রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া শেষ হয়নি

একটি দেশের ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণগুলো যখন প্রতিবছর ফিরে আসে, তখন তা হয়ে ওঠে একাদিক্রমে স্মৃতিতর্পণের, উদ্‌যাপনের এবং হিসাব-নিকাশের সময়। জাতির ইতিহাস কোনো বিমূর্ত বিষয় নয় এবং কেবল সবার দৃষ্টিগ্রাহ্য বড় ঘটনাও নয়। ঘটনাপ্রবাহের কেন্দ্রে যাঁরা থাকেন, ইতিহাসের পাতায় যাঁরা নায়ক বলে চিহ্নিত, তাঁদের জীবনই কেবল ইতিহাস নয়, তাঁরাই কেবল ঘটনাপ্রবাহের অনুঘটক নন। তাঁদের ভূমিকা স্মরণে রেখেই বলা যায়, জাতির অংশীদার প্রত্যেক মানুষই এই ইতিহাসের নির্মাতা ও অনুঘটক। সে কারণেই এই দিবসগুলো ব্যক্তির ও পরিবারের স্মৃতিতর্পণের সময়, যেমন সম্মিলিত স্মৃতিতর্পণের। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি গণযুদ্ধ, বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে একটি গণহত্যা মোকাবিলা করে, লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে, কোটি কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুতির মধ্য দিয়ে, লাখো মানুষের নির্যাতিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এই যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রতিটি পরিবারের স্মৃতি—বেদনার, আনন্দের। ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার, বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ—এই অর্জন আনন্দের, সাফল্যের; কিন্তু বেদনা আর আত্মোৎসর্গ দিয়ে রচিত।

এই দিন উদ্‌যাপনের, কেননা এই সাফল্যের অংশীদার সবাই, এই সাফল্যের যাঁরা প্রত্যক্ষ অংশীদার নন, তাঁদের জন্যও এর তাৎপর্য একই—উনপঞ্চাশ বছর পরে তো অবশ্যই, এমনকি কয়েক শ বছর পরেও। এই অংশীদারত্বের বোধ তৈরি হয় যখন একজন বুঝতে পারেন, এই অর্জনের পেছনের সম্মিলিত স্মৃতি কী; এই অর্জনের গুরুত্ব তাঁর জীবনে কোথায়। এই গুরুত্ব বোঝা এবং বোঝানোর জন্যই দরকার হিসাব-নিকাশের, আত্মবীক্ষার—দেশ হিসেবে কতটা অর্জন হলো, কতটা বাকি থাকল। যেকোনো সালতামামির সঙ্গে ইতিহাসের মাইলফলক ঘটনার উদ্‌যাপনের পার্থক্য এখানে, তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ইতিহাসের এই পর্বের সূচনা কীভাবে হয়েছিল, কী লক্ষ্যে এই যাত্রা শুরু হয়েছিল, কী অঙ্গীকারে মানুষ একত্র হয়েছিল। সে কারণেই ১৬ ডিসেম্বরে স্মৃতিতর্পণের এবং উদ্‌যাপনের পাশাপাশি অবশ্যপালনীয় কর্তব্য হচ্ছে এই আত্মবীক্ষার, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কতটা অগ্রসর হয়েছে।

অগ্রযাত্রার এই হিসাব গত এক বছরের নয়, গত এক দশকেরও নয়—উনপঞ্চাশ বছরের। প্রতি ১৬ ডিসেম্বর এবং ২৬ মার্চেই আমাদের ওপরে এই দায়িত্ব বর্তায়। এই বছরে তা আরও বেশি, কেননা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ তিন মাস পরই অর্ধশতাব্দীর একটি অসামান্য মাইলফলক স্পর্শ করবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছিল ২৬ মার্চ ১৯৭১, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও প্রতিশ্রুতি ঘোষিত হয়েছিল ১৭ এপ্রিল—স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার ভেতরে বাংলা ভাষাভাষীদের জাতি গঠনের আকাঙ্ক্ষার ইতিহাসের সূচনাপর্ব নিয়ে ভিন্নমত থাকাই স্বাভাবিক; এটি কেবল যে বর্তমান ভৌগোলিক সীমানার ভেতরেই বিবেচনা করতে হবে, সেটাও বিতর্কসাপেক্ষ। জাতি গঠনের একটি বিষয় হচ্ছে একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ে জাতি বিষয়ে কেবল একটি ধারণা থাকে তা নয়, বিভিন্ন ধরনের চিন্তা ও স্বপ্ন উপস্থিত থাকে। তার মধ্যে যেটি কর্তৃত্বশীল হয়ে ওঠে, নৈতিক বা বস্তুগত আধিপত্য বিস্তার করতে পারে, সেটিই প্রধান ধারা হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র গঠনের বিষয় এর চেয়ে সহজতর। জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র গঠনের উপাদান। এগুলো অর্জন করতে পারলেই রাষ্ট্র গঠন সম্ভব। অবিসংবাদিতভাবে এই চারটির সব কটি অর্জনের দিন হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর।

একটি রাষ্ট্র রাষ্ট্র হয়ে উঠবে কেন, সেটাই নির্ধারিত হয় তার ঘোষিত লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য দিয়ে। তার নৈতিক বৈধতার ভিত্তি তৈরি হয় এই লক্ষ্যের সর্বজনীনতায়, তার ঘোষণার আইনি ও নৈতিক ভিত্তির ওপরে। যেহেতু ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের সশস্ত্র পর্বের শেষ এবং প্রতিশ্রুত উদ্দেশ্য অর্জন পর্বের সূচনা, সেহেতু এ রাষ্ট্রের অর্জনের সাফল্য ও অপূর্ণতা বিচারের ভিত্তি হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এই বিচারের দুটি মানদণ্ড তৈরি করে দিয়েছে—একটি হচ্ছে শাসন কীভাবে পরিচালিত, অন্যটি হচ্ছে রাষ্ট্র নাগরিকদের কী দেবে। ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন, সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি।’

নাগরিকদের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অর্জিত ম্যান্ডেট যে গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ঘোষণার ভিত্তি, তার শাসন এর চেয়ে ভিন্ন হতে পারে না। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গত ৪৯ বছরে সেই জায়গা থেকে বারবার সরে এসেছে। স্বাধীনতার প্রথম দুই দশকেই কেবল তার ব্যত্যয় ঘটেছে তা নয়, কিংবা ১৯৯৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তার অন্যথা ঘটেছে, তা নয়—গত প্রায় দেড় দশকে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় নির্বাচিতদের ম্যান্ডেট প্রশ্নবিদ্ধ। উপর্যুপরি দুটি নির্বাচনের নৈতিক বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ এবং জনগণের ‘সার্বভৌমত্ব’ বারংবার অবহেলিত, কার্যত অনুপস্থিত। এই ব্যবস্থা অংশগ্রহণমূলক নয়; শাসনের এই ধরন নাগরিকের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য নয়। জনগণের ম্যান্ডেটের প্রয়োজন যখন অবসিত হয়েছে, ক্ষমতার বলয়ে সেই গোষ্ঠীই শক্তিশালী হয়েছে, যাদের এই ম্যান্ডেটের দরকার নেই। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার প্রতিষ্ঠার উনপঞ্চাশ বছরের উদ্‌যাপনকালে এই প্রশ্নের মুখোমুখি, সেটাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।

গত প্রায় পাঁচ দশকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন। অর্থনৈতিক বিবেচনায় ১৯৭২ সালে এই রাষ্ট্রের টেকসই না হওয়ার আশঙ্কার কথা বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, কিন্তু তাঁদের সংশয়কে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করেই বাংলাদেশের সাফল্য অর্জিত হয়েছে। অর্থনীতি বিকশিত হয়েছে, আকারে বড় হয়েছে, তার গঠনকাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। এই সাফল্যের কারণে সামাজিক সূচকগুলোতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে—শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে, নারীর অংশগ্রহণের মাত্রা বেড়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই অর্জন সরকার বা রাষ্ট্রের একক প্রচেষ্টায় হয়নি, অর্থনীতিতে ও সামাজিক খাতে রাষ্ট্র এবং নাগরিকের অংশগ্রহণের সমন্বয় যখন ঘটেছে, তখনই এগুলো অর্জন করা গেছে। কিন্তু যা অর্জিত হয়নি তা হচ্ছে সাম্য; অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্র নাগরিকের সাম্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সাম্য অনুপস্থিত, বড় হয়ে উঠেছে বৈষম্য। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সম্পদ কমেছে, তাদের খাদ্যে পুষ্টি কমেছে, তাদের আয় কমেছে। যখন এক বিশাল জনগোষ্ঠী ক্রমাগতভাবে অরক্ষিত বা ভালনারেবল হয়ে পড়ছে, তখন একশ্রেণির মানুষের সম্পদ বাড়ছেই। স্বাধীনতার পরের কয়েক দশকে রাজনীতিবিদেরা সাম্যের প্রতিশ্রুতি দিতেন—নির্বাচনী ইশতেহারে, দলের ঘোষণাপত্রে; এখন তা আর গণ-আলোচনার সূচিতেও নেই।

যেকোনো রাষ্ট্রের নাগরিকদের মানবিক মর্যাদার নিশ্চয়তা প্রদান সম্ভব কেবল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। আইনের চোখে নাগরিকের সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে যখন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে, যখন আইন প্রয়োগকারী ও জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা সরকারের নয়, ক্ষমতাসীন দলের নয়, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হবেন—প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। তাঁদের বিচারের মাপকাঠি আনুগত্য নয়, সংবিধান নাগরিককে যে অধিকার দিয়েছে, তা সুরক্ষা করা। মানবিক মর্যাদার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এই রাষ্ট্র, তা পালন কোনো সরকারের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ বিষয়। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের কথা বলবেন, তাঁদের এই প্রশ্নের মোকাবিলা করতেই হবে যে প্রচলিত আইন ও শাসনব্যবস্থার মধ্যে মানবিক মর্যাদার প্রশ্ন কেন অবহেলিত।

সমাজ নিশ্চল প্রতিষ্ঠান নয়, সমাজ বদলায়। স্বাধীনতা বাংলাদেশের সমাজকে বদলে দিয়েছে খুব দ্রুত। স্বাধীনতা সমাজকাঠামোর একটা অংশকে বদলে দেওয়ার কথাই ছিল। তারপর অর্থনীতির সাফল্য, নগরায়ণ, বিশ্বায়ন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি, গ্রামীণ সমাজের ক্ষমতাকাঠামোতে পরিবর্তন সমাজে বড় ধরনের বদল ঘটিয়েছে। কিন্তু এই বদলের সুবিধা সমানভাবে সবার মধ্যে বণ্টিত হয়েছে, সেই দাবি করা যাবে না। তার চেয়েও বড় হয়ে উঠছে যা, তা হচ্ছে সামাজিক ন্যায়বিচার ক্রমাগতভাবে দুর্বল হয়েছে, সমাজের দুর্বল অংশ—যাঁরা সংখ্যালঘু নন, জনমিতির হিসাবে যাঁরা আসলে সংখ্যাগুরু, তাঁরা এবং যাঁরা কোনো না কোনোভাবে সংখ্যালঘু, তঁারাও রাষ্ট্রের কাছ থেকে এখন আর ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন না। সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু তার সবটাই ইতিবাচক নয়। সহনশীলতা হ্রাস পেয়েছে, অসহিষ্ণু সমাজে সামাজিক ন্যায়বিচার কল্পনামাত্র।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যে রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছিল, সেই প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। কেননা রাষ্ট্র গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়ায় দেশ সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে কি না, সেটা বিচার করতে হবে সেই ১৬ ডিসেম্বরে দেওয়া প্রতিশ্রুতির মানদণ্ডেই।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর