লিপস্টিক–ল্যাপটপে সংঘাত নেই

আর্থিক খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
ছবি: প্রথম আলো

‘আপনার ওয়াইফ কী করে’—এ প্রশ্ন আমাদের নারীর অগ্রযাত্রার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। কোনো পুরুষ বিয়ে করেছেন জানার পর হাতে গোনা কিছু ব্যতিক্রম বাদে, এ প্রশ্ন কখনোই করা হতো না সেই পুরুষ কিংবা তাঁর পরিবারকে।

মোটাদাগে এই শতাব্দীর শুরু থেকে এই প্রশ্ন করাটা শুরু হয়ে সেটা বাড়তে বাড়তে এখন অনিবার্য এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিবাহিত পুরুষ কিংবা তাঁর পরিবারের জন্য। বিবাহিত নারী আবহমানকাল থেকেই পরিবারে অসংখ্য মূল্যবান কাজ করেছেন, করছেন এখনো। কিন্তু আর্থিক বিনিময় পান না বলে সেটার স্বীকৃতি নেই, তাই ‘আপনার ওয়াইফ কী করে’ প্রশ্নের জবাবে গৃহিণী নারীর স্বামীর জবাব হতো ‘কিছু করে না’।

এই যে ২০ বছর আগেও আমরা খুব একটা জিজ্ঞাসা করতাম না ‘আপনার ওয়াইফ কী করে’? এর মানে হচ্ছে আমরা তখন এ প্রশ্নের উত্তরটা জানতাম। আমরা জানতাম, কিছু পড়াশোনা নারীরা করবেন, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিও হয়তো নেবেন, কিন্তু সেটা বিয়ের বাজারে যোগ্যতা অর্জনের জন্য। আমরা জানতাম নারী ‘কিছু করবেন না’, হবেন গৃহিণী। অনেক বছর হয়ে গেল নারী আজ ‘কিছু করতে’, অর্থাৎ আর্থিক বিনিময় পান, এমন কাজ করতে শুরু করেছেন। যে প্রশ্ন দিয়ে কলামটি শুরু করেছি, দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, সেটা নারীদের ‘কিছু করা’-জনিত অর্জিত সম্মান এবং সেটি বহু ত্যাগের বিনিময়ে নারীকেই অর্জন করতে হয়েছে।

আরও পড়ুন

প্রতিবছর ৮ মার্চ এলেই আমরা নারীমুক্তি, নারী অগ্রগতি, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা বলি। সভা, সেমিনার, গোলটেবিল, টিভি টক শো থেকে শুরু করে সব আলোচনার কেন্দ্রে থাকে নারী। নারীসংগঠন থেকে রাজনৈতিক দল—সবাই নতুন করে সোচ্চার হয় নারীর অধিকার নিয়ে। সন্দেহ নেই, বহু ক্ষেত্রেই নারীর জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, এগিয়েছেন নারী। চাকরি থেকে ব্যবসা, রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, সমাজনীতি, সর্বত্র তাঁর দৃপ্ত পদচারণ। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন ফাঁক থেকে যায়।

নারীর অগ্রযাত্রার ইতিহাস খুব পুরোনো নয় এখানে। বহু প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে আজ নারীর এ অবস্থান। প্রধানমন্ত্রী, প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতা, স্পিকার এ দেশে নারী। কিন্তু কথা থেকে যায় তারপরও। গুটিকয় সৌভাগ্যবান নারীর অগ্রগতি সমাজের আপামর সাধারণ নারীর চিত্র তুলে ধরে না কোনোভাবেই। বলা হয়, এ সমাজ নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক। কিন্তু আমার মতে এটি কেবল যে বৈষম্যমূলক, তা-ই নয়, বরং অতি নারীবিদ্বেষী সমাজে আমাদের বাস।

এখানে বাধা নানামুখী। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় নারীকে চলতে হয়। আর তাই পুরুষের বহু পেছন থেকে যাত্রা শুরু করতে হয় তাঁকে। পুরুষের সমান বা তাঁকে ডিঙিয়ে যেতে শ্রম দিতে হয় পুরুষের কয়েক গুণ বেশি। কেবল নারী বলেই নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হয় আলাদাভাবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী পৃথিবীতে কোনো দিন শোষিতের হাতে তাঁর অধিকার তুলে দেয়নি কেউ। অধিকার কেউ দেয় না কাউকে, অধিকার আদায় করে নিতে হয়। আর সেই আদায় করার ক্ষেত্রে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন

স্বাধীনতার ৫০ বছরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নারীর অগ্রগতি হয়েছে নিঃসন্দেহে। সরকারের শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রীর হার প্রায় ৫১-তে উন্নীত হয়েছে। মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকেও প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ছাত্রী। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেয়েদের হার কিছুটা কম, ৩৮। বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য, বখাটেদের উৎপাতসহ নানা কারণে মেয়েদের শিক্ষা ব্যাহত হলেও সার্বিকভাবে সাধারণ শিক্ষা ও পেশাগত শিক্ষা—মেডিকেল, প্রকৌশল ও কারিগরি, সব ক্ষেত্রে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে।

শিক্ষার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের হার বেশি। কিন্তু বিশ্বায়নের এই যুগে কেবল পুথিগত বিদ্যা বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। দেশ ও দেশের বাইরের প্রতিমুহূর্তের উল্লেখযোগ্য খবরের একটা ধারণা থাকা উচিত একজন আধুনিক মানুষের। বিশ্ব এখন আক্ষরিক অর্থেই হাতের মুঠোয়। মুহূর্তে মুঠোফোনের একটা ক্লিকে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের খবর জানা যায় শুধু ইচ্ছা থাকলেই। কিন্তু এই ইচ্ছারই ঘাটতি আমি দেখি মেয়েদের মধ্যে।

নারীরা দুর্বল, মনে করেন বিশ্বের ৯০ শতাংশ নারী-পুরুষ। জাতিসংঘের এক নতুন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য। বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিষয়ে নারীদের চেয়ে পুরুষদের ওপরই বেশি ভরসা করেন। এর পেছনে কারণও আছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নারীদের যে আগ্রহ আমরা দেখি, তেমনটি দেখি না জাতীয়, আন্তর্জাতিক অন্যান্য বিষয়ে। নিজে রাজনৈতিক কর্মী বলেই আগ্রহ নিয়ে বোঝার চেষ্টা করি এ বিষয়ে অন্য নারীর আগ্রহ কতটা। যা দেখি, তাতে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

আন্তর্জাতিক বা ভূরাজনীতি দূরেই থাকুক, দেশের রাজনীতি নিয়েও কাউকে তেমন আগ্রহী হতে দেখি না। বহু উচ্চশিক্ষিত নারীর এই বিষয়ে জানার-বোঝার পরিমাণ দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। আমার এক ডাক্তার বান্ধবীকে একদিন গর্বভরে বলতে শুনেছিলাম, ‘দেশে আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি ক্ষমতায়, সেটাও তিনি জানেন না।’ এই না জানা যে গর্বের নয়, লজ্জার, এটি সেদিন বোঝাতে পারিনি তাঁকে।

বিশ্ববিখ্যাত মেকআপ, ঘড়ি, জুতা বা ব্যাগের ব্রান্ডের নাম, দাম, কোথায় পাওয়া যায়, ফ্যাশনের ট্রেন্ডিং কী—এ তথ্যগুলো জানেন না, এমন মেয়ে কমই আছে। নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা দূষণীয় কিছু নয়। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন এটাই মূল চিন্তার বিষয় হয়ে যায়। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক খবর, এই বিষয়গুলো সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা, আপডেট একজন নারীকে ভেতর থেকে যে আত্মবিশ্বাস এনে দেয়, সেটি তাঁর সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলে কয়েক গুণ। একজন ফ্যাশনেবল নারীর চেয়ে আত্মবিশ্বাসী স্মার্ট নারীর সৌন্দর্য অনেক বেশি। লিপস্টিকে আমার আপত্তি নেই যদি ল্যাপটপে চোখ রেখে নারী দেখে সারা বিশ্বের খবর।

রেস্তোরাঁয় দেখি খাবারের স্বাদ কিংবা আপনজনের সঙ্গ উপভোগের চেয়ে বেশির ভাগ মেয়ের মূল মনোযোগ থাকে একটা সুন্দর সেলফি বা খাবারের ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করার দিকে। নারীমুক্তির কথা যতই বলি না কেন, পুরুষতন্ত্রের দেখানো পথেই বারবার হাঁটতে দেখি নারীকে। পুরুষতন্ত্র চায় নারী তাঁর মূল মনোযোগ রাখুন বাহ্যিক সৌন্দর্য আর আনুষঙ্গিক সাজসজ্জার প্রতি, প্রায় সব ক্ষেত্রে নারীও সেটিই করেন।

যত গালি আমরা রাজনীতিবিদদের দিই না কেন, শেষ পর্যন্ত রাজনীতিবিদেরাই দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। কিন্তু কয়জন নারী কারও উত্তরাধিকারী না হয়ে রাজনীতিতে এসেছেন এবং লড়াই করে তাঁর স্থান তৈরি করতে পেরেছেন? অবস্থান তৈরি করতে না পারুন, অন্তত চেষ্টাটা করছেন? পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় টাকা শক্তির এক বিরাট উৎস, কিন্তু কয়জন নারী ঝুঁকি নিয়ে নিজে উদ্যোক্তা হয়ে ব্যবসা তৈরি করছেন? অসংখ্য নারী গান গাইতে, অভিনয় করতে, পণ্যের মডেল হয়ে ‘নাম করতে’ চান, কিন্তু গান লেখা, সুর করা, সিনেমা বানানোয় আগ্রহী খুব কমসংখ্যক নারী। পড়াশোনা করে একটা ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য অসংখ্য নারী আগ্রহী; কিন্তু গবেষক, বিশেষ করে ভৌত বিজ্ঞানী হচ্ছেন কয়জন? জৈবিক ও সামাজিক কারণে নারীর মধ্যে ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা কিছুটা কম, কিন্তু সে কারণে এই জায়গাগুলো একেবারে ছেড়ে দিলে চলবে?

প্রতিবছর বাজেটের সময় হাতে গোনা দু-একজন ছাড়া কোনো নারীকে দেখি না বাজেট বিশ্লেষণে আগ্রহী হতে। অথচ অর্থনীতি নিয়ে পড়া মেয়ের সংখ্যা তো নেহাত কম নয়। পত্রিকায় লেখার সুযোগ হয় না অনেকেরই, কিন্তু আমার পরিচিত অর্থনীতি পড়া মেয়েরা ফেসবুকেও তো দুই লাইন লেখে না বাজেট নিয়ে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, পড়ছেন বহু নারী। কিন্তু অল্প কিছু নারী ছাড়া কাউকে দেখি না ভূরাজনৈতিক বিষয়ে আগ্রহী হয়ে কিছু লিখতে, পড়তে কিংবা বলতে।

এমনকি অতি আলোচিত আন্তর্জাতিক ঘটনা নিয়েও মেয়েদের তেমন আগ্রহী হতে দেখা যায় না। আমার বন্ধুরা সবাই বাংলাদেশের প্রথম সারির স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং তৎসংক্রান্ত বিশ্বপরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে হতাশ হতে হয়েছে আমাকে। বেশির ভাগই বিষয়টি নিয়ে ন্যূনতম ধারণা রাখেন না।

এ সমাজে নারী যতটুকু সম্মান-মর্যাদা-মূল্যায়ন অর্জন করেছেন, সেটুকু কারও দয়ার দান নয়। নারী নিজে এটা অর্জন করেছেন। এই অর্জন হয়েছে নানা ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান তৈরি করে পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে পারার মাধ্যমে। এটাকে যদি সত্যি বলে মেনে নিই, তাহলে এটাও আমরা নিশ্চয়ই মানব, নারীকে এই সমাজে অবস্থান যদি আরও সুদৃঢ় করতে হয়, তাহলে সেটা হতে হবে নানা নতুন ক্ষেত্রে নিজের অবস্থান তৈরি এবং বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলোয় অবস্থান আরও পোক্ত করার মাধ্যমেই।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন শিক্ষকতা বা চিকিৎসাসেবার বাইরে অন্য কোনো পেশায় নারীকে ভাবা হতো না। সেই বাধা ডিঙিয়ে প্রায় সব পেশায় এখন তাঁর দৃপ্ত পদচারণ। কিন্তু এখানেই থামলে চলবে না; কাজ করতে হবে এমন সব ক্ষেত্রে, যা এখনো কেবল পুরুষের বলেই ধরে নেওয়া হয়। জায়গা কেউ ছেড়ে দেয় না, জায়গা তৈরি করে নিতে হয়। যোগ্যতা নারীকেই অর্জন করে নিতে হবে, যেমনটি নিয়েছেন এত দিন।

রুমিন ফারহানা বিএনপিদলীয় সাংসদ ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী