রাজনীতির সাপে-নেউলে

স্কুলে পড়ার সময় হঠাৎ একদিন নতুন একটি শব্দের সঙ্গে পরিচিত হলাম—বাগ্‌ধারা, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে থাকত—‘নিচের যেকোনো তিনটি বা পাঁচটি বাগ্‌ধারা লইয়া বাক্য রচনা করো’। শুরুর দিকে ঝামেলা হতো। কেননা, শব্দগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে পরিচয় থাকলেও একাধিক শব্দ মিলিয়ে যে অন্য রকম অর্থ হয়, তা জানতাম না। ঘরে মা-বাবার সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁরা কদাচিৎ এসব ভাষা ব্যবহার করতেন।

বাগ্‌ধারার সংজ্ঞা ছিল এ রকম, ‘যেসব বাক্য বা বাক্যাংশের তাৎপর্য তাদের অন্তর্গত শব্দসমূহের আলাদা আলাদা অর্থের জ্ঞান থাকলেই অনুধাবন করা যায় না, বাক্য বা বাক্যাংশের অর্থ সামগ্রিকভাবে জানতে হয়।’ পরীক্ষায় প্রথমবার যখন বাগ্‌ধারা নিয়ে বাক্য রচনার প্রশ্ন দেখি, থতমত হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ, ক্লাসে এর আগে এসব পড়ানো হয়নি। পরীক্ষার প্রশ্নে এটা দিয়ে আমাদের জ্ঞান বা পাণ্ডিত্যের পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। তারপরও না বুঝে আমি প্রশ্নের উত্তর দিলাম, অর্থাৎ বাক্য রচনা করলাম। একটা বাগ্‌ধারার কথা মনে আছে—ইঁচড়ে পাকা। কোনোভাবেই অর্থ বের করতে পারছি না। শেষমেশ মনে হলো, যেহেতু ‘পাকা’ শব্দটি আছে, এটি একটি ফল না হয়ে যায় না। ব্যস, লিখে দিলাম—আমি ইঁচড়ে পাকা ফল খাই না। নম্বর পেয়েছিলাম বলে মনে হয় না।

পরে অনেক কিছুই জেনেছি, শিখেছি। কথায় কথায় আমরা বাগ্‌ধারা ব্যবহার করি। অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি দু-তিনটি শব্দ দিয়ে যে ভাব প্রকাশ করা যায়, আমরা বাগ্‌ধারা দিয়ে তা আরও স্পষ্ট করে তুলি।

এ রকম কিছু কথা আমরা প্রায়ই উচ্চারণ করি—সাপে-নেউলে, দা-কুমড়া, আদায়-কাঁচকলায়। আমার মনে হচ্ছে, এ রকম আরেকটি উদাহরণ জুড়ে দেওয়া যায়—আওয়ামী লীগ-বিএনপি। একেবারে খাপে খাপে মিলে যাবে। দুটির মধ্যে যে সম্পর্ক, তাতে এর মতো জুতসই বাগ্‌ধারা আর কী হতে পারে! কুমড়া, আদা কিংবা কাঁচকলা অতি নিরীহ জিনিস, আমরা মজা করে খাই। দা খুবই দরকারি একটা গৃহস্থালি সামগ্রী। কিন্তু কেউ যখন এটি দিয়ে মাছ না কুটে মানুষ জবাই করে, তখন আর এটা নিরীহ থাকে না। ইদানীং আমরা লম্বা লম্বা দা দেখছি। এটা হলো রামদা। সেই যে কবে আমরা লাঠি হাতে স্লোগান দিয়েছিলাম, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। এখন বীর বাঙালি রামদা হাতে রাজপথে লড়ে যাচ্ছে। লাঠি থেকে রামদা—এটা নিশ্চয়ই একটা উন্নয়ন। পুরোনো ‘বংশযুগ’ ছেড়ে এখন আমরা ‘লৌহযুগে’ পৌঁছেছি।

আওয়ামী লীগ আর বিএনপি দেশের সবচেয়ে বড় দুটি রাজনৈতিক দল। তারা অনেক বছর ধরেই যুদ্ধ করে আসছে, এক অন্যের বিরুদ্ধে। আগে ছিল নির্বাচনী যুদ্ধ। পুরাণ-ইতিহাসের কুরুক্ষেত্র কিংবা পানিপথের যুদ্ধের মতো। ধীরে ধীরে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলে গেছে। এখন এটা অনেকটা পলাশী কিংবা কারবালার যুদ্ধের মতো। খানিকটা একতরফা, খানিকটা পাতানো। প্রায়োগিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এটা নতুন সংযোজন। যুদ্ধের এই নতুন রীতিতে উভয় দলই পারঙ্গম। তারা একে অন্যের দিকে তর্জনী তুলে বলে, তোমরা অমুক সালে এটা শুরু করেছ। সোজা কথা হলো, তখন তোমরা ঢিল মেরেছ, এখন পাটকেল খাও।

