারা ছুটায়া দিত। অহন কিছু মহল্লা কাশিদার হরিপির চল রাইখা কাশিদারে বাঁচায়া রাখছে। মাগার আমরা যে ছোট ওক্তে বিছানায় হুইয়া দূর থেকা কাশিদার যে সুর হুনতাম, ওইটা আর কানে আহে না।
তামাম রোজা ধইরাই ঈদের ইন্তেজাম শুরু হয়া যাইত। আমার মায় কইছে বিটিশ আমলে তামাম রোজা ধইরা সারা রাইত কাঠের লাম্বা তক্তায় সেওই বানাইত। ওই সেওই খোঞ্চায় গোল কইরা প্যাঁচায়া রাখত। বাদের দিন রইদে হুকায়া, হুকনা খোলায় ভুইনা টিনের কাতিতে ভইরা রাখত। অহনকার মতন বাজারের সেওই বিক্রি হইত না।
পুরান ঢাকার মানু ঈদের কাপড় ঘরে সেলাই করত না। খলিফার দোকানে সেলাই করত। আমরা নয়া কাপড় কেউরে দেখাইতাম না, কেউ দেখলে মনে করতাম পুরান হয়া যাইব। সাতাইশার বাদে রোজার দিন আর খতম হইবার চায় না। আমরা পোলাপানরা বেতাব হয়া যাইতাম কবে ঈদের চান উঠব। যতই নয়া কাপড় পিন্দি না কেলা, মেন্দি না হইলে ঈদ হইব না।
চানরাইত, আহা আমাগো চানরাইত। উনত্রিশ রোজায় কুনুমতে রোজা খুইলা লৌড় পাড়তাম ময়দান বা ছাদে চান দেখনের লেগা। চান উঠলে তো খুশির কুনু সীমা থাকত না, মাগার চান না উঠলে মুখটা ব্যাজার কইরা আরেকটা দিন ইন্তেজার করতাম। ঈদের চান দেইখা সবতে হাত উঠায়া মোনাজাত করত। ঘরে ঘরে গ্রামোফোন, চেঞ্জার আর রেডিওতে গান বাইজা উঠত। ঈদের খানা রানতে রানতে মায়েগো তামাম রাইত বিতা যাইত। খুব বিহানে গতরে হলদি বাটা আর চুলে সোন্দা বাটা দিয়া আমরা নাহাইতাম। তার বাদে নয়া কাপড় পিনতাম। মরদানারা নাহায়া-ধুয়া নয়া পাজামা–পাঞ্জাবি বা লুঙ্গি পিন্দা আগের রাইতের দুধে ভিজাইনা খোরমা আর দুধ দিয়া ওসনা সেওই খায়া ঈদের জামাতে শামিল হইত। নামাজ শ্যাষে কবরস্থানে যায়া মুরুব্বিগো কবর জিয়ারত কইরা ঘরে ফিরত। এর বাদে বড়গো সালাম কইরা খিচুড়ি দিয়া খানাপিনা শুরু হইত।
আমরা পোলাপানরা নয়া কাপড়চোপড় পিন্দা বড়গো সালাম কইরা কেমনে মেন্দিআলা হাত বাড়ায়া লিয়া সালামির টেকা বটুয়ায় ভরুম ওই তালে থাকতাম। সালামির টেকার খাতিরে নিজেগো আমির মনে হইত। মহল্লার দোকানদারেরা পোলাপানগো মন ভুলাইনা জিনিস লিয়া বইত। বটুয়ার সব টেকা শ্যাষ কইরাই বাড়িতে ঢুকতাম।
ঈদের দিন খানাপিনার হিসাব নাই। বাড়ি বাড়ি খাওন চিখতে চিখতে রাইতে আর কুনু কিছু খাওনের আওকাত থাকত না। ঈদের দিন পোলাও, কোর্মা, কালিয়া, কোপ্তা, রোস্ট, কওয়াব, পায়েস, সেওই, জর্দা, ফালুদা, দই—এই সব নানান কিসিমের খাওন সব বাড়ির দস্তরখানেই থাকত। ঈদের তিন দিনতক বাসি ঈদের তেহার চলত। ঈদের বাদে আমরা কইতাম, ঈদ কেল্লেগা এত জলদি শ্যাষ হয়া যায়।
পাঠকের সুবিধার জন্য কিছু শব্দের অর্থ দেওয়া হলো। বিতা: বিগত, তেহার: উৎসব, সুবরাইত: শবে বরাত, সরগাই: সাহ্রি, কলমিসোরা: পানি ঠান্ডা করার পাত্র, হরিপি: প্রতিযোগিতা, খলিফা: দরজি, বেতাব: অস্থির।
আখতার জাহান লেখক