
বাংলা-ভারত উপমহাদেশে খাজনা আদায়ের চল প্রাচীনকাল থেকেই। একসময় চাষবাসই ছিল প্রধান পেশা। আর ছিল কারিগর শ্রেণি। চাষিকে ফসলের একটা বড় অংশ খাজনা হিসেবে দিতে হতো। কখনো এক-তৃতীয়াংশ, কখনো বা অর্ধেক। নানান হাত ঘুরে এই খাজনা চলে যেত রাজকোষে। কৃষকের রক্ত ঘাম করা উপার্জনে চলত রাজা-বাদশাহর শান-শওকত, সৈন্য-সামন্তের খরচ, হাতি-ঘোড়া-বাঘ-ভালুকের খোরাকি। কত উপায়ে যে খাজনা আদায় করা হতো, ভাবলে অবাক হতে হয়। মোগল বাদশা জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর কৃষককে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যেমন খুশি তেমনভাবে খাজনা আদায় করার বিশৃঙ্খল পদ্ধতি থেকে।
আকবর বাদশাহ শৈশবে পিতৃহীন হন। অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে কেটেছে তাঁর বাল্যকাল ও কৈশোর। লেখাপড়া শেখার সুযোগ পাননি। তাঁর প্রধান উজির শায়খ আবুল ফজল আল্লামি আকবরের পাঁচ দশকের শাসনকালের খুঁটিনাটি নিয়ে লিখেছেন অমর গ্রন্থ আইন-ই-আকবরি। এই বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের একাদশ পরিচ্ছেদের খাজনা আদায়ের নানান পদ্ধতির বিবরণ পাওয়া যায়। জমির গুণাগুণভেদে প্রতিটি শস্যের জন্য খাজনার হারের তারতম্য ছিল। উদাহরণস্বরূপ সাধারণ মানের ধানের জন্য গড়ে উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ ছিল খাজনা। ‘বিঘাপ্রতি খাজনা ছিল গড়ে ৬ মণ ১০ সের ধান (২৫০ কেজি)। গম চাষের জন্য খাজনা ছিল বিঘাপ্রতি গড়ে ৪ মণ পৌনে ১৩ সের (প্রায় ১৭৩ কেজি)। বাকি ফসল দিয়ে একজন কৃষক কীভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে-পরে বাঁচতেন, তা গবেষণার বিষয়।
কত কিছুর ওপর যে খাজনা ধার্য করা হতো, তা বোঝা যায় আইন-ই-আকবরিতে উল্লেখ করা কতগুলো বিষয়ের ওপর খাজনা আদায় বন্ধ করার নির্দেশের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ আগে কর দিতে হতো। আকবর সর্বশক্তিমানের ওপর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তা মওকুফ করে দেন। এর অন্যতম ছিল ‘জিজিয়া’, তা ধার্য হতো অমুসলিমদের ওপর। কর দিতে হতো বন্দর ব্যবহারের জন্য, উপাসনালয়ে যাওয়ার জন্য, গবাদিপশু রাখার জন্য, প্রতিটি গাছের জন্য। এ ছাড়া ছিল দারোগা ও তহশিলদারকে দেয় অতিরিক্ত খাজনা। এখন অবশ্য গাছের জন্য নয়, কথা বলার জন্য কর দিতে হয়। শিশুদের ছবি আঁকার বইও খাজনাদারের তীক্ষ্ণ নজর এড়াতে পারে না।
আমরা যখন লালবাগ, আগ্রা, দিল্লির কেল্লা দেখতে যাই, আমরা শাসকদের পরাক্রম কিছুটা বুঝতে পারি। তাজমহল দেখে অবাক বিস্ময়ে শাহজাহান-মমতাজের ভালোবাসার কথা স্মরণ করি। আমরা একবারও কি ভাবি, এসব স্থাপনায় ব্যবহার করা পাথরের প্রতিটি টুকরোয় লুকিয়ে আছে খাজনা দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া গরিব মানুষের কান্না?
সময় অনেক বদলে গেছে। শাসকের ভাষা, পোশাক পাল্টেছে। কিন্তু খাজনা আদায়ের কলকাঠির তেমন হেরফের হয়নি। রাষ্ট্রের প্রয়োজন কী তা শাসকেরাই নির্ধারণ করেন। এখন আর রাজতন্ত্র নেই। আমাদের ‘গণতন্ত্র’ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাদশাহি শান-শওকত কমেনি; বরং বেড়েছে। খাই মেটানোর জন্য চাই অঢেল টাকা। তাই যেনতেন প্রকারে রাজকোষ ভরতে হবে। এখন খাজনাদারের মশাল এনবিআরের হাতে। ওর ওপরে আছেন রাজকোষের রক্ষক আবুল মাল আবদুল মুহিত। তাঁরাই ঠিক করে দেন কাকে কত খাজনা দিতে হবে। আমাদের কাজ হলো সময়মতো হুকুম তামিল করা। রাজকীয় ফরমান এখনো আছে। এখন তার নাম হলো ‘গেজেট’। এর মাধ্যমেই জারি হয় হুকুমনামা। তার আগে খাজনা–সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কিছু লেখাজোকা হয়। আমরা তার নাম দিয়েছি ‘বাজেট’।
বাদশাহি আমল থেকে গণতন্ত্রের যুগে একটা পার্থক্য চোখে পড়ে। আগে শাসকদের খরচের কোনো হিসাব দিতে হতো না। কার ঘাড়ে কয়টা মাথা যে প্রশ্ন করবে? এখন বাজেটে খরচেরও একটা হিসাব থাকে। তবে কোন খাতে কত খরচ হবে, কীভাবে খরচ হবে, তা শাসকেরাই নির্ধারণ করে দেন।
বাজেট হলো আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অতি আবশ্যক অনুষঙ্গ। দেশে যেহেতু গণতন্ত্র আছে, তাই বাজেটে জনপ্রতিনিধিদের অনুমোদন থাকাটাই দস্তুর। এ জন্য মাসব্যাপী মাহফিলের আয়োজন হয় জাতীয় সংসদে। বাজেট নিয়ে যত আলোচনা হয়, তার চেয়ে বেশি হয় খিস্তি-খেউড়। একজন জনপ্রতিনিধি যদি পাঁচ মিনিট কথা বলার সুযোগ পান, তিনি বঙ্গবন্ধু-কীর্তন করেন দুই মিনিট। আরও দুই মিনিট খরচ করেন প্রধানমন্ত্রী-বন্দনায়। বাকি এক মিনিট পঞ্চাশবার ‘মাননীয় স্পিকার’ বলতে বলতেই শেষ হয়ে যায়। বাজেটের সূক্ষ্ম খুঁটিনাটি নিয়ে কথাটি আর বলা হয়ে ওঠে না। বছরের পর বছর সরকার বদল হলেও আমরা একই নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখছি।
বাজেট মানেই আয়ের উৎস এবং খরচের ফর্দ। এসব সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিবেশন করার একটা ব্যাকরণ আছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় থেকে একটা হিসাব পাঠিয়ে দেওয়া হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। অন্যদিকে চলে করদাতা অর্থাৎ শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের এনবিআরে দৌড়ঝাঁপ। কোন খাতে কী পরিমাণ কর ধার্য হবে, সেটা অনেকটাই নির্ভর করে কোন গোষ্ঠী এনবিআরে কী পরিমাণ তদবির করতে পারে, তার ওপর। শেষ মুহূর্তে ‘জনস্বার্থে’ অর্থমন্ত্রী কিছু রেয়াত দেন। কেউ খুশি হন, কেউ হন না। বাজেটে প্রস্তাবিত কর হারে খুব একটা হেরফের হয় না।
আধুনিক রাষ্ট্রের অনেক ঝক্কিঝামেলা। তার ব্যবস্থাপনার জন্য রাজধানী থেকে গ্রাম অবধি প্রশাসনের ডালপালা আছে। তাদের খাই মেটাতে হয়, দিতে হয় বেতন-ভাতা। রাষ্ট্রের অনেক শত্রু—দেশের বাইরে, এমনকি দেশের ভেতরেও। তাই সুরক্ষার জন্য দরকার হয় সামরিক বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী, পুলিশ, গোয়েন্দা বাহিনী ইত্যাদি। এদের জন্যও খরচপাতি করতে হয় বিস্তর।
আমাদের জনপ্রতিনিধিরা সকাল-সন্ধ্যা খেটে যাচ্ছেন জনগণের ভাগ্য বদলাতে। তাঁদেরও তো খিদে পায়, জামাকাপড় পরতে হয়, দ্রুতগতির যানবাহন লাগে। দাপ্তরিক কাজের জন্য লাগে পাইক-পেয়াদা। তাঁদের জন্যও বরাদ্দ থাকে কিছু। এরপর আছে জনজীবন একটু আয়েশি করার আয়োজন। এ জন্য দরকার হয় ‘উন্নয়ন’। নিতে হয় একের পর এক প্রকল্প। এ জন্য হয় আলাদা বাজেট। এসব কিছুর জন্য যে টাকাটা দরকার, তার জোগান দেন নাগরিকেরা। আগে খাজনা দিতে হতো আয় অনুযায়ী। এখন চালু হয়েছে ‘ভ্যাট’। এটা কমবেশি সবাইকে দিতে হয়। এ দেশে সবাই এখন কর দেন।
নাগরিকেরা কর না দিলে রাষ্ট্রব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে। এটা কারও কাম্য নয়। কিন্তু মানুষ চায় একটা জনবান্ধব রাষ্ট্রব্যবস্থা। মানুষ যদি মনে করে, তার দেওয়া খাজনার টাকায় অন্য কেউ মচ্ছব করে বেড়াচ্ছে, তাহলে তার কর দেওয়ার ইচ্ছায় ভাটা পড়বে। এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা বেশ আগ্রাসী। মামলা-মোকদ্দমা, জেল-জরিমানা দিয়ে কর ফাঁকি দেওয়া বন্ধের জন্য আয়োজন আছে বিস্তর। কিন্তু যাঁরা রাষ্ট্র চালান, তাঁদের ভেবে দেখা উচিত, মানুষ কেন কর দিতে চায় না বা কর কম দিতে চায়।
মানুষের মধ্যে একটা ধারণা বা পারসেপশন আছে যে তার করের ঢাকা লুট হয়ে যায়, অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচ হয়, এমনকি যেসব প্রকল্পের কারণে মানুষের ক্ষতি হয়, তাও করা হয় করের টাকায়। অভিযোগগুলো একেবারেই অমূলক নয়। খবরের কাগজ পড়ে আর টেলিভিশনে দেখে দেখে আমাদের একটা ধারণা হয়েছে যে জনস্বার্থের সঙ্গে যোগাযোগহীন অনেক লোককে করের টাকায় পুষতে হয়। কিছু লোকের মুনাফার জন্য এমন সব ব্যয়বহুল প্রকল্প নেওয়া হয়, যার দায় পুরোটাই গিয়ে পড়ে করদাতাদের ওপর। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে নাগরিকেরা কেন কর দেবেন?
আমাদের দেশে যে গতিতে উন্নয়ন হচ্ছে এবং যে খরচে হচ্ছে, তা আরও কম খরচে করা সম্ভব, যদি চুরিচামারি এবং অপচয় কমানো যায়। প্রকৃত অবস্থা হলো, চুরিচামারি, লুটপাট ও অপচয় ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ফলে নাগরিকদের মনে একধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। সাধারণ নাগরিকেরা বেশির ভাগই আইন মেনে চলার পক্ষপাতী। তাঁরা গোলমাল চান না, গোলমালে পড়তে চান না। কিন্তু তিনি যদি দেখেন তাঁর দেওয়া করের টাকায় একজন অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তি বা একটি প্রতিষ্ঠানের ভোগে লাগছে, তাহলে তাঁকে কর দিতে বলাটাই অনৈতিক।
আমাদের দেশের মানুষ গায়ে-গতরে খেটে কিংবা মেধা দিয়ে অনেক সম্পদ তৈরি করেন। তার একটা বড় অংশ লুট হয়ে যায়, বিদেশে পাচার হয়ে যায়। গণমাধ্যমে সম্প্রতি এ-সম্পর্কে ভয়াবহ কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এটা বন্ধ করা গেলে নাগরিকদের করভার কমিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ উন্নয়নকাজ করা সম্ভব, অথবা কর হার না কমিয়ে উন্নয়নের গতি অনেক গুণ বাড়িয়ে দেওয়া যায়।
এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ আসলেই ‘কামধেনু’। তাকে যথেচ্ছ দোহন করা যায়। তাদের সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে একটা গোষ্ঠী ফুলেফেঁপে উঠছে। বিদেশে তৈরি হচ্ছে সেকেন্ড হোম, বেগমপাড়া। এমনকি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কেউ কেউ বিদেশের নাগরিক। আমাদের দেশে ‘দ্বৈত নাগরিকত্বে’র একটা আইন আছে। এই আইনের বলে তাঁরা এ দেশে আসেন। বিশ্বের কোনো ‘উন্নত’ দেশে এটা কল্পনাও করা যায় না। বাংলাদেশ প্রকৃতপক্ষে ওই সব বাঙালির সেকেন্ড হোম।
রাজা যায় রাজা আসে। আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কোনো উন্নতি দেখা যায় না। যাঁদের প্রখর দৃষ্টিশক্তি, তাঁরা বিশাল বিশাল প্রকল্প দেখেন। দেশে এখন মেগা প্রজেক্টের ছড়াছড়ি। এ দেশে একসময় তিন-চার শ কোটি টাকার বাজেট হতো। এখন তিন-চার হাজার কোটি টাকার নিচে কোনো প্রকল্পের কথা চিন্তাই করা যায় না।
আমরা আরাম কেদারায় বসে প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথার খই ফোটাই। এটা সাড়ে ছয় না সাড়ে সাত পার্সেন্ট হবে, তা নিয়ে তর্ক জুড়ি, গলদঘর্ম হই। মানুষ দেখে তার বাজারের থলেটা সে ভরতে পারছে কি না। প্রবৃদ্ধি দিয়ে সে কী করবে? তার দরকার পেট ভরে খাওয়া, কাজের সুযোগ, জীবনের নিরাপত্তা প্রবৃদ্ধির মারপ্যাঁচ দিয়ে তা কি মেটানো যায়?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।