রসগোল্লা নিয়ে গোল

গোল বেধেছে বাঙালির প্রিয় রসনা রসগোল্লা নিয়ে। কে আবিষ্কার করেছেন রসগোল্লা, তাই নিয়ে চলছে পশ্চিমবঙ্গ আর ওডিশার মধ্যে দড়ি টানাটানি। তবে রসগোল্লা যে বাঙালিদের সৃষ্টি, সে কথা সর্বজনবিদিত। রসগোল্লা যে কলকাতায় প্রথম তৈরি হয়েছিল, তাও ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। তবু মাত্র বছর দশেক আগে হঠাৎ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘অরকুট’-এ দাবি ওঠে রসগোল্লা ওডিশার। পরে এই দাবি নিয়ে ওডিশার কিছু মিষ্টি বিক্রেতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখাও শুরু করেন।
পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসবিদেরাও এই তথ্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে রসগোল্লার আঁতুড়ঘর কলকাতায়। এর আবিষ্কারক কলকাতার সাবেক চিনি ব্যবসায়ী নবীন চন্দ্র দাস। তিনি ১৪৭ বছর আগে রসে ভেজানো গোলাকার এই রসগোল্লা আবিষ্কার করেছিলেন। অথচ গত ২৭ আগস্ট ওডিশার রাজ্য বিধানসভায় দাবি ওঠে রসগোল্লা ওডিশার। আর এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশার মধ্যে রসগোল্লা নিয়ে গোল বেধে যায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও জানিয়ে দেয় রসগোল্লা বাংলার, বাঙালিদের রসনাতৃপ্তির সেরা মিষ্টি, বাংলার ঐতিহ্য এই রসগোল্লা। ইতিহাসবিদ হরিপদ ভৌমিক জানিয়ে দেন, রসগোল্লার আবিষ্কার নিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। রসগোল্লা বাংলার, বাঙালির সম্পদ, বাংলার ঐতিহ্য। নবীন চন্দ্র দাসের পঞ্চম প্রজন্ম, উত্তরসূরি ধীমান দাসের সঙ্গে কথা হয় নতুন এই বিতর্ক নিয়ে। তিনি বলেছেন, রসগোল্লার আবিষ্কার নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকতে পারে না। রসগোল্লার আবিষ্কার নিয়ে তিনি অতীতের কিছু তথ্যও তুলে ধরেন। ১৮৬৪ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকোতে একটি মিষ্টির দোকান খোলেন তৎকালীন কলকাতার চিনি ব্যবসায়ী নবীন চন্দ্র দাস। কিন্তু বেশি দিন ওই মিষ্টির দোকানটি টিকিয়ে রাখতে পারেননি তিনি। ফের তিনি ১৮৬৬ সালে কলকাতার বাগবাজারে আরেকটি মিষ্টির দোকান খোলেন। তখন অবশ্য ওই দোকানের প্রধান মিষ্টি ছিল সন্দেশ। ওই সময় কলকাতা শহরের খানদানি বণিকেরা সন্দেশের একটি বিকল্প মিষ্টি খুঁজছিলেন। তখনই নবীন চন্দ্র দাস নতুন মিষ্টি আবিষ্কারের জন্য মনোনিবেশ করেন। দুই বছর পরে ১৮৬৮ সালে তিনি আবিষ্কার করেন রসগোল্লা।
ধীমান দাস একটি ঘটনার কথা বর্ণনাও করলেন। একদিন তাঁদের বাগবাজারের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় একটি ঘোড়া টানা জুড়ি গাড়ি। গাড়িতে ছিলেন কলকাতার এক ধনাঢ্য ব্যক্তি, ভগবান দাস বাগলার পরিবার। ভগবান দাসের এক ছেলের পিপাসা পেলে সে গাড়ি থেকে নেমে ওই মিষ্টির দোকানের সামনে আসে। ভগবান দাস ওই ছেলেটিকে এক গ্লাস জল ও একটি রসগোল্লা দেন। রসগোল্লা খেয়ে ওই ছেলে বেজায় খুশি হয়ে বাবাকে বলেন তোমারও খেতে হবে এই মিষ্টি। ভগবান দাস এরপর এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতার ছড়িয়ে পড়ে রসগোল্লার সুখ্যাতি।
ধীমান দাস আরও বললেন, নবীন চন্দ্র দাসের ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র দাসই রসগোল্লাকে প্রথম কৌটাজাত করে বিক্রির উদ্যোগ নেন। আবার কে সি দাসের ছেলে সারদাচরণ দাস এই রসগোল্লাকে আধুনিক পর্যায়ে নিয়ে আসেন। তৈরি করেন স্পঞ্জের মতো রসগোল্লা। ধীমান দাস আরও বলেছেন, এখন যে রকম দুধে সাদা রসগোল্লা পাওয়া যায়, ওই যুগে কিন্তু তেমনটি ছিল না। তখন চিনিও এত সাদা ছিল না। আজকের মতো আধুনিক প্রযুক্তিতে মিল-কারখানায় চিনি উৎপাদন হতো না। সে সময় উৎপাদিত হতো প্রচুর গুড়। আখের রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হতো এই গুড়। ওই গুড় থেকে হতো এই চিনি। গুড়কে ‘পাতা’ নামক একধরনের শেওলা দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। গুড়ে যেসব লালচে পদার্থ থাকত, সেগুলো শেওলার ভেতরকার ব্যাকটেরিয়া খেয়ে নিলে বেরিয়ে আসত চিনির দানা।
কলকাতার ইতিহাসবিদ হরিপদ ভৌমিক বললেন, রসগোল্লা বাংলারই সম্পদ; কলকাতায়। ওডিশায় আজকে যে দাবি উঠেছে তা ঠিক নয়। ওডিশার পুরীর জগন্নাথ দেবকে রসগোল্লা দিয়ে ভোগ দেওয়ার কথা উঠেছে, তা–ও সত্য নয়। তৎকালে পুরীর মন্দিরে ভোগ দেওয়া হতো ক্ষীরমোহন দিয়ে। আর ওই ক্ষীর মোহন ছানা দিয়ে তৈরি হতো না, তৈরি হতো দুধ জ্বালিয়ে তৈরি ক্ষীর থেকে।
এদিকে রসগোল্লার আবিষ্কার নিয়ে ওডিশার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৭ আগস্ট ওডিশার বিধানসভায় ওডিশা রাজ্যের শাসক দল বিজেডির বিধায়ক আর পি সোয়াইন বিধানসভায় দাবি তোলেন ওডিশার রসগোল্লার ঐতিহ্যকে ছিনিয়ে নিতে চায় বাংলা। পুরীর জগন্নাথ দেবকে এই রসগোল্লা নিবেদন করা হয়। ৩০০ বছরের পুরোনো এই প্রথা অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকার দাবি করেছে রসগোল্লা নাকি বাংলার আবিষ্কার। এটা আমরা মেনে নিতে পারছি না।
এই দাবির প্রতি সেদিন আরও সমর্থন জানান বিজেডির আরেক বিধায়ক প্রিয়দর্শী মিশ্র। তিনি বলেন, প্রতিবছর উল্টোরথের আগের দিন গোটা ওডিশায় পালিত হয় ‘রসগোল্লা দিবস’। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, রসগোল্লা বাংলারই। রসগোল্লার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার লড়াই করবে। ধীমান দাস আরও বলেছেন, এখন তাঁরা রসগোল্লাকে আধুনিক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। রসগোল্লার উৎপাদনও হচ্ছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে। আর হাতে নয়, দুধ থেকে ছানা কাটা, ছানা থেকে রসগোল্লা তৈরি এবং সর্বোপরি টিনজাত করে বাজারে বিক্রি করা। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার পাঁচগড়া বাজারের সন্নিকটে কে সি দাসের রসগোল্লা কারখানায় তৈরি হচ্ছে রসগোল্লা।
অমর সাহা, প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।