রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমের সুস্পষ্ট পার্থক্য রেখা কেন টানা দরকার

রাশিয়ার হামলায় বিধ্বস্ত ইউক্রেনের জনপদছবি : রয়টার্স

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে পশ্চিমা জনগণের মনোজগৎ যে প্রশ্নে আচ্ছন্ন হয়ে আছে তা হলো, ‘পুতিনের মনে আসলে কী আছে?’ পশ্চিমা পণ্ডিতেরা খুব বিস্মিত হয়ে পড়েছেন এই ভেবে যে, ‘পুতিনের আশপাশের লোকজন কি তাঁকে পুরো সত্যটা জানাচ্ছে না? পুতিন কি তবে অসুস্থ নাকি উন্মাদ হয়ে গেছেন? আমরা কি পুতিনকে কোণঠাসা করতে করতে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতে পারি না, যেখানে চলমান সংঘাতকে একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে নিজের মুখরক্ষা করাটাই তাঁর একমাত্র পথ হবে?’

সুস্পষ্ট সীমারেখা আঁকার এ ধরনের মোহাচ্ছন্ন চিন্তার ইতি টানতে হবে। এই সীমারেখা আঁকাটা বস্তুগত বাস্তবতা নয়। পুতিন সব সময় নিজের ছক নতুন করে আঁকছেন। রাশিয়ার কর্মকাণ্ড নিয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়া নতুন ছক আঁকতে তাঁকে সহযোগিতা করছে। আমরা এখন প্রশ্ন তুলছি, ‘ইউক্রেনকে গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কি সীমা লঙ্ঘন করেনি?’—এমন প্রশ্ন তোলার মাধ্যমে মূল প্রশ্নটিকেই হাওয়া করে দেওয়া হচ্ছে। মূল সত্যটি হলো, রাশিয়া সীমান্ত লঙ্ঘন করে ইউক্রেনের ওপর হামলা চালিয়েছে। পুতিন ‘অদমনীয় অশুভ শক্তি’ এমন একটা উপলব্ধিতে পৌঁছানোর আগে পশ্চিমাদের অবশ্যই নিজেদের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে হবে, ‘আমরা মুক্ত পশ্চিম—এ বিষয়ে আসলে কী চাইছি?’

ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া এবং রাশিয়ার নৃশংস অবস্থানের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে যে অস্পষ্টতা, তার বিশ্লেষণ অবশ্যই আমাদের করতে হবে। ইউরোপীয় উদারতাবাদের মৌলিক ভিত্তিগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমরা আজ দ্বিমুখী আচরণকেও পেছনে ফেলে এসেছি। স্মরণ করুন, পশ্চিমা উদারনৈতিক ঐতিহ্য, উপনিবেশবাদ কীভাবে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার হরণ করেছে। নবজাগরণের মহান দার্শনিক ও মানবাধিকারের প্রবক্তা জন লকের কথাই ধরুন। বামপন্থীদের মতোই অতিরিক্ত ব্যক্তিসম্পত্তির বিরুদ্ধে যিনি যুক্তি তুলে ধরেছেন। অথচ তিনিই আবার মত দিয়েছেন, আদি আমেরিকানদের ভূমি শ্বেতাঙ্গ বসতি স্থাপনকারীদের দখলে নেওয়া ঠিক কাজ। তিনি মনে করতেন, ব্যক্তি যতটুকু ভূমি ব্যবহার করে উৎপাদন করতে পারবে, ততটুকু ভূমিই তার গ্রহণ করা উচিত। যে ভূমি তিনি ব্যবহার করতে সক্ষম নন, সেটার মালিক হওয়া তার ঠিক হবে না। উত্তর আমেরিকায় তিনি দেখেছিলেন, সেখানকার আদি বাসিন্দারা বিশাল আয়তনের ভূমি ব্যবহার করেন, বিশেষ করে শিকারের জন্য। কৃষি সম্প্রসারণের জন্য শ্বেতাঙ্গ বসতি স্থাপনকারীদের সেই জমি চায়। লক মনে করতেন, মানবতার জন্য আমেরিকার আদি বাসিন্দাদের সেই জমি দখল করে নেওয়ার অধিকার শ্বেতাঙ্গদের রয়েছে।

উদারনৈতিক পশ্চিম কপট, কেননা বেছে বেছে তারা নিজেদের ‘উচ্চ মান’ প্রয়োগ করে। কপটতার অর্থ হচ্ছে, তুমি নিজেকে যে মানের হিসেবে ঘোষণা করেছ, বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে সেটা লঙ্ঘন করো। রাশিয়া ভন্ডামিমুক্ত যে বিশ্বব্যবস্থা দিতে চাইছে, সেটাতে কোনো বৈশ্বিক নৈতিক মান থাকবে না। কেবল বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে সেটা নির্ধারিত হবে। সেখানে পরস্পরের পার্থক্যটাকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে। এ ধরনের চিন্তার বাস্তব প্রয়োগ আমরা সম্প্রতি আফগানিস্তানে দেখেছি।

চলমান ইউক্রেন সংকটের ক্ষেত্রে দুই পক্ষই নিজেদের কর্মকাণ্ডের সপক্ষে এমন যুক্তি উপস্থাপন করছে যে এগুলো করা তাদের জন্য অনিবার্য ছিল। পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে মুক্ত ও স্বাধীন করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে। আর রাশিয়া অভিযোগ করছে, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই তারা ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে। সর্বশেষ ঘটনার দিকে তাকানো যাক। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, যদি ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যুক্ত হয়, তাহলে রাশিয়াকে ‘জোর করে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ’ নিতে বাধ্য করা হবে। না, এটা জোরজবরদস্তির কোনো ঘটনা নয়। একই যুক্তিতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও তাদের জোর করে বাধ্য করা হয়নি। এই জবরদস্তির তত্ত্ব কেবল তখনই সত্য, যখন রাশিয়ার মতাদর্শিক ও ভূরাজনৈতিক ধারণাকে গ্রহণ করা হবে।

অনেকের কাছে মনে হতে পারে, পুতিনের রাজনীতি এবং রাশিয়ার সংস্কৃতির মধ্যে খুব সুস্পষ্টভাবে একটা ছেদরেখা রয়েছে
ছবি : রয়টার্স

কোনো ধরনের বিধিনিষেধ ছাড়াই এই ধারণার বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। অনেকের কাছে এটা মনে হতে পারে, পুতিনের রাজনীতি এবং রাশিয়ার সংস্কৃতির মধ্যে খুব সুস্পষ্টভাবে একটা ছেদরেখা রয়েছে। কিন্তু সেটা একটা ফালতু ধারণা। বছরের পর বছর ধরে ধৈর্যের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ইউক্রেন সংকট সমাধানে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে রাশিয়া বাধ্য হয়েছে সেখানে হামলা চালাতে—এ ধরনের ধারণা খুব দৃঢ়ভাবে আমাদের প্রত্যাখ্যান করা উচিত। কোনো দেশই বাধ্য হয়ে গোটা আরেকটি দেশের ওপরে কিংবা পুরো দেশকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হামলা চালায় না। এর শিকড় অনেক গভীরে।

রাশিয়ার অলিগার্কি জনক আনাতোলি চুবিস (১৯৯২ সালে রাশিয়ায় ব্যক্তিমালিকানার বিকাশে নেতৃত্ব দেন) ১৯১৪ সালে বলেছিলেন, ‘গত তিন মাসে আমি আবার পুরোটা দস্তয়েভস্কি পড়লাম। মানুষ সম্পর্কে ঘৃণা জন্ম হওয়া ছাড়া আমার মধ্যে আর কোনো অনুভূতি হয়নি। নিঃসন্দেহে তিনি একজন প্রতিভাবান সাহিত্যিক, কিন্তু রাশিয়ানদের নিয়ে তাঁর যে ধারণা, সেটা বিশেষ একটা ধারণা। পবিত্র মানুষ সম্পর্কিত ধারণা। আর্তের প্রতি তাঁর যে বেদনা এবং সাহিত্যে ভুল যে মানুষকে তিনি উপস্থাপন করেছেন, তাতে তাঁর সাহিত্যকর্মের ওপর আমি অশ্রুপাত করতে চাই।’ আমি যদিও চুবিসকে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার কারণে ভীষণভাবে অপছন্দ করি। কিন্তু দস্তয়েভস্কি সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়নটা সঠিক। ইউরোপ ও রাশিয়ার মধ্যকার গভীরতম পার্থক্যটা দস্তয়েভস্কির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়—ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বনাম সম্মিলিত চেতনা, বস্তুগত ভোগবাদ বনাম আত্মত্যাগের চেতনা।

ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানির জন্য বন্দর যাতে মুক্ত করা যায়, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে
ছবি : রয়টার্স

রাশিয়া এখন তাদের আগ্রাসনকে পশ্চিমা বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে উপনিবেশ মুক্তকরণের লড়াই হিসেবে উপস্থাপন করছে। এ মাসের প্রথম দিকে রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ একটি নিবন্ধ লিখেছেন। বর্তমানে রাশিয়ান ফেডারেশনে নিরাপত্তা কাউন্সিলের উপসচিব তিনি। মেদভেদেভ লিখেছেন, ‘আমেরিকাকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়া এবং বাস্তব বোঝাপড়াভিত্তিক একটা আন্তর্জাতিক জোট জন্ম নেওয়ার অপেক্ষায় বিশ্ব (বাস্তব বোঝাপড়াভিত্তিক বলতে অবশ্যই বিশ্বজনীন মানবাধিকারের প্রতি অশ্রদ্ধাকেই বোঝানো হচ্ছে)।’

আমাদের অবশ্যই একটা সীমারেখা টানতেই হবে, কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের প্রতি স্পষ্ট সংহতি থাকতে হবে। মেদভেদেভ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে, কয়েকটি দেশে খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে।’ ২০২২ সালের মে মাসে রাশিয়ার নৌবাহিনীর অবরোধে ২৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন গম ওদেসা বন্দরের জাহাজ অথবা গুদামে পচতে শুরু করেছে। জাতিসংঘ খাদ্য কর্মসূচি সতর্ক করে দিয়েছে, দক্ষিণ ইউক্রেনের বন্দর যদি শিগগিরই চালু করা না হয়, তাহলে বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়বে। ইউরোপ এখন ইউক্রেনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, রেল ও সড়কপথে তারা গম ও অন্যান্য খাদ্যশস্য পরিবহনের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু পরিষ্কার কথা হচ্ছে, এ উদ্যোগ যথেষ্ট নয়, এ ক্ষেত্রে আরও বড় পদক্ষেপ প্রয়োজন। খাদ্যশস্য রপ্তানির জন্য বন্দর যাতে মুক্ত করা যায়, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রতিরক্ষার জন্য সামরিক জাহাজ পাঠাতে হবে। এটা ইউক্রেনের বিষয় নয়, এশিয়া, আফ্রিকার লাখ লাখ মানুষকে ক্ষুধার হাত থেকে রক্ষা করার বিষয়। এখানে একটা স্পষ্ট সীমারেখা টানতেই হবে।

সম্প্রতি রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, ‘একবার ভাবুন তো যুদ্ধটা (ইউক্রেন যুদ্ধ) আফ্রিকা অথবা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘটিত হচ্ছে। ভাবুন ইউক্রেন হচ্ছে ফিলিস্তিন। ভাবুন রাশিয়া হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।’ ইউক্রেন সংঘাতের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার এই তুলনাকে স্বাভাবিকভাবেই অনেক ইসরায়েলি বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা মনে করেন, ইউক্রেন ও ফিলিস্তিনের মধ্যে মিল নেই। ইউক্রেন হচ্ছে সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, কিন্তু ফিলিস্তিনকে কখনোই রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নয়, কারণ ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের অধিকারকে অস্বীকার করে। একইভাবে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের অধিকারকে অস্বীকার করে রাশিয়া।

উদারনৈতিক পশ্চিম কপট, কেননা বেছে বেছে তারা নিজেদের ‘উচ্চ মান’ প্রয়োগ করে। কপটতার অর্থ হচ্ছে, তুমি নিজেকে যে মানের হিসেবে ঘোষণা করেছ, বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে সেটা লঙ্ঘন করো। রাশিয়া ভন্ডামিমুক্ত যে বিশ্বব্যবস্থা দিতে চাইছে, সেটাতে কোনো বৈশ্বিক নৈতিক মান থাকবে না। কেবল বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে সেটা নির্ধারিত হবে। সেখানে পরস্পরের পার্থক্যটাকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে। এ ধরনের চিন্তার বাস্তব প্রয়োগ আমরা সম্প্রতি আফগানিস্তানে দেখেছি। তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে চীনের সঙ্গে একটি চুক্তি করে ফেলে। চীন আফগানিস্তানের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়, চীন উইঘুরদের সঙ্গে কী আচরণ করছে, সেটা নিয়ে তালেবান মাথা ঘামায় না। সংক্ষেপে রাশিয়ার দেওয়া নতুন বিশ্বায়নের ধারণা এটিই।

আমরা (পশ্চিম) যদি আমাদের উদারনৈতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে চাই, তাহলে যে বিশ্বজনীনতার কথা আমরা বলি, নির্মমভাবে তার চর্চা করতে হবে। এখন যদি দ্বিমুখী নীতির প্রয়োগ করি, তবে আমাদের অবস্থান রাশিয়ার ‘বাস্তববাদী’ নীতির থেকে ভিন্ন কিছু নয়।

স্লাভয় জিজেক সাংস্কৃতিক দার্শনিক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে