রাজনীতিতে ধর্মের ফিরে আসা

একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ৫০ বছর পূরণ করতে যাচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এমন একটি মাইলফলক, যখন এই দীর্ঘ যাত্রার একটি মূল্যায়ন প্রয়োজন। একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, তার মূল্যায়ন করেছেন দুই গবেষক। চার পর্বের ধারাবাহিকের তৃতীয় পর্ব ছাপা হলো আজ।

১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের সংবিধানে সেক্যুলারিজমকে একটি রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। বাংলায় একে বলা হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। যেভাবে সেক্যুলারিজমকে তখন দেখা হয়েছিল, তাতে করে জনপরিসরে রাজনীতি ও ধর্মের বিভাজন থাকার কথা ছিল, রাষ্ট্রের এক ধরনের নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার প্রতিশ্রুতি ছিল। এই অবস্থানের কারণ ছিল এই যে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলে ইসলাম ধর্মকে আইডিওলজি বা ভাবাদর্শের জায়গায় স্থাপন করে শাসনের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছিল। কিন্তু ৫০ বছর পরে, আজ বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রে ধর্ম ফিরে এসেছে। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতায় ধর্মের উদ্ধৃতির ছড়াছড়ি, ক্ষমতাসীন দল ইসলামপন্থীদের তোষণে ব্যস্ত, বিরোধী দল ইসলামপন্থীদের সঙ্গে তৈরি করা গাঁটছড়ার জালে আটকা পড়ে আছে এবং ধর্মভিত্তিক দলগুলো রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে। ধর্ম হয়ে উঠেছে ভাবাদর্শ।

ধর্মের রাজনীতিতে ফিরে আসার যাত্রা কার্যত শুরু হয়েছে ’৭২–এর সংবিধান রচনার অল্প কিছুদিন পর থেকেই। সেক্যুলারিজমের তত্ত্বটি সঠিকভাবে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে জনসাধারণ কেউ বুঝে উঠতে পারেননি, অথবা সমাজে এই বোঝাপড়া তৈরির কোনো প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়নি। ধর্ম এবং রাজনীতির সম্পর্ক এবং রাষ্ট্র ও ধর্মের সম্পর্কের বিভিন্ন জটিল ও অনুপুঙ্খ বিষয় নিয়ে সমাজে আলোচনা হয়নি, বিতর্কের সুযোগ তৈরি করা হয়নি। একার্থে সমাজের এক এলিট অংশ যেভাবে বিবেচনা করেছেন তাকেই সবার মত বলে উপস্থাপন করা হয়েছে। তার পরে সামরিক সরকারগুলো তাদের বৈধতার সংকট মোচনে ধর্ম এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দ্বারস্থ হয়েছে; সংবিধান বদল এবং ধর্মভিত্তিক দলের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছে।

১৯৭৮ সালে সংবিধান থেকে সেক্যুলারিজম বাদ দেওয়া হয় এবং ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও ইসলামপন্থী দলগুলো অংশগ্রহণ করে। ১৯৯১–পরবর্তী গণতান্ত্রিক পর্বেও ক্ষমতাসীন ও বিরোধী জোট তাদের ক্ষমতা রক্ষা ও দখলের লড়াইয়ে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে মিত্রতা করে; আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সহিংস শত্রুতা ইসলামপন্থীদের উত্থানে এবং শক্তি সঞ্চয়ে সহযোগিতা করেছে এটা অনস্বীকার্য। গত কয়েক দশকে যেমন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক ডিসকোর্সে ধর্মকে নিয়ে এসেছে এবং ধর্মীয় ক্রীড়নকদের বৈধতা দিয়েছে, তেমনি ইসলামপন্থী সংগঠন ও আন্দোলনগুলো সমাজে ধর্মের প্রভাব বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের জাতীয় আত্মপরিচয়ের সঙ্গে ধর্মের প্রসঙ্গকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলা হয় যেন নৃতাত্ত্বিক বাঙালি পরিচয়ের সঙ্গে ইসলাম ধর্ম অনুসরণের একটি বিরোধ রয়েছে। অথচ দীর্ঘ দিনের ইতিহাস বাঙালির বহুমাত্রিক পরিচয়ের প্রমাণ দেয়।

১৯৯৬–এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সংসদের ভেতরে-বাইরে গাঁটছড়া বাঁধে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এবং বিএনপির বিরুদ্ধে একযোগে আন্দোলন করে। পরে ১৯৯৯ সালে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন করে ২০০১–এর জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় ও জয়লাভ করে। জানুয়ারি ২০০৭-এ জাতীয় নির্বাচনের আগে নিজেদের জয় নিশ্চিত করতে প্রধান দুই দল ইসলামপন্থীদের কাছে টানা শুরু করে। নিজেদের সেক্যুলার হিসেবে দাবি করলেও আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নামের একটি কট্টর ইসলামপন্থী দলের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোটের উপস্থিতি ভোটের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের উদাহরণ। ২০১৮–এর নির্বাচনের আগেও আওয়ামী লীগ ধর্মভিত্তিক দল তোষণ করেছে। বাংলাদেশে মোট ৬৬টি ইসলামপন্থী দলের মধ্যে ৬১টি জোটভুক্ত হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সঙ্গে, আর পাঁচটি বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে।

ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরের দলগুলো ইসলামপন্থীদের, বিশেষ করে রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার কারণে সমাজে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তাদের শক্তির চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে পড়েছে। রাজনীতির আলোচনার সূচি অংশত তারাই নির্ধারণ করছে। আশু এ অবস্থার অবসানের সম্ভাবনা নেই; উপরন্তু তা আরও বিস্তৃত হবে বলেই অনুমান করা যায়

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক বৈধতা ও সামাজিক প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে ২০১৩–এর শাহবাগ আন্দোলনের পর। এর পটভূমি হচ্ছে ২০১০ সালে স্থাপিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিদের বিচার করে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান। কিন্তু উদ্দেশ্য বিষয়ে সমর্থন সত্ত্বেও পদ্ধতিগত ত্রুটি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে এর সমালোচনা হয়েছে। শাহবাগ আন্দোলন শুরু হয় সরকার ও অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের মধ্যে কথিত যোগসাজশে কম সাজা দেওয়া হচ্ছে এই অভিযোগে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার অতি দক্ষতার সঙ্গে আন্দোলনকে নিজেদের স্বার্থে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়। এই আন্দোলনের বিপরীতে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সংগঠন ও ছোট ছোট ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো একত্রিত হয়। শাহবাগ আন্দোলনকারীদের ইসলামবিরোধী নাস্তিক হিসেবে অভিহিত করে; এপ্রিল মাসে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ, মে মাসে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের জমায়েত তাদের শক্তির এবং সমাজে তাদের আবেদনের প্রমাণ দেয়। তাদের উত্থাপিত ১৩ দফা দাবি, যাতে ব্লাসফেমি আইন ও ইসলাম অবমাননার সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানের দাবি ছিল, সেগুলো সমাজে একধরনের বিভক্তির সূচনা করে। শাহবাগ ও শাপলা চত্বরের এই দুই আন্দোলন বাংলাদেশের সমাজে সবকিছুকে দুই ভাগে ভাগ করার ও তীব্র বিভাজন তৈরি করে দেয়। একদিকে কট্টর সেক্যুলারপন্থীরা, অন্যদিকে গোঁড়া ইসলামপন্থীরা বাংলাদেশের সমাজের সহজাত সহনশীলতা ও মধ্যম পন্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

ধর্মীয় ও সেক্যুলার গোঁড়ামির মধ্যে চাপা পড়ে জনমানসের সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা। যদিও প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ সরকার শাপলা চত্বরে জড়ো হওয়া হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেয়। কিন্তু পরে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকার যতই কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে শুরু করে, ততই ইসলামপন্থীদের কাছে টানার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৪ সালেই সরকার পরিষ্কার করে দেয় যে শাহবাগকেন্দ্রিক সেক্যুলারদের চেয়ে মিত্র হিসেবে ইসলামপন্থীরা বেশি দরকারি। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চলবে। হেফাজতে ইসলামকে খুশি রেখে নিজেদের রাজনৈতিক বৈধতা পেতে সরকার ২০১৭ সালে টেক্সটবুকে পরিবর্তন আনে, অমুসলিম লেখকদের রচনা সরিয়ে ফেলে ও সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে লেডি জাস্টিসের মূর্তি অপসারণ করে। ২০১৭ সালেই সরকার দেশব্যাপী ৫৬০টি মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।

২০১৩ সালের পর থেকে ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। স্থানীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেটের মতো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো। শক্তি প্রয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী দলগুলো দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনগুলো এখন দুর্বল বলেই প্রতীয়মান হয়। কিন্তু গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি ও প্রচলিত রাজনীতির প্রতি অনাস্থা সন্ত্রাসবাদের ভবিষ্যৎ উত্থানকে ত্বরান্বিত করতে পারে।

গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের প্রধান দল এবং সরকারগুলো যতই বৈধতার সংকটে নিপতিত হয়েছে, যতই গণতন্ত্রের পথ থেকে সরে গেছে, ততই ধর্ম এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ইসলামপন্থী দলগুলোর অংশগ্রহণ এবং অংশীদারত্বের সুযোগ অবশ্যই থাকার কথা এবং তার মধ্য দিয়ে তারা হয় বিকশিত হতো কিংবা জনগণের কাছে এক দুর্বল গোষ্ঠী বলে প্রমাণিত হতো। যেসব নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোতে ইসলামপন্থী দলগুলো ভালো ফল করেনি এবং তাদের প্রতি সমর্থন ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতার বাইরের দলগুলো ইসলামপন্থীদের, বিশেষ করে রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার কারণে সমাজে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তাদের শক্তির চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে পড়েছে। রাজনীতির আলোচনার সূচি অংশত তারাই নির্ধারণ করছে। আশু এই অবস্থার অবসানের সম্ভাবনা নেই। উপরন্তু তা আরও বিস্তৃত হবে বলেই অনুমান করা যায়।

আগামীকাল: ‘সফল’ অর্থনীতি ও পরিবর্তিত সমাজ

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট

সাইমুম পারভেজ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। তিনি সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব সিডনি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন