লুঙ্গি

গত মঙ্গলবার প্রথম আলোর নকশার প্রচ্ছদকাহিনি ছিল ‘ঐতিহ্যে আগামী’। ২০১৬ সালের ফ্যাশনে নাকি মা-দাদির শাড়ি ফিরে আসবে, ট্রাঙ্কে রাখা পুরোনো শাড়ির কদর যাবে বেড়ে। মানে ফিরে আসবে মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক।
সে ক্ষেত্রে ছেলেদের পোশাকে লুঙ্গি ফিরবে কি না, এটা একটা প্রশ্ন। নাকি লুঙ্গি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত পোশাকের তালিকায় চলে যাবে।
আসলেই আমরা লুঙ্গির গৌরব ভুলে যেতে বসেছি। লুঙ্গি একটা অপূর্ব জিনিস। বিদেশিদের কাছে এটা অষ্টম আশ্চর্য। বোতাম নেই, দড়ি নেই, বেল্ট নেই, ফিতা নেই, সেফটিপিন নেই, এই আশ্চর্য জিনিস মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে পরাভূত করে বাংলাদেশিদের কোমরে থাকে কী করে! এবং এটা খুলে যায় না কেন? এবং এটা পরে শোয়ার পরে তা সারা রাত যথাস্থানে থাকে কী করে! অনভ্যস্ত মানুষেরা ট্রাই করে দেখেছেন, সকালবেলা লুঙ্গি মাফলারের মতো গলায় এসে জড়ায়। তাহলে বাংলাদেশিরা এটা পরে দিনের পর দিন সতর ঢাকছে কী করে!
এই মহা রহস্যময় পোশাকটির প্রেমে পড়েছিলেন কিছুদিন আগে বিদায় নেওয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা। তিনি লুঙ্গি পরতেন, যাওয়ার সময় এই দেশ থেকে লুঙ্গি নিয়ে গিয়েছিলেন। লুঙ্গি পরে রিকশায় চালকের আসনে বসে তিনি ফটোসেশন করেছিলেন, সেটা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। (প্রসঙ্গত, ঢাকায় লুঙ্গির ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন রিকশাওয়ালারা। আপনি প্যান্ট পরা রিকশাওয়ালা দেখতে পাবেন না। এই কারণেই ঢাকার কূটনৈতিকপাড়ার বাড়ির মালিকদের সংগঠন ওই এলাকায় লুঙ্গি পরা রিকশাওয়ালা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।)
লুঙ্গি পরতেন মাওলানা ভাসানী। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী, যদি তিনি কোনো কারণে পুরুষ হন, তিনিও লুঙ্গি পরে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে হাজির হন। ভুটানি ও নেপালিরাও তাদের মতো করে জাতীয় পোশাকের গ্রহণযোগ্যতা বজায় রেখেছে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে। শুধু বাংলাদেশে লুঙ্গি তার যথাযথ কদর পেল না। কবি ও বিএনপি নেতার উপদেষ্টা ফরহাদ মজহার লুঙ্গি পরে ঢাকা ক্লাবে ঢুকতে চেয়েছিলেন, তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এর প্রতিবাদে তিনি বিপ্লবী কলাম রচনা ও প্রকাশ করেছিলেন। তাতে বাংলার বিপ্লবী সাহিত্য বেশ ঋদ্ধ হয়েছে এবং নতুন মাত্রা লাভ করেছে। তাঁর শিষ্যরা কেউ কেউ লুঙ্গি পরে সর্বত্র চলাচল করে থাকেন।
ইরাকে মার্কিন হামলার প্রতিবাদে বাংলাদেশের অগ্রগণ্য সাংবাদিক ও লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ সেলাই করা কাপড় বর্জন করেন। এটা এই অঞ্চলের মানুষের ঐতিহ্য—বিদেশিরা এই অঞ্চলে আসার আগে আমরা সেলাইবিহীন কাপড় পরতাম। ধুতি আর শাড়ি। ব্লাউজ ছিল না। লুঙ্গিতেও সেলাই ছিল না। ঠাকুরবাড়ি শাড়ির সঙ্গে পরার জন্য ব্লাউজ, পেটিকোট ইত্যাদির প্রচলন করে। ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে এই মিথ্যা অজুহাতে মার্কিনরা হামলা চালায় এবং পুরো পৃথিবীটাকে অশান্ত করে তোলে, সৃষ্টি করে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ও কোটি মানুষের বেদনার কারণ। তারই প্রতিবাদে সৈয়দ আবুল মকসুদ দুই খণ্ড সেলাই-ছাড়া সাদা চাদর পরা শুরু করেন। তিনি এখনো সেই ব্রত পালন করে চলেছেন।
কিছুদিন আগে সৈয়দ আবুল মকসুদ ভাই আমাদের সঙ্গে গল্প করছিলেন। বললেন, সেদিন রিকশায় যাচ্ছি। দুই লোক ঝগড়া করছে। একজনের পরনে লুঙ্গি। দ্বিতীয় লোক তার লুঙ্গি ধরে টানাটানি করছে। ভাবছিলাম, রিকশা থামিয়ে তাদের ঝগড়া মিটিয়ে দেব। কিন্তু লুঙ্গি ধরে টানাটানি শুরু করার পর ওখানে যাওয়াটা আর বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হলো না।
কিন্তু লুঙ্গির উপকারিতা অনেক। কবি কায়সার হক এ বিষয়ে একটা দীর্ঘ ইংরেজি কবিতা লিখেছেন। এই দেশে প্রবাদ প্রচলিত আছে, যষ্মিন দেশে যদাচার, কাছা খুলে নদী পার। সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, এই বর্ষা-প্রধান নদীমাতৃক দেশে মানুষ লুঙ্গি বা ধুতিকে তাদের পোশাক হিসেবে বেছে নিয়েছে। কারণ, তাতে চলাচলের সুবিধা হয়। কায়সার হকের কবিতায় লুঙ্গি পরে নদীতে নামার পর সেটা বাতাসে ফুলিয়ে ঢোল বানানোর ইমেজ পাই, সেটা পড়ে অনেক দিন পরে সেই দৃশ্য মনে পড়ল। ছোটবেলায় দেখতাম, কেউ কেউ, অতি পারদর্শী, চুইংগাম দিয়ে বেলুন বানানোর মতো, লুঙ্গি দিয়ে পানিতে ফুটবল বানাতে পারতেন।
বিদেশিরা লুঙ্গির একটা গুণে মুগ্ধ, তা হলো এর এয়ারকন্ডিশনিং ক্ষমতা। আমাদের মতো আর্দ্র দেশের জন্য যা বিশেষভাবে উপকারী।
এত যে উপকারী লুঙ্গি, তা দেশ থেকে উঠে যাবে! সম্প্রতি আমি একটা অজপাড়াগাঁয়ে গিয়েছিলাম। রাতের বেলা সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। দেখা গেল, সব তরুণের পরনে জিনসের প্যান্ট। লুঙ্গি পরে আছেন হাতে গোনা দু-একজন বৃদ্ধ। এভাবে দেশ থেকে লুঙ্গিকে আমরা হারিয়ে যেতে দেব?
আপনারা বলতে পারেন, ভাইরে, আপনার সমস্যা কী। দেশে এত সমস্যা থাকতে আপনি লুঙ্গি নিয়ে পড়লেন কেন? এর উত্তর দুইটা। এক. আমরা বহুদিন অপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে রগড় করার বা কথা বলার অবকাশ পাইনি। গত দুই বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ আমাদের পার করতে হয়েছে পেট্রলবোমার দুর্বিষহ আতঙ্কে। আমাদের বলতে হয়েছে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা, প্রয়োজনীয় কিন্তু নিষ্ফল। এই জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ আমাদের দিচ্ছে শান্তির আশ্বাস। মানুষ যখন শান্তিতে থাকে, স্বস্তিতে থাকে, তখন সে প্রয়োজনের বাইরে তার সময় ও মনোযোগ দিতে পারে, সেটাতেই মানুষ হয়ে ওঠে মানুষ। কবিতা, গান, গোলাপ ফুল ফোটানো কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস নয়। এগুলো মানুষ খায় না, মাথায় দেয় না। কিন্তু এগুলোই মানুষকে পশুর চেয়ে উন্নত হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। আমরা যে লুঙ্গি নিয়ে কথা বলতে পারছি, এর মানে হলো, আমরা এখন অনেকটাই স্বস্তিতে আছি।
দ্বিতীয় উত্তরটা হলো, ভূমিকম্প। আমার এক বন্ধু ভূমিকম্পের সময় কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় থাকেন। তারপর লুঙ্গির বদলে প্যান্ট পরতে শুরু করেন। ততক্ষণে ভূমিকম্প থেমে যায়। এখন থেকে তিনি সর্বদা প্যান্ট পরেই থাকবেন। বলা যায় না, কখন আবার ভূমিকম্প আসে।
আমি তাঁকে বলি, বাংলাদেশে ছয়জন মারা গেছে ভূমিকম্পে—হার্ট অ্যাটাকে, কিংবা পায়ের নিচে পড়ে। আহত হয়েছেন অনেকেই, কেউবা চারতলা থেকে লাফ দিয়ে, কেউবা সিঁড়িতে আছাড় খেয়ে। কাজেই ভূমিকম্প এলে দৌড়ানোর কোনো মানে হয় না। সে ক্ষেত্রে লুঙ্গি পরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কারণ, লুঙ্গি পরা থাকলে মাথা ঠান্ডা থাকে।
তাই ভাবছি, একটা এনজিও প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। তার উদ্দেশ্য হবে, দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাকগুলো সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টি। বিলুপ্তপ্রায় লুঙ্গির গৌরবের দিন ফিরিয়ে আনা হবে এর মিশন। এর নাম দেওয়া যেতে পারে, লুচক। লুঙ্গি চর্চা কেন্দ্র। ঠিকভাবে প্রজেক্ট প্রপোজাল লিখতে পারলে বিদেশ থেকে ডোনেশন পাওয়া কঠিন কিছু হবে না। তাতে দেশে লুঙ্গির ঐতিহ্য ফিরে আসুক আর না আসুক, কিছু লোকের কর্মসংস্থান ও আমার এক বা একাধিক ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ির সংস্থান তো হবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।