শিশুদের শারীরিক শাস্তি বিলোপের জন্য যা করতে হবে

সন্তানকে জীবনে অন্তত একবার প্রহার করার প্রয়োজন আছে কি না—সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন একটি প্রশ্ন করলেন একজন। অনেকে মা-বাবাই এর পক্ষে মন্তব্য করেন। শিশুদের ‘শেখানো’ থেকে শুরু করে নিজেদের হতাশা ইত্যাদি কারণে তাঁরা শাস্তির সমর্থন করেন। আমরা কি এমন একটি প্রকাশ্য আলোচনার কথা ভাবতে পারি, যেখানে কোনো গোষ্ঠীকে আঘাত করার ‘যুক্তি’ দেওয়া হচ্ছে? তবে কেন আমরা শিশুদের ক্ষেত্রে এটি মেনে নিচ্ছি?

৩০ এপ্রিল শিশুদের শারীরিক শাস্তি বিলোপের আন্তর্জাতিক দিবস। শারীরিক শাস্তি বলতে এমন শাস্তি বোঝায়, যেখানে কোনো না কোনো মাত্রার ব্যথা বা অস্বস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে শারীরিক বল প্রয়োগ করা হয়। নিষ্ঠুর ও অবমাননাকর আচরণ এ ধরনের শাস্তির অন্তর্ভুক্ত।

শাস্তি শিশুর মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে এবং শিশু অধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন। বিশ্বে ২ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে প্রায় চারটি বাড়িতে একধরনের সহিংসতার শিকার হয়, যা করা হয় ‘শৃঙ্খলা’র নামে (হিডেন ইন প্লেন সাইট: আ স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যানালিসিস অব ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট চিলড্রেন, ইউনিসেফ, ২০১৪)। বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করতে ২০১১ সালে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

তারপরও শিশুরা শিক্ষকদের দ্বারা মারধর ও অপমানের শিকার হচ্ছে। তা ছাড়া বাড়ি, প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রসহ অনেক জায়গায় শিশুদের শাস্তি দেওয়া হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৮৯ শতাংশ শিশু জরিপপূর্ববর্তী এক মাসের মধ্যে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে। প্রতিনিয়ত ঘরে–বাইরে অসংখ্য শিশুকে নির্যাতন ও অপমান সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছে। আমরা কি শুনছি তাদের নীরব কান্না?

২০১৩ সালে ‘গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ টু এন্ড অল করপোরাল পানিশমেন্ট অব চিলড্রেন’ ১৫০টির বেশি গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করে, শারীরিক শাস্তি শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর। তারপর আরও বৈজ্ঞানিক গবেষণা শাস্তির নেতিবাচক দিক তুলে ধরেছে।

শাস্তি শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, বিকাশ ও শিক্ষাকে প্রভাবিত করে এবং মা-বাবা ও সন্তানের সম্পর্কের ক্ষতি করে। যারা শৈশবে শাস্তির শিকার হয়, তাদের অনেকেই বড় হওয়ার পর শিশুদের শাস্তি ও গার্হস্থ্য সহিংসতা মেনে নেয়। আমরা যদি শিশুদের শাস্তি দেওয়া বন্ধ না করি, তাহলে সমাজে নির্যাতনের চক্র ভাঙা সম্ভব হবে না।

বড়রা যখন শিশুদের কিছু শেখানোর নামে মারধর অথবা বকাবকি করেন, তখন শিশুরা শুধু শাস্তি এড়ানোর জন্যই কোনো আচরণ করতে শেখে। কিন্তু তারা এর কারণ উপলব্ধি করে না। এর ফলে পরে তারা পুনরায় একই আচরণ করে। শেখানোর কৌশল হিসেবে শাস্তি একটি অকার্যকর পদ্ধতি।

শাস্তি এত ক্ষতিকর জানার পরও এটি অনেক দেশেই বৈধ। ৬২টি দেশ সব ক্ষেত্রে (বাড়ি, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, বিকল্প শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি) শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করেছে। এখনো বিশ্বের ৮৭ শতাংশ শিশু আইন দ্বারা শাস্তি থেকে সুরক্ষিত নয়। এর মধ্যে বাংলাদেশি শিশুরাও আছে।

যখন এমন একটি ব্যবস্থা থাকে, যেখানে বয়স্কদের আঘাত করা আইনের চোখে অপরাধ, কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে তা গ্রহণযোগ্য, তখন আইনটি শিশুর প্রতি বৈষম্যমূলক। এর মানে শিশুদের সমান আইনি সুরক্ষা নেই। কোভিড–১৯ মহামারি অসংখ্য শিশুর নিজ পরিবারের মধ্যেই সহিংসতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।

তাই সব ক্ষেত্রে শাস্তি বিলোপ করে আইন করা আরও জরুরি হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ, লাইবেরিয়া, পাপুয়া নিউগিনিসহ বিভিন্ন দেশের কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন করতে চাইলে তীব্র বাধা আসে। সাধারণ মানুষ থেকে নীতিনির্ধারক—অনেকেই বলেন, মা-বাবা ও শিক্ষক কর্তৃক শাস্তি সমাজে বহুদিন ধরেই চলে আসছে এবং এটি একটি সাধারণ চর্চা।

কোনো কিছু পুরোনো বলেই সমর্থন করা যায় না, যদি তা মানুষের ক্ষতির কারণ হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক রীতিনীতির ও পরিবর্তন ঘটে। কল্যাণকর ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন; ক্ষতিকর প্রথার অবসান জরুরি।

কেউ কেউ মনে করেন, অনেক মা-বাবাকে প্রতিকূল পরিবেশে সন্তানদের বড় করতে হয়। মাত্রাতিরিক্ত ছাত্রছাত্রী ও প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব থাকায় প্রায়ই শিক্ষকদের চাপের মধ্যে থাকতে হয়। এসব কারণে তাঁরা শাস্তি প্রয়োগ করেন। বেশির ভাগ সময়ই শাস্তির ঘটনা ঘটে বয়স্কদের ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবনের হতাশা থেকে। বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে আরও উপকরণ ও সহায়তা প্রয়োজন।

কিন্তু বড়রা জটিলতার সম্মুখীন হলে শিশুদের মারধর অথবা অপমানজনক আচরণ করা কখনোই উচিত নয়। শাস্তির পক্ষে অজুহাত দেওয়া সমাজে শিশুদের অধস্তন অবস্থা তুলে ধরে। এটি বন্ধ করতে হবে।

মা-বাবার বিরুদ্ধে মামলা করা বা তাঁদের অপরাধবোধে ভোগানো নয়, সব ক্ষেত্রে শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইনের প্রাথমিক লক্ষ্য সমাজকে স্পষ্টভাবে জানানো যে শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা মেনে নেওয়া হবে না। গবেষণায় জানা যায়, আইন সংস্কারের ফলে শাস্তি নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর মাত্রা কমতে থাকে। সুইডেন, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড ও রোমানিয়ায় এটি ঘটেছে।

শিশুদের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশু নির্যাতন অবসানে বিশ্বকে যদি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ১৬.২ পূরণ করতে হয়, তবে শারীরিক শাস্তি বিলোপ অপরিহার্য। নিম্নলিখিত উপায়ে তা করা সম্ভব:

বাংলাদেশসহ যেসব রাষ্ট্র এখনো আইন করেনি, তাদের সব ক্ষেত্রে শিশুদের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করে ২০৩০ সালের মধ্যে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। পাশাপাশি নীতিমালা, কর্মসূচি ও জনসচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে আইনি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা এবং এর বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন।

শিশুদের বিষয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এনে একটি শিশু–সংবেদনশীল সমাজ গড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
শাস্তি না দিয়ে ইতিবাচকভাবে শিশুদের বড় করা ও শিক্ষাদান সম্পর্কে মা-বাবা ও শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। পরিবার ও শিশুদের নিয়ে বা তাদের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সমাজসেবা খাতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলোয় এ–সংক্রান্ত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।

শিশুদের মতামতকে সম্মান করে শাস্তি বন্ধের প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে তাদের কথা শোনা সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবার দায়িত্ব।

শিশুরা বয়সে ছোট এবং বড়দের ওপর নির্ভরশীল। এ জন্য তাদের কম নয়, বরং বেশি সুরক্ষার প্রয়োজন। সহিংসতামুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের অধিকার এবং সমাজের জন্য মঙ্গলজনক। আমাদের আর কত দিন লাগবে সহজ এ বিষয় বুঝতে যে শাস্তি সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য? আসুন, শিশুদের শাস্তি বিলোপে সোচ্চার হই, তাদের সম্মান দিতে শিখি।

লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী