শকুন অশুভর প্রতীক নয়

দশক দুই-তিন আগেও আমাদের দেশে সহজেই শকুনের দেখা মিলত। মৃত গবাদিপশু খাল বা মাঠে পড়ে থাকলে আকাশে শকুনের ঝাঁক চক্কর খেতে দেখা যেত। তারা দল বেঁধে নেমে আসত। সেসব দলে দেখা যেত নানা জাতের শকুন। যেমন, ‘রাজ শকুন’, ‘সরু-ঠোঁট শকুন’, ‘বাঙলা শকুন’; হিমালয় বা তিব্বত অঞ্চল থেকে আসা হিমালয়ান গৃধিণী’, মঙ্গোলিয়া থেকে উড়ে আসা ‘ইউরেশীয় গৃধিণী’ ইত্যাদি।

এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৮০ সালে ভারত উপমহাদেশে প্রায় ৪ কোটি শকুন বাস করত। তারা বছরে মৃত গবাদিপশু ও অন্যান্য প্রাণীর দেহ থেকে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টন মাংস খেয়ে প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় সহায়তা করত। একই সময়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডেও কয়েক লাখ শকুনের বাস ছিল এবং তারাও প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে মৃত প্রাণী খেয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে আসছিল।
১৯৯০-এর দশক থেকে দ্রুত শকুনের সংখ্যা কমতে থাকে; এতে বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ শুরু হয়। শকুনের সংখ্যা কমতে কমতে এখন এই উপমহাদেশে মাত্র কয়েক হাজারে ঠেকেছে। বাংলাদেশে আছে মাত্র কয়েক শ। এ দেশের তিন প্রজাতির শকুনের মধ্যে ‘রাজ-শকুন’ ইতিমধ্যে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে। ‘বাঙলা শকুন’ ও ‘সরু-ঠোঁট শকুন’ টিকে আছে আবাসিক পাখি হিসেবে। একসময় সারা দেশে যাদের সহজে দেখা মিলত, সেই বাঙলা শকুনের সংখ্যা এখন ৫০০-রও কম। বৃহত্তর সিলেট ও খুলনা অঞ্চলের কিছু এলাকায় এদের দেখা মেলে। আইইউসিএনের গবেষণা বলছে, শকুন একটি মহাবিপন্ন পাখি। এই বিপন্নতার অন্যতম কারণ গবাদিপশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রফেন নামের ওষুধের ব্যাপক ব্যবহার। এটা রোধ করা না গেলে বাংলাদেশ থেকে শকুন চিরতরে হারিয়ে যাবে।
শকুনের সংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়ার ফলে পশুর মৃতদেহ থেকে প্রকৃতিতে দূষণ ছড়াচ্ছে। শকুনের খাবার খাচ্ছে শিয়াল ও কুকুর। মানুষ ও গবাদিপশুর মধ্যে জলাতঙ্ক, অ্যানথ্রাক্স, খুরা রোগ, কলেরাসহ নানা ধরনের সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। মৃত গবাদিপশু খেয়ে কুকুরের দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটছে এবং লোকালয়ে রোগবালাইয়ের সংক্রমণ বেড়েছে।
আমাদের দেশের আবাসিক পাখি শকুনের বিলুপ্তির আশঙ্কা সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। এ ক্ষেত্রে বন বিভাগের সঙ্গে আইইউসিএন বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। সরকার ২০১০ সালে ডাইক্লোফেনাক-জাতীয় ওষুধ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। অতি সম্প্রতি কিটোপ্রফেন-জাতীয় ওষুধ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০১৩ সালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘বাংলাদেশ জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে
এ দেশের ৪৭ হাজার ৩৮০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় শকুনের জন্য দুটি ‘নিরাপদ এলাকা’ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। বৃহত্তর সিলেট ও খুলনা-বরিশালে শকুনের নিরাপদ এলাকায় শকুন সংরক্ষণ দলের নানামুখী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। গত সপ্তাহে আমার সুযোগ হয়েছিল হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে শকুন সংরক্ষণ নিয়ে বন বিভাগ-আইইউসিএনের কিছু তৎপরতা দেখার।

>শকুন সংরক্ষণ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এ অঞ্চলে বাঙলা শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়া ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। স্থিতি নিশ্চিত হয়েছে

হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থেকে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তসংলগ্ন রেমা-কালেঙ্গা বনে যেতে আমরা বেছে নিয়েছিলাম উঁচু-নিচু টিলা-পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া পথ। রেমা-কালেঙ্গার সংরক্ষিত প্রাকৃতিক বন দেশের অন্যতম বড় বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য। পাতা ঝরা এই সবুজ প্রাকৃতিক বন প্রায় ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। ভোরের ঘন কুয়াশার মধ্যেই খোয়াই নদীতে খেয়ানৌকায় পাড়ি দিয়ে যখন আমরা বনে পৌঁছাই, তখন গাছের ডালে ও আকাশে শকুন দেখতে পাই। আইইউসিএনের শকুন সংরক্ষণ কর্মসূচির অধীনে বনের ভেতর শকুনের নিরাপদ খাবার হিসেবে মৃত বা জবাই করা গরু সরবরাহ করা হয়েছে। শকুনেরা এসে সেগুলো খেয়ে খেয়ে উড়ে গিয়ে গাছের ডালে বসছে, কিংবা মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। অবশ্য প্রকৃতিতে পাওয়া খাবারেও সেখানকার শকুনদের অরুচি নেই।
রেমা-কালেঙ্গার বনে গর্জন, চাপালিশ, ডুমুর, মেহগনি, শিমুল, বাঁশ প্রভৃতি গাছপালার বিচিত্র সমাহার এখনো আছে। এই প্রাকৃতিক পরিবেশ অসংখ্য পশুপাখির নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে বহাল রয়েছে। এই বনের ভেতর দিয়ে চলতে পথ হারানো বিচিত্র নয়। উঁচু গাছপালা ও প্রাকৃতিক খাবার থাকায় এখানে হনুমান-বানরের দল গাছে গাছে হুটোপুটি খায়। মানুষ বা অচেনা প্রাণী দেখে নিরাপদ উচ্চতায় উঠে গিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। অসংখ্য পাখি বিরতিহীন ডেকে যায় নিজের খেয়ালে। বাঙলা শকুন দেশের অন্যত্র বিলুপ্ত হলেও এ বনে নিরাপদে বাসা বাঁধে, ডিমে তা দিয়ে ছানা ফোটায়, তাদের আহার জোগায়, লালন-পালন করে। বনের উঁচু গাছের ডালে শকুনের বাসায় ছানার সঙ্গে মা-শকুনের বসে থাকা দেখে মনে হলো, ওরা এখনো এ বনকে নিরাপদ ভাবছে।
চুনারুঘাট থেকে পেশাগত কাজে রেমা-কালেঙ্গা বনে সফরে আসা সহকারী বন সংরক্ষক হাছানুর রহমানের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বললেন, শকুন সংরক্ষণ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এ অঞ্চলে বাঙলা শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়া ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। স্থিতি নিশ্চিত হয়েছে। রেমা চা-বাগানের ব্যবস্থাপক ও রেমা-কালেঙ্গার শকুন সংরক্ষণ দলের সদস্য নির্মল চন্দ্র দেব একসময় বিশ্বাস করতেন শকুন অশুভর প্রতীক। কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছেন এ ধরনের বিশ্বাসের কোনো ভিত্তি নেই। তিনি এখন বন্য প্রাণী ও শকুন সংরক্ষণের কাজে তাঁর চারপাশের লোকজনকে নিয়ে সক্রিয় অংশ নিচ্ছেন। শকুনের প্রতি স্থানীয় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও তাঁদের সচেতন অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রকৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শকুন সংরক্ষণে সাফল্যের আশা জাগছে।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।