রাজনীতি ছেলেখেলা ও ফাজলামি নয়

কার্টুন:তুলি
কার্টুন:তুলি

বাংলাদেশের উজ্জ্বল রাজনৈতিক দিগন্তে এক নতুন জোটের আবির্ভাব ঘটেছে গত বৃহস্পতিবার। দুই বা তিন-দলীয় জোট নয়, একেবারে ১০-দলীয় জোট। জোটের নামটিও জুতসই—এনডিএফ। এ রকম একটি জোটের নাম আমরা ষাটের দশকে শুনেছি। ওই ঐতিহাসিক নামটি স্বাধীন বাংলাদেশের খ্যাতিমান রাজনীতিকেরা চুরি করেছেন, তা আমরা বলব না। যে ঐতিহাসিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এই জোট গঠিত হয়, সেই ‘অনুষ্ঠানের মঞ্চের ব্যানারে লেখা ছিল—দেশ, জাতি ও জনগণের স্বার্থরক্ষা এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রয়োজনে এ জোট’।
এই ঘোষণাটির চেয়ে সমর্থনযোগ্য বাণী আমি আমার জীবনে দুটি শুনিনি। আমার মতো নগণ্য নাগরিকেরও জীবনের স্বপ্ন ওই কথাগুলো। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কিঞ্চিৎ সংস্রব ছাড়া জীবনে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিইনি। নবগঠিত জোটের এই ঘোষণা শোনার পরে বাসনা জাগছে, ওই বিরাট জোটের কোনো-না-কোনো দলে যোগ দিই। ব্র্যাকেটে নেতার নামসহ জোটের ১০টি দলের নাম দেখেছি কাগজে। একই দিনের কাগজে ঈদ ও পূজার আগে বলে আরও দুটি পার্টির খবর পড়লাম। সেই দুটি পার্টি—অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টি—নতুন জোটসহ কোনো জোটেই যোগ দিয়েছে বলে খবরে জানা যায়নি।
জোটের জনপ্রিয় জননেতা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমরা এ জোটকে বিএনপির জোটের বিকল্প মনে করছি না। কিন্তু আমরা দেশ পরিচালনা করতে চাই। এ জোট নির্বাচনী জোট। আমরা ৩০০ আসনে প্রার্থী দেব। আমাদের আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ।’ [দৈনিক যুগান্তর]
একেবারে সাফ কথা। কিন্তু শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা আসে কেন? আন্দোলনের কথাই বা আসে কেন? ‘দেশ পরিচালনা’ করার কথাটা খুবই অর্থবহ। ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথার ওপরে কোনো কথাই নেই। ৩০০ আসনের মধ্যে অন্তত ১৭৫ থেকে ১৮৫ আসন পেলে খুব স্বচ্ছন্দে সরকার গঠন শুধু নয়, ‘দেশ পরিচালনা’ করা সহজ হবে। ৫০টি সংরক্ষিত মহিলা আসনের গোটা ৪০ তো এনডিএফের থাকবেই। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংসদে থাকবে একটি ‘বিরোধী দল’, যার ভূমিকা হবে বর্তমান সংসদের এরশাদ-রওশনের কার্যকর বিরোধী দলের মতো। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১০-দলীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত নিয়োগ দিলে আওয়ামী লীগ বা আমরা তার বিরোধিতা করব না। ১০-দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোটের সম্পর্ক যে আত্মীয়তার, তা দুধের দাঁত পড়ে আসল দাঁত উঠেছে, এমন শিশুরও বুঝতে বাকি নেই। সুতরাং ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যে সরকারটি আসছে, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রয়োজনে’ তা হবে একটি সমঝোতার সরকার। অতি শক্তিশালী দেশপ্রেমিক সরকার, যা বাংলার মানুষ স্বাধীনতার পর কখনো দেখেনি।
আমাদের ছাত্রজীবনে সেই ১৯৬২-তে যে এনডিএফ গঠিত হয়েছিল, তার কথা কিছু মনে আছে। পাকিস্তানের লৌহমানব একমাত্র ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের ১ মার্চ নতুন সংবিধান জারি করেন। সে সংবিধানের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, তিনিই আমৃত্যু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট থাকবেন। বাংলার নেতারা দেখলেন, তাঁরা আর কোনো দিনই ক্ষমতায় যেতে পারবেন না। ফিল্ড মার্শাল একটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দেওয়ার আশায় ৮ জুন ৪৫ মাস পরে সামরিক আইন তুলে নেন। দুই সপ্তাহ পরে নয়জন বাঙালি নেতা এক বিবৃতি দেন। সংবিধানের সমালোচনা করে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সেই বিখ্যাত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছিলেন নূরুল আমিন, আবু হোসেন সরকার, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিঞা), মাহমুদ আলী, সৈয়দ আজিজুল হক ও পীর মোহসিন উদ্দিন (দুদু মিয়া)।
টাঙ্গাইল জেলার সন্তোষের এক বৃদ্ধ নেতা ১৯৫৮ সাল থেকেই বন্দী ছিলেন, এর মধ্যে ’৬১-তে সাবেক প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সন্তোষের বুড়ো এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট পালন করেন। ছাত্রবিক্ষোভ হয় কয়েক দিনব্যাপী। আমাদের ছাত্রনেতারা গ্রেপ্তার হন। বিখ্যাত বিবৃতির নয় নেতা পল্টন ময়দানে জনসভা করে জাতীয় নেতাদের মুক্তি দাবি করেন এবং আন্দোলন গড়ে তোলেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জমে ওঠে। সে ছিল এক সময়! বন্দী নেতারা মুক্তি পান। ছাড়া পাওয়ার দুই সপ্তাহ পরে সোহরাওয়ার্দী অন্য নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে গঠন করেন ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ)’। দেশের দুই অংশের ৫৪ জন নেতা এনডিএফকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়ে তার সঙ্গে যুক্ত হন। দেশে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে তারা আন্দোলনের সূচনা করেন। এনডিএফের শরিক দলগুলোর মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), কৃষক-শ্রমিক পার্টি, জামায়াত-ই ইসলামী এবং মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের একটি অংশ। গত হপ্তায় যে এনডিএফ গঠিত হয়েছে, অত দল ওই এনডিএফে ছিল না।
সেকালের নেতারাও দোষ-ত্রুটিমুক্ত ছিলেন না। কিন্তু যতটা আমরা তাঁদের দেখেছি, তাঁরা কেউ ফালতু ও ধাউড়-বাটপার ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে আদর্শ ও নীতিগত পার্থক্য ছিল। ন্যূনতম রাজনৈতিক নীতিমালা ও শিষ্টাচার তাঁরা মেনে চলতেন। পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে তাঁদের কারও কারও যোগাযোগ থাকতে পারে; কিন্তু চক্ষুলজ্জাও তাঁদের ছিল।
আখেরি জামানা বা কলিকালে মানুষের লজ্জা-শরম বলে কিছু থাকবে না। এই দুই দিনের দুনিয়ায় খেয়েপরে ভালোমতো বেঁচেবর্তে থাকতে গেলে, সরকারি টাকায় ওমরাহ করতে চাইলে লজ্জা-শরমের বালাই করলে চলে না। তা ছাড়া, সুবিধা হলো, আমাদের সমাজে কেউ কাউকে মুখের ওপর প্রশ্ন করে না। আমরা ফালতুকে ফালতু বলি না, অসৎকে অসৎ বলি না, ঘুষখোরকে ঘুষখোর বলি না, ধর্ষকের সঙ্গে একই টেবিলে বসে খানাপিনা করি, ধাউড়-বাটপারকে ধাউড়-বাটপার বলে সম্বোধন করতে সংকোচ বোধ করি।
প্রকাণ্ড ফ্রন্ট গঠনের পরদিন বৈশাখী টেলিভিশন চ্যানেলে একটি প্রতিবেদন দেখতে পাই। তাতে জানতে পারি, ফ্রন্টের পাঁচটি দলের নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনই নেই। অধিকাংশ দলের কার্যালয় নেই। ফ্রন্টের যিনি শীর্ষ নেতা সোহরাওয়ার্দীর মতো গণতন্ত্রের মানসসন্তান, তাঁর নামটি কাগজে মাঝেমধ্যে আসে, অন্য ‘নেতা’দের নাম আমি শুনিনি। শীর্ষ নেতা বৈশাখী টিভিকে বললেন,
‘১৪–দলীয় মহাজোটেও নামসর্বস্ব দল আছে, আমার দলেও নামসর্বস্ব দল আছে।’ এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে ১৪-দলীয় জোটের চেয়ে তাঁর ১০-দলীয় জোট কম কিসে।
এই প্রকাণ্ড ফ্রন্ট গঠনের পক্ষকাল আগে থেকে কয়েকটি অপ্রধান দৈনিকের ভূমিকা আমার কাছে কৌতূহলজনক মনে হয়েছে। কোথায় কী গঠিত হচ্ছে, তার চেয়ে বড় বিষয় কিছু একটা ভাঙছে। কুড়িদলীয় জোট ভাঙছে এতেই পুলক। এক নির্মল আনন্দ। সংবাদমাধ্যমের শক্ত ভূমিকা ছাড়া দুনিয়ার কোনো দেশে গণতন্ত্র সুসংহত হয়েছে—এ কথা আমার অন্তত জানা নেই।
পাবলিক লাইফের কোনো ব্যক্তিকে তাঁর কাজের জন্য কাগজের কোন পাতায় কতটুকু জায়গা দিতে হবে, তা সাংবাদিকদের জানা উচিত। দেশে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটছে না। কীভাবে ঘটবে? যার যা প্রাপ্য, সে তা পাচ্ছে না। বছর দুই আগে খালেকুজ্জামানের বাসদের জাতীয় সম্মেলন হলো। বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক প্রতিনিধি আসেন। হাজার হাজার মানুষ। মিছিল বের হয় গুলিস্তান মহানগর সম্মেলন কেন্দ্র থেকে। শোভাযাত্রার এক মাথা গুলিস্তান, আরেক মাথা পুরানা পল্টন হয়ে দৈনিক বাংলা মোড়। পরদিন প্রথম আলোসহ দু-তিনটি কাগজে খবর দেখলাম কিছুটা—অধিকাংশ পত্রিকায় খবরই নেই। ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ওর সিকি সমাবেশ করলে বড় খবর হতো। ডিগ্রি শ্রেণির কলেজছাত্ররা তাঁদের ক্লাসরুমের সমস্যা নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করেন। সারা দেশের চার হাজার ছাত্রছাত্রীর বিরাট সমাবেশ। আয়োজক সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। নামজাদা সব বক্তা। পরদিন কাগজে খবর দেখিনি।
খালেদা জিয়া এবং তাঁর দল ও জোটের নীতি-আদর্শ-কর্মসূচি কী, তা জানা নেই আমার। থাকলে সমর্থন বা সমালোচনা করতে পারতাম। তবে তাঁর একটি জোট আছে, তাতে অন্যের মাথাব্যথা কেন? আওয়ামী লীগের প্রাজ্ঞ প্রচার সম্পাদক বলে চলেছেন, নগরে যখন গভীর রাত নামে, তখন বিএনপির অনেক নেতা তাঁর কাছে যান। হয়তো যান তাঁরা সরকারে যোগ দিতে, তাই বলে সে কথা প্রচার সম্পাদকের মুখে প্রচার না হওয়াই তো ভালো। গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা চলছে ৫০ দিনব্যাপী। ২৫ দিনব্যাপীই প্রচার সম্পাদক বললেন, ইসরায়েলের জায়নবাদী সরকারের সঙ্গে খালেদা জিয়ার যোগাযোগ আছে। টিভিতে তাঁর কথা শুনে বাংলার বোকারা মনে করল গাজায় বোমা মারার বুদ্ধি খালেদা জিয়াই দিয়েছেন, তাঁকে প্রচার সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী প্রতিদিন জঙ্গিবাদী বলছেন। তা বলার বাক্স্বাধীনতা তাঁদের আছে। অথচ গাজায় গণহত্যার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর সরকার এবং বিএনপির নেতা খালেদা জিয়ার ভূমিকার প্রশংসা করে আমি লিখেছি।
আদর্শের কারণে দল ভাঙে। কংগ্রেস ভেঙেছে। মুসলিম লীগ ভেঙেছে। সরকারি মদদে দল ভাঙাভাঙি আগেও হয়েছে। আওয়ামী লীগ ভেঙেছে। একটি তর্কবাগীশের নেতৃত্বে, একটি সালাম খানের নেতৃত্বে। কিন্তু মূলটি শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই টিকে যায়। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের লোকেরাই জাসদ বানান। পঁচাত্তরের পরে তিন আওয়ামী লীগ। একটি মিজান চৌধুরীর। আরেকটি আবদুর রাজ্জাকের। কিন্তু শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগই টিকে যায়। এবং ২৫ বছর পরে অনেক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি মন্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ভাঙার পারস্পরিক চেষ্টা নতুন নয়। বঙ্গীয় রাজনীতির লোকজন স্বার্থগত কারণে, ক্ষমতার লোভে কত নিচে নামতে পারেন, তা শেখ হাসিনার চেয়ে ভালো আর কেউ জানেন না। সে অপ্রিয় সত্য কথাটিই সেদিন তিনি সংসদে বলেছেন।
ভূমি ও বস্তু বেচাকেনা হয়, কোরবানির হাটে বেচাকেনা হয় গরু-ছাগল, রাজনৈতিক দলের লোক বেচাকেনা হবে কেন? ’৯২ থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত ৩২টি জোট গঠিত হয়েছে। বেশির ভাগই ৩০ দিনের বেশি টেকেনি। দেশে নবজাতকের মৃত্যুহার বেশি, জোটের মৃত্যুহার শতভাগ। যদি কেউ দেশের স্বার্থরক্ষা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে চান, কোনো জোটফোট না করেও তা করা সম্ভব। রাজনীতি ছেলেখেলা নয়। ফাজলামি তো নয়ই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