লালন ও ডিলান এবং হারানো হৃদয়

গায়ক-কবি বব ডিলান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় মনে পড়ল বাংলার গায়ক-কবি ফকির লালন সাঁইয়ের কথা। পুরস্কারদাতা নোবেল কমিটির বরাতে আমরাও কি বলতে পারি, ফকির লালন সাঁই শুধু বড় মাপের সাধক ও সমাজসংস্কারকই নন, তিনি অনেক বড় একজন শিল্পী! তাঁর সৃষ্টি ভাব, চিন্তা ও দর্শনের পরও সাহিত্য হিসেবেও কীর্তিময়! প্রচলিত ধারার সাহিত্যিকদের অনেকেই আপত্তি করবেন। ওজর তুলবেন, সাহিত্যিক হতে হলে তো লেখা চাই। যে-সে লেখা না, একেবারে ছাপাখানা থেকে বই হয়ে আসা লেখা। বলবেন, সাহিত্য মানে লিখিত গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস ইত্যাদি সৃজনশীল কর্ম। এগুলো ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয়। আর পুরস্কার পেলেন কিনা এমন একজন, যাঁর কাজ ছাপা হয় না, রেকর্ড হয় স্টুডিওতে, উচ্চারিত হয় মঞ্চে। সাহিত্য আর সংগীতকে একাকার করার বিপক্ষেও থাকবেন তাঁরা।

যেখানে কথা থাকে, ভাব থাকে, জীবনজিজ্ঞাসা থাকে, মানুষের জীবনের গল্প থাকে, মোটা দাগে আমরা তাকেই সাহিত্য মনে করতে পারি। আর এটা এমন এক দেশের কথা, যেখানে হাজার বছর ধরে কবিতা, নাটক ও কাহিনি গাওয়া হতো। সাহিত্য ও সংগীত এখানে একাকার। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন রূপ চর্যাপদ তো আসলে চর্যাগীতিকা। এগুলো গাওয়া হতো।

মধ্যযুগের ​‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ও তো গান। তারপরও তো আমরা এসবকে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ গণ্য করি। সেদিক থেকে লালনের গানের কথাও সাহিত্য। যে ভাব, সৌন্দর্য, মানবিক আকুতি ও দর্শন সেখানে ধরা আছে, তা সাহিত্য তথা শিল্পের রূপ ও রস নিয়েই আছে। ‘লোক’, ‘পল্লি’ ইত্যাদি বিশেষণ দিয়ে এসবকে সাহিত্যের মূল প্রবাহ থেকে আলাদা করা তবে কেন? গানের কথার সাহিত্যগুণের প্রমাণ রেখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম স্বয়ং। প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীন মনে করতেন, তাঁর নাটকগুলো উপন্যাসের মতো পড়া যায়; অতএব সেসবকে কথাসাহিত্যের পদবাচ্য ভাবা হোক। প্রতিভাবান এই শিল্পীর দাবি উপেক্ষা করা কঠিন।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে গান ও সংগীতালেখ্যগুলো আমাদের জাতীয় আখ্যান তথা জাতীয় ন্যারেটিভ। কেবল বাউলগানই নয়, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, মাইজভান্ডারি, বিচ্ছেদী, মরমি, যত ধারার গান আছে, সেগুলোর কথা ও কাব্য অবশ্যই সাহিত্যিক গুরুত্বের দাবিদার। বাংলাদেশ তো গায়ক-কবিদের দেশ। লালন-হাসন রাজার দেশ। জালাল উদ্দিন খাঁ, শাহ আবদুল করিমের দেশ। বাংলাদেশের মানুষের মন, এখানকার প্রকৃতি, অনুভূতির ইতিহাস তথা মানবসমগ্রকে বুঝতে তাঁরাই তো আমাদের সাহায্য করেন। বাংলা ভাষার রূপ ও রসের বৈচিত্র্য ও গভীরতার পরিচয় পেতে তাঁদের কাছে আমাদের যেতে হবে। একটি দেশের ভাষাভাষীদের সব ভাষিক সৃষ্টিকে সাহিত্যের গরিমা দেওয়ার এই কার্পণ্য আসলে সাহিত্যের ছড়ানো উৎস থেকে বিচ্ছিন্নতারই ফল।

কিন্তু মধ্যবিত্ত আসরে, আধুনিক ও শিক্ষিত চিন্তায় এই কবিদের উপেক্ষা করার চল আছে। নিম্নবর্গীয় গ্রামজগতে এসব শিল্পীর যে প্রভাব, মানুষের মুখে মুখে তাঁরা যেভাবে ভাবুকতার বুলি জুগিয়ে যান, যে ভালোবাসা তাঁরা পান, তা মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাহিত্যের সেখানে পৌঁছাতে এখনো দেরি আছে। শতবর্ষ পেরিয়ে লালন ক্রমে আরও উজ্জ্বল আরও প্রভাবশালী হয়ে উঠছেন।

লালন কৃষকশ্রেণির মনের মানুষ, গ্রামগঞ্জে এখনো তাঁর মতের পথিকদের সংখ্যা অগণিত। বাংলার ভাবুকতার থই পেতে লালনের নিরিখ আমাদের লাগবেই। তাঁর মধ্য দিয়ে কয়েক শ বছর পুরোনো এক ভাবান্দোলন শিখরে উঠেছিল। মানবজীবনকে আরও মঙ্গলময় করার এক দার্শনিকচর্চা বিকাশ পেয়েছিল। আমরা পেয়েছি চিন্তা, ভাব আর সৃজনের অপরূপ এক সিলসিলা। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল লালনের দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। কিন্তু তার পরে? তার পরে লালনকে ভাবা হতে থাকল কেবলই বাউল হিসেবে। বাউলের ভেতরের শিল্পী ও দার্শনিক সত্তাকে উপেক্ষা করা হতে থাকল।

একদিকে দরবারি সাহিত্যজগতে গায়ক-কবিদের খাটো করে দেখার অভ্যাস, অন্যদিকে চলছে ক্রমাগতভাবে বাউল-সাধকদের অনাদর ও নির্যাতন। এ জন্যই বলা যে এক দেশে পুরস্কার, অন্য দেশে তিরস্কার। গত কয়েক বছরে বাউলদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন অনেক বেড়েছে। এ বছরের জানুয়ারি মাসে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ফয়সাল আহমেদ টুটুল (৩০) নামের এক বাউলশিল্পীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এরপর কুষ্টিয়ায় জঙ্গিরা হত্যা করেছে এক বাউলভক্তকে। গত ২৯ জুলাই চুয়াডাঙ্গায় বাউল আশ্রমে হামলা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় আশ্রমের ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। চুল কেটে দিয়েছে দুই বাউলের। ২০১১ সালে রাজবাড়ীতে বাউল-সাধকদের আখড়া অনুষ্ঠানে হামলা হয়, মাথা মুড়িয়ে দেওয়া হয় ২৮ জন সাধকের।

ওই ঘটনার পর এক বৃদ্ধ বাউলের কথা সংবাদে এসেছে। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘যে অপমান ওরা করেছে, এর চেয়ে ক্রসফায়ারও ভালো ছিল।’ এটা তাঁর অভিমান, অভিমানটুকুর মধ্যে একটা দাবিও ছিল যে না বুঝুক, মূল্য না দিক, অন্তত তাড়িয়ে বেড়াবে না, ধরে মারবে না। বাঁচতে দেবে আপন মতো, গাইতে দেবে। সমমনাদের সঙ্গে চিন্তার আলাপ-বিলাপে বাদ সাধবে না। সাধকের মনের এটুকু অভিমানের মূল্য দেওয়ার মানুষ আজ কম। এই দুনিয়া কি আর সেই দুনিয়া আছে?

এই ক্ষতির বোধ থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাউলের গান’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘তোমরা বাংলা বাংলা করিয়া সর্বত্র খুঁজিয়া বেড়াইতেছ, সংস্কৃত ইংরাজি সমস্ত ওলট্-পালট্ করিতেছ, কেবল একবার হৃদয়টার মধ্যে অনুসন্ধান করিয়া দেখ নাই।’ হ্যাঁ, কৃষকগীতি আর বাউলগানে সেই হৃদয়ের প্রাণভোমরা লুকানো ছিল। এই সাংস্কৃতিক বিপর্যয়েরই শিকার বাউলেরা।

তাঁদের মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়, তাঁরা হারাতে থাকেন আশ্রম, মাজার, আখড়া ও সাধুসঙ্গের ঠাঁই। একসময় জমিদারেরা তাঁদের নির্যাতন করেছে, মোল্লা-পুরোহিতেরা তাঁদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে, সরকারি প্রশাসন খোদ লালনের আখড়ায় বাউলদের মতামত উপেক্ষা করে ভবন বানিয়েছে, কর্তৃত্ব স্থাপন করেছে। সম্প্রতি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে স্পনসরের নামে আখড়া-আশ্রম-মাজার প্রাঙ্গণে বাউল তাড়ানো মেলা বসানোর হিড়িক। আর আমরা শহরে বসে কেবল মিছা বাউল বাউল করছি। এই ভড়ংকে পরিহাস করেই বিজয় সরকার গেয়েছিলেন, ‘বাউল করো তোমরা/ বাউল কি আর আছে?/ বড় দুঃখে বাংলার বাউল মইরাছে।’

বব ডিলান মোটেই বাউল তরিকার লোক নন। তিনি আধুনিক, নাগরিক। মিল এখানেই যে বাউলদের মতো তিনিও প্রতিবাদী শিল্পী। তাঁর নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তিতে গায়ক-কবিদের ধারাই বৈশ্বিকভাবে সম্মানিত হলো। ডিলান বিরাজ করেছেন দশকে, লালন সাঁই বিরাজ করছেন শতাব্দীজুড়ে। ডিলানের সুবাদে লালন সাঁইয়ের ১২৬তম তিরোধান দিবসের প্রাক্কালে আবারও তাঁকে স্মরণ করি।