শরণার্থীদের সঙ্গে নিয়েই হোক সবুজ বাংলাদেশ

২০১৯ সালে শরণার্থীশিবির (বাঁয়ে), ২০২০ সালে সেখানে গাছ রোপণের পর (ডানে)
ছবি: ইউএনএইচসিআর

প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কম উচ্চতা ও জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে দেশটি ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে একটু বেশিই ঝুঁকিতে রয়েছে। এরপরও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সফলতার এক অনন্য উদাহরণ বাংলাদেশ। এখানে মানুষ প্রতিনিয়তই আরও বেশি সচেতন হচ্ছে; আছে সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত বিনিয়োগ।

কক্সবাজারে বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থীশিবিরে ৩৪টি ক্যাম্পে ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এত বড় শরণার্থীশিবিরের কারণে পরিবেশগত কিছু ঝুঁকি রয়েই যায়। ২০১৭ সালে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় হয় একটি ন্যাচারাল ফরেস্ট রিজার্ভ, অর্থাৎ প্রাকৃতিক বনের মধ্যে। ছয় হাজার বর্গমিটার বিস্তৃত এলাকাটি। অতি স্বল্প সময়ে অভূতপূর্বভাবে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আগমনের পর তাদের আশ্রয় দিতে প্রচুর গাছপালা কেটে ফেলতে হয়েছিল। পাশাপাশি শরণার্থীদের প্রতিদিনের রান্নার জন্য লাকড়ির প্রয়োজন ছিল। ফলে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ গাছ কাটা হচ্ছিল। এতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভূমিধস ও বন্যার মতো সমস্যার ঝুঁকি বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে আছে বাংলাদেশ ও এ অঞ্চলের প্রধান পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ—বন উজাড় হয়ে যাওয়া বা ডিফরেস্টেশন।

শরণার্থীশিবিরে প্রাকৃতিক পরিবেশের পুনর্নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরসহ অনেকে মিলে একসঙ্গে কাজ করছে। ঘূর্ণিঝড়, মৌসুমি বৃষ্টিপাত, ভূমির গুণগত মান হ্রাস, ভূমিক্ষয় ও বন উজাড়ের ব্যাপারে স্থানীয় বাংলাদেশি ও শরণার্থীদের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। তিন হাজারের বেশি বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে তাঁরা গাছের নার্সারির পরিচর্যা, বীজের যত্ন ও বীজ রোপণ এবং নতুন ছোট গাছগুলো আগলে রাখতে পারেন। ইউএনএইচসিআরের সহযোগিতায় এই প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁরা ইতিমধ্যে ৬০০ হেক্টরের বেশি জায়গাজুড়ে গাছ রোপণ করেছেন। বর্জ্যপানির শোধন ও দূষণের মাত্রা কমানোর জন্য নির্দিষ্ট অনেক জায়গায় ঘাসও লাগিয়েছেন।

স্বেচ্ছাসেবকদের কাজের মধ্যে আরও রয়েছে ভূমিধসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গাছগুলোকে আবার রোপণ করা, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের চিরহরিৎ বনাঞ্চল রক্ষার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে তাদের নিজস্ব কমিউনিটির মধ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধি। প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবকেরা দুর্যোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য অনেক কাজ করেন, যেমন বর্ষাকালে ভূমিক্ষয় ও ভূমিধস প্রতিরোধে ক্যাম্পের সব ঢাল বাঁধাইকরণ।এই পূর্ণ বনায়ন প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার। বিনা মূল্যে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস, অর্থাৎ এলপিজি বিতরণ করা হয়েছে স্থানীয় ও শরণার্থী উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে। এ বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের আগে প্রতিদিন উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী ও স্থানীয় জনগণের রান্না ও অন্যান্য কাজের জন্য প্রতিদিন ৭০০ টন লাকড়ির প্রয়োজন হতো।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ইউএনএইচসিআর ও জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম ৭০০ মিলিয়ন কিলোগ্রামের বেশি এলপিজি বিতরণ করেছে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বাংলাদেশিদের মধ্যে। এর ফলে বন উজাড় করা বন্ধ হয়েছে। স্থানীয়দের লাগানো গাছ থেকে শরণার্থীদের লাকড়ি সংগ্রহ করতে হচ্ছে না বলে দুই পক্ষের মধ্যে টানাপোড়েন কমেছে। রান্নার পেছনে অতিরিক্ত সময় নষ্ট না হওয়ায় বাচ্চাদের পড়াশোনা, বাগান করাসহ বিভিন্ন কাজে পরিবারকে বেশি সময় দিতে পারছেন নারীরা। এলপিজি ব্যবহারের কারণে ঘরের ভেতরে এখন আর ধোঁয়া হয় না। তাই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিষাক্ত গ্যাসও এখন থাকে না ঘরের ভেতর। আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, নারীর প্রতি সহিংসতার ঝুঁকিও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। কারণ, এর আগে অনেক নারীকেই একা একা বনে যেতে হতো, এমনকি কখনো কখনো সন্ধ্যার পরও লাকড়ি খুঁজতে হতো।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সরকার, স্থানীয় বাংলাদেশি, শরণার্থী ও মানবিক কার্যক্রমে জড়িত সংগঠন—সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা, দায়িত্ব পালন ও উদ্যোগ সবার জন্য সমানভাবে উপকারী হতে পারে। এর মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের সক্ষমতা গড়ে উঠবে এবং তাদের মাধ্যমে পুরো কমিউনিটির ভেতরে জনসচেতনতা গড়ে তোলা যাবে। এভাবেই সবার জন্য একটি উত্তম ভবিষ্যৎ তৈরি করা সম্ভব।

বিখ্যাত ও বিপন্ন এশিয়ান হাতির আবাসস্থল হিসেবে কক্সবাজারের বনভূমি সুপরিচিত। এখন পর্যন্ত দুই লাখের বেশি স্থানীয় বাংলাদেশি ও শরণার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে হঠাৎ হাতির মুখোমুখি পড়ে গেলে কী করতে হবে, তার ওপর। পাশাপাশি ১০০টি এলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম গঠন ও প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। যাদের কাজ হচ্ছে হাতির মুখোমুখি হয়ে পড়লে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এটি বেশ সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১৭ সালে আকস্মিক হাতির আক্রমণে মৃত্যু হয়েছিল ১৪ জনের, আর ২০১৮ থেকে এখন পর্যন্ত এ কারণে কেউ মারা যায়নি। আরেকটি কথা না বললেই নয়, খুব সম্প্রতি ১০টি হাতির বাচ্চার জন্ম হয়েছে এবং এটি বিপন্ন প্রজাতির হাতি রক্ষায় একটি বড় সাফল্য।

ঘূর্ণিঝড়ের মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রেহাই পেতে দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিকে ‘সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ডনেস ভলান্টিয়ার’ হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়েছি আমরা। তাঁরা প্রতিকূল আবহাওয়ায় সতর্কতামূলক পতাকা উত্তোলন করে, শিশু-বৃদ্ধসহ ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের দুর্যোগের সময় অন্যত্র সরিয়ে নেয় এবং ভূমিধস হলে প্রথম থেকেই উদ্ধারকাজে লেগে যেতে পারে। এই প্রশিক্ষণ কমিউনিটিগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দুর্দান্তভাবে সক্ষম করে তুলেছে। আর এতে অনেক জীবন বাঁচানো গেছে। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এভাবেই রোহিঙ্গা শরণার্থী ও স্থানীয় বাংলাদেশিদের সক্ষম করে তুলছি আমরা।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সরকার, স্থানীয় বাংলাদেশি, শরণার্থী ও মানবিক কার্যক্রমে জড়িত সংগঠন—সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা, দায়িত্ব পালন ও উদ্যোগ সবার জন্য সমানভাবে উপকারী হতে পারে। এর মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের সক্ষমতা গড়ে উঠবে এবং তাদের মাধ্যমে পুরো কমিউনিটির ভেতরে জনসচেতনতা গড়ে তোলা যাবে। এভাবেই সবার জন্য একটি উত্তম ভবিষ্যৎ তৈরি করা সম্ভব।

কপ ২৬ সারা বিশ্বকে আবার মনে করিয়ে দিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার কথা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ও বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীকে দক্ষভাবে প্রস্তুত করা এবং তাদের সক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এর পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রণীত বিভিন্ন আইনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সব কাজে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর অর্থবহ অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বকে আমরা উৎসাহিত করি এবং স্বাগত জানাই।

কক্সবাজারের প্রকৃতিকে আবার ভালোভাবে গড়ে তোলার জন্য আমরা কাজ করে যাব। আমরা বাংলাদেশের পাশে আছি, যেন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সরকার কাজ করতে পারে এবং বাংলাদেশের উদ্ভাবনী পদক্ষেপগুলো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারে।

ইয়োহানেস ভন ডার ক্লাও ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশের প্রতিনিধি