শিক্ষার্থীরা কখন গলায় দড়ি পরতে চান

অবশেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নামের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙেছে। তারা প্রথমে সংবাদ সম্মেলন করে বলল, আগামী ১২ জুন পর্যন্ত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এর আগে ২৯ মে পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এর কিছুক্ষণ পরই শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়ে দিলেন, ১৩ জুন থেকে স্কুল-কলেজ খোলা থাকবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়টি নির্ভর করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের টিকা দেওয়ার ওপর। একই দিন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন ১৩ জুন থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

১৫ মাস ধরে দেশের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এতে সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা ব্যাহত হলেও যারা ‘শিক্ষার মা-বাপ’ বলে পরিচিত, তাদের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের অটো পাস দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা নতুন বই পেলেও ক্লাসে যেতে পারেনি। বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুরু থেকে নির্বিকার।

গত বছরের শেষ দিকে সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার লক্ষ্যে রোডম্যাপও দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যেতে পারে। প্রথমে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা ক্লাসে যাবে। এরপর অন্যরা। সেই রোডম্যাপ আর বাস্তবায়িত হয়নি। চলতি বছরের শুরুতে নতুন করে সময়সূচি ঘোষণা করা হলো। পলিটেকনিকসহ বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষাও চলছিল। বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা হল-ছাত্রাবাস খোলার দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে সরকার নতুন সময়সূচি ঘোষণা করে। কিন্তু এখানেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় তুঘলকি সিদ্ধান্ত নেয়। আগে স্কুল খুলবে। এরপর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। হওয়ার কথা ছিল উল্টো। অনেকের অভিযোগ, আন্দোলনহীন দেশে সরকার ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে তখন গড়িমসি করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হল খোলা ও পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েও পিছিয়ে আসে।

আমাদের শিক্ষা বিচিত্রমুখী—সাধারণ শিক্ষা, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা। আবার মাদ্রাসাও দুই ভাগে বিভক্ত। আলিয়া মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসা। শিক্ষায় যে বৈষম্য ছিল, করোনা তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে পরীক্ষা-ক্লাস হচ্ছে। প্রতি সেমিস্টারে শিক্ষার্থীও ভর্তি করা হচ্ছে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যায়ে প্রকৃত অর্থে শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার চেষ্টা সফল হয়নি। মধ্যম আয়ের দেশের শিক্ষাবান্ধব সরকার একটি ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোন কেনার জন্য সামান্য ঋণ দিতেও অপারগ। করোনার কারণে সরকার শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু করছেন না। প্রতিদিনই পত্রিকায়, টিভিতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের আকুতির কথা পড়ি। তাঁরা সরকারের কাছে কোনো আর্থিক সহায়তা চান না। চান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হোক। দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় অনেকের পড়াশোনা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

এখানে আরেকটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, করোনার কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকলেও সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট উপাচার্যদের নিয়োগ-বাণিজ্য বন্ধ নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুস সোবহান মেয়াদের শেষ দিনে ১৪১ জনকে নিয়োগ দিয়ে ‘কৃতিত্ব’ জাহির করেছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম কীর্তিমান ব্যক্তি আরও অনেক আছেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ছাত্রদের আন্দোলনে মদদ দেওয়ার অভিযোগে তিন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করেছিলেন।

সরকারের দাবি, তরুণ প্রজন্মই দেশ ও জাতির ভরসা। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের আচরণে তার প্রতিফলন নেই। বরং তরুণদের ন্যায্য আন্দোলনকেও বাঁকা চোখে দেখা হয়। শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনে আমরা তা দেখেছি। কিশোর-তরুণদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও।

তরুণ প্রজন্ম সম্পর্কে প্রায়ই নেতিবাচক কথাবার্তা শুনি। কিন্তু এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে এই তরুণেরা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই তরুণেরাই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাঁরা। বাংলাদেশে একসময়ে শিক্ষার্থীরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে আন্দোলন করতেন। ছাত্রসংগঠনগুলো যেকোনো অজুহাতে ধর্মঘট ডাকত। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হতেন। আর এখন সেই শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষার দাবিতে মানববন্ধন করছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। এটি খুবই আনন্দের কথা।

গত সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করে স্লোগান তুলেছেন ‘ছাত্রসমাজকে বাঁচান’, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিন’, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিন, নয় তো গলায় দড়ি দিন’।

মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, দীর্ঘদিন হল ও ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় বিভিন্ন কারণে আমরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছি। একসময় আমাদের মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। তাই হল-ক্যাম্পাস খুলে দিন, নয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করে আমাদের দড়ি দিন, আমরা সেই দড়ি গলায় দিয়ে আত্মহত্যা করব।

চোখের সামনে দেখছি ১৪ মাস ধরে ঘরবন্দী এসব তরুণের অসহায় চেহারা ও বেদনার্ত মুখ। কতটা বিপন্ন হলে এ শিক্ষার্থীরা সরকার বা কর্তৃপক্ষের কাছে ‘গলায় দেওয়ার জন্য দড়ি চাইতে পারেন’। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় এই শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া বন্ধ। সরকার বারবার ছুটি বাড়িয়ে চলেছে। আর শিক্ষার্থীদের অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
তাই নিরুপায় হয়ে শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছেন। তাঁদের কথা হলো, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যেও যদি মার্কেট খোলা থাকতে পারে, বাস-ট্রেন-লঞ্চ চলতে পারে, রেস্তোরাঁ-হোটেল খোলা থাকতে পারে, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ থাকবে? সরকার বলছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে হোটেল-রেস্তোরাঁ খোলা থাকবে, গণপরিবহন চালু থাকবে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন খোলা হবে না? গণপরিবহন ও হোটেল–রেস্তোরাঁর কর্মীদের চেয়ে কি শিক্ষার্থীরা কম সচেতন?

এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বলেন, ‘আমরা মাঠপর্যায়ে গবেষণা করে সুপারিশ করেছিলাম পর্যায়ক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার জন্য। অন্তত পার্বত্য চট্টগ্রামসহ যেসব অঞ্চলে করোনার সংক্রমণ কম, সেসব এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আগে খোলা যেত। আমরা সুপারিশ করেছি নভেম্বরে। তখন সংক্রমণ সারা দেশেই কম ছিল। সরকার সে সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিলে পরবর্তীকালে সংক্রমণ বাড়লে আবার বন্ধও করতে পারত। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মানানো সহজ ছিল। শিক্ষার্থীদের ভাগ করে ক্লাসে আনা যেত। কিন্তু সরকার কোনো সুপারিশই আমলে নেয়নি। আমরা বলেছিলাম বাস্তবতার ভিত্তিতে স্থানীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কিন্তু সরকার সবকিছু কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও তো করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকানো যায়নি।’

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা কথায় কথায় ভারত-পাকিস্তানের উদাহরণ টানেন। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশেই করোনার মধ্যে সীমিত পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ কেবল বাংলাদেশে। যদিও ওই সব দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি।

শিক্ষা বিভাগের অতি বিজ্ঞ কর্মকর্তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না খোলা নিয়ে কানামাছি খেলছেন। একবার বলছেন, খোলা হবে। আরেকবার বলছেন, বন্ধ থাকবে। আগে বলা হয়েছিল, টিকা দেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে আনা হবে। এখন তো টিকাই নেই। তাহলে কি টিকা না আসা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের বাইরে রাখা হবে? যেখানে অন্যান্য দেশ টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিয়েছে, সেখানে আমরা তাঁদের তালিকার পেছনে রেখেছি কোন যুক্তিতে?

অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবিতে একযোগে মানববন্ধন করেছেন দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় উদ্বেগ জানিয়েছেন অভিভাবকেরা। তাঁরা বলেছেন, করোনাভাইরাসের দোহাই দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা চলবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা আর শিক্ষার্থীদের ‘গলায় দড়ি’ দেওয়া বা আত্মহত্যার মধ্যে কোনো ফারাক দেখছেন না তাঁরা।
কেবল ঢাকা নয়, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, কুমিল্লা, দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, গাজীপুরসহ দেশের সব স্থানেই শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে আন্দোলন করছেন। বিলম্বে হলেও শিক্ষার অভিভাবকেরা তাঁদের দাবি মেনে নিয়েছেন। কিন্তু ১৫ মাসের ক্ষতি পূরণে তাদের কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]