ঠগ বাছতে গেলে গাঁ উজাড় হয়ে যায়। তাই সবাইকে নিয়ে মিলেমিশেই এক ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে জিন্দাবাদ-মুর্দাবাদ দিতে হয়। মুশকিল হলো, ছাতা দুটি। দলের বরকন্দাজরা দুই শিবিরে বিভক্ত। চেয়ার একটা, দাবিদার দুই পক্ষই। সুতরাং যুদ্ধ তো হবেই। যুদ্ধ চলছে, চলবে।

দল দুটির আন্তসম্পর্ক বোঝার জন্য সাপে-নেউলের উদাহরণ বেশি জুতসই মনে হয়। দুটি প্রাণীই নিজ নিজ ঘরে, চত্বরে নিরীহ জীবন যাপন করে। কিন্তু যখনই দুটির সাক্ষাৎ হয়, তখন তারা হয়ে পড়ে ভয়ংকর আগ্রাসী, কখনো সাপের জয় হয়, কখনো নেউল বা বেজি জিতে যায়। সেই জয়ে দুপক্ষেই রক্তক্ষরণ হয়।

তাদের এই আক্রমণাত্মক লড়াই কী নিয়ে? সচরাচর তা হয় অন্য কোনো নিরীহ প্রাণীর দখলদারি নিয়ে—কে তাকে খাবে। খাদ্য একটা, খাদক দুজন। লড়াই তো হবেই।

মানুষ লিখতে-পড়তে পারে। সে অবলীলায় বলে দেয়, ওটি হচ্ছে হিংস্র প্রাণী। যেমন বাঘ। বনের বাঘ বনের অন্যান্য পশু মেরে খায়—যেমন হরিণ কিংবা বানর। হরিণের চোখে বাঘ খুবই হিংস্র। তারপর একসময় মানুষ ঢোকে বনে, সে-ও হরিণ মারতে চায়। হরিণের মাংস দিয়ে রসনা তৃপ্ত করতে চায়। এ নিয়ে বাঘে-মানুষে লড়াই হয়। বেশির ভাগ সময় বাঘ জেতে। কারণ, তার গতি বেশি, থাবার জোর অনেক। মানুষ তার শক্তি বাড়ায় অস্ত্র দিয়ে—যেমন বন্দুক কিংবা রাইফেল। হরিণ কিংবা বাঘ যখন মানুষের হাতে আক্রান্ত হয়, তখন তাদের চোখে মানুষ হলো হিংস্র প্রাণী। মানুষ অবশ্য ভাবে অন্য রকম। সে নিজেকে মনে করে অধ্যবসায়ী, সৃজনশীল, আশরাফুল মাখলুকাত। তা ভাবতেই পারে।

রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণও একই রকম। তারা নিজেদের মনে করে ফেরেশতা, প্রতিপক্ষকে মনে করে শয়তান। এখানে উভয়ের খাদ্য হলো জনগণ, যাদের আমরা বলি ‘পাবলিক’। তারাও মানুষ। তারাও কম হিংস্র নয়। ঘরে, প্রতিবেশীর সঙ্গে, জমির সীমানা নিয়ে লড়াইয়ে তারাও কম যায় না। বাংলাদেশের কয়েকটি জায়গায় এ রকম যুদ্ধ হয় প্রায়ই। দলে দলে লোক জঙ্গের ময়দানে নেমে পড়ে টেঁটা, বল্লম, সড়কি, রামদা আর কুড়াল নিয়ে।

আরও পড়ুন

ব্রিটিশ-পাকিস্তানিরা বাঙালির নামে অপবাদ দিয়েছিল—আমরা নাকি মার্শাল রেস নই। কত বড় মিথ্যা! আমাদের রক্তে আছে লড়াই, যুদ্ধ। সামান্যতম সুযোগ পেলে আমরা তার প্রমাণ দিতে ছাড়ি না। দুষ্টু লোকে বলে, আমাদের রাজপথের লড়াকু অনেক বীরপুঙ্গব একাত্তরে পালিয়ে সীমান্তের ওপারে চলে গিয়েছিল। ফিরে এসেছিল ডিসেম্বরে। এরা নির্বোধ। এরা বোঝে না যে পালিয়ে যাওয়াও একটা রণকৌশল। নেতা নিরাপদ না থাকলে জাতি নেতৃত্বশূন্য হয়ে যাবে না?

বীর বাঙালির দ্বিতীয় পিটটান দেখেছিলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। নেতার লাশ সিঁড়িতে ফেলে অনুগ্রহজীবী মুজিব সেনারা দলে দলে ইঁদুরের গর্তে লুকিয়েছিলেন। য পলায়তি স জীবতি!

ঠগ বাছতে গেলে গাঁ উজাড় হয়ে যায়। তাই সবাইকে নিয়ে মিলেমিশেই এক ছাতার তলায় দাঁড়িয়ে জিন্দাবাদ-মুর্দাবাদ দিতে হয়। মুশকিল হলো, ছাতা দুটি। দলের বরকন্দাজরা দুই শিবিরে বিভক্ত। চেয়ার একটা, দাবিদার দুই পক্ষই। সুতরাং যুদ্ধ তো হবেই। যুদ্ধ চলছে, চলবে। মাও সে-তুংয়ের একটা কথা আছে—ঐক্য ক্ষণস্থায়ী, দ্বন্দ্ব চিরস্থায়ী। দুই দলের এক হয়ে কাজ করার নজির অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজতে হবে। তবে স্বার্থ যেখানে অভিন্ন, সেখানে তাঁরা গীত গান একই সুরে, যখন সংসদে তাঁদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব ওঠে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনীতির ব্যবধান যতটা না, তার চেয়ে স্লোগানের ব্যবধান বিশাল। একসময় আমাদের দেশে জমিদারি প্রথা ছিল। জমিদারদের কাজকর্ম অভিন্ন—প্রজাশোষণ ও প্রজাতোষণ। কৃষকের গায়ের রক্ত নিংড়ে নেওয়া খাজনা আদায়ের নামে এবং দু-একটা বিদ্যালয়, মক্তব বানিয়ে বা পুকুর কেটে প্রজার প্রতি মহানুভবতা দেখায়। কিন্তু একজনের সঙ্গে অন্যজনের দ্বৈরথ লেগেই থাকত। তাদের হয়ে মারামারি করত লাঠিয়ালেরা। এ লাঠিয়াল বলে আমার মনিব ভালো, তো অন্য লাঠিয়াল বলে আমার মনিব ঢের বেশি ভালো। তারা নিজেরা মারামারি করে মরে। জমিদারেরা বসে তাস-পাশা খেলেন। আওয়ামী লীগ-বিএনপির ব্যাপারটা অনেকটাই এ রকম। ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয় না। অনুগ্রহ ছড়ালে লাঠিয়ালের আকাল পড়ে না। এখন নয়া জমিদারদের নয়া জমানা।

নির্বাচনের একটা গন্ধ নাকে আসছে। তারা যার যার মতো তৈরি হচ্ছে। লাঠিয়ালেরা নড়েচড়ে বসছে, রিহার্সাল দিচ্ছে। আপাতত রিহার্সাল চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে।

রাজনীতির সাপে-নেউলে প্রসঙ্গে দুটি পর্যবেক্ষণ আছে আমার। এক. বিএনপি প্রায়ই বলে ঈদের পর তারা আন্দোলন করবে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটা পার হয়ে গেছে। আওয়ামী শিবির থেকে তাদের ট্রল করা হয়—আপনাদের ঈদ কবে? বিএনপি আন্দোলনের হুংকার দিলে আওয়ামী নেতারা বলেন, দেশ অস্থির করে তোলার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আন্দোলন না হলে বলেন, আপনাদের আন্দোলন করার ক্ষমতা নেই। দুই. দুই দলের লাঠিয়ালদের মধ্যে কোথাও হাঙ্গামা হলে বিএনপি নেতারা বলেন, এরপর যদি আর একটা আঘাত আসে, তাহলে তোমাদের ঘাড় ধরে ক্ষমতা থেকে নামাব। কয়েক দিন পর আরেকটা দাঙ্গা হলে একই হুংকারের পুনরাবৃত্তি হয়। এটা শোনার অভ্যাস হয়ে গেছে আওয়ামী লীগের। তারা গা করে না।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক