সংকটে পুরো আফগানিস্তান

বহু বছর ধরে আফগানিস্তানে নানা সহিংসতা চলে এলেও দেশটির রাজধানী কাবুল আপেক্ষিকভাবে নিরাপদই ছিল। কিন্তু বুধবার সকালে সেখানে যে ভয়ংকর বোমা বিস্ফোরিত হলো, তাতে এটা নিশ্চিত, শহরটি এখন আফগানিস্তানের অন্যতম বিপজ্জনক এলাকা। এটা আফগানিস্তানের দুর্বল ও ভঙ্গুর সরকারের জন্য এক বড় ঝাপটা।

কাবুলে হামলার সংখ্যা বাড়ছে, হুমকি হিসেবে যেটা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ভঙ্গুর অর্থনীতি ও বিদেশি সাহায্যকারীদের জন্যও এটা সামলানো কঠিন। এটা সবারই জানা যে বিদেশি সহায়তাই কার্যত আফগানিস্তানকে টিকিয়ে রেখেছে। রাজধানী শহর হিসেবে দেশটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের বসবাসও এই শহরে, এই হুমকি তাদেরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

এসব হামলায় বেসামরিক নাগরিকেরা সামঞ্জস্যহীনভাবে মারা পড়ছে। কারণ, শহরের অধিকাংশ সামরিক ও সরকারি স্থাপনাগুলো অত্যন্ত সুরক্ষিত। যদিও তিন বছর আগে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ‘লক্ষ্য অর্জনের’ ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং বারাক ওবামা বলেছিলেন, আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধের অবসান হয়েছে, কাবুলের কেন্দ্রস্থলের এই হামলায় এটা পরিষ্কার, সহিংসতার অবসান ঘটেনি।

তবে আর কোনো পশ্চিমা শক্তি সেখানে যুদ্ধের মাত্রা আবার বাড়াতে চায় বলে মনে হয় না, এমনকি মাঠের জেনারেলদের তরফে সেনার দাবি উঠলেও। অন্যদিকে সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় আমার দেখেছি, বিদেশি সেনারা কোনো দেশে দীর্ঘস্থায়ী ও প্রকৃত শান্তি আনতে পারে না। কিন্তু ইতিহাসের জ্ঞানসম্পন্ন কিছু কর্মকর্তা নেতাদের উপদেশ দিতে পারেন, তাঁরা যেন সরকারকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেন, তা সে যতই দুর্বল বা দুর্নীতিবাজ হোক না কেন।

১৯৮৯ সালে দেশটি থেকে রুশ সেনারা চলে যাওয়ার পর বিদেশি শক্তি মুখ ফিরিয়ে নিলে সেখানে মারাত্মক কোন্দল ও সহিংসতা শুরু হয়। এসব বিবাদ থেকেই তালেবানদের জন্ম হয়। তবে আজকের পৃথিবীতে যেখানে আইএস আছে এবং যেখানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আদর্শ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে আবারও আফগানিস্তানকে ভেঙে যেতে দেওয়া অপরিণামদর্শী হবে।

এই হামলার আগেই জাতিসংঘ সতর্ক করে দিয়েছিল, এ বছরটা পৃথিবীর যেকোনো জায়গার চেয়ে কাবুলের বেসামরিক মানুষের জন্য বেশি মারাত্মক। এমনকি আফগানিস্তানে বিদ্রোহের সূতিকাগার হেলমান্দ, কান্দাহার ও নানগাহারের চেয়ে কাবুলেই বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। অন্যদিকে এ বছরের এপ্রিল মাসে আফগানিস্তানে জাতিসংঘ মিশন বেসামরিক মানুষের সুরক্ষাবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘ভৌগোলিক কারণে কাবুলে আত্মঘাতীসহ নানা জটিল প্রকৃতির হামলা হচ্ছে, সে জন্য ওখানে বেশিসংখ্যক বেসামরিক মানুষ মারা যাচ্ছে।’

তবে রাজধানী শহরে ঠিক কী কারণে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, তা পরিষ্কার নয়। হামলাকারীরা অনায়াসে শহরে ঢুকে যাচ্ছে বা তারা বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করছে, সে কারণেই বেসামরিক মানুষ মারা পড়ছে কি না, তা নিশ্চিত নয়। অথচ আগে তারা সুরক্ষিত স্থাপনায় হামলা চালাত। অথবা হতে পারে সাধারণভাবে শহরের রক্ষকেরা প্রায়ই ব্যর্থ হচ্ছেন।

কিন্তু কারণ যা-ই হোক না কেন, এই মৃত্যু আফগানিস্তানের মতো একটি দরিদ্র ও অসহায় দেশের শান্তি বিঘ্নিত করছে। যে দেশটিতে আজ ৪০ বছর ধরে বিবদমান গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধ চলছে, অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে কখনো কখনো, কিন্তু যুদ্ধ কখনোই পুরোপুরি থামেনি। এখন আবার মনে হচ্ছে, আমরা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছি।

তালেবানদের হটানো ও বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দু অন্যদিকে চলে যাওয়ার পর কাবুল অনেকটা নিস্তরঙ্গই ছিল, যার সুরক্ষার দায়িত্বে ছিল আফগান ও পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। যাদের নিয়ে প্রায়ই হাসাহাসি করা হয়, সেই পুলিশও এর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জাতীয় নিরাপত্তার চেয়ে পরিবারের নিরাপত্তা প্রাধান্য দেওয়ায় তাঁদের সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু কাবুল রক্ষা করা সারা দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির নাগরিক সমাজ বড় হয়েছে। সেখানে নতুন স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় গজিয়ে উঠেছে। ফলে আফগান রাজধানী সহজেই এই অঞ্চলের সবচেয়ে স্পন্দনশীল গণমাধ্যম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, যদিও শহরটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য সুপরিচিত নয়। বুধবার সকালে স্যুয়ার ট্যাঙ্কারে লুকিয়ে আনা বোমা এই সবকিছুতেই আঘাত করেছে।

প্রাথমিকভাবে দূতাবাসের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু এক ব্যস্ত মোড়ে বিশালাকার গর্ত সৃষ্টি হয়েছে, যেখান থেকে টিভি স্টুডিও, নামকরা স্কুল, স্মার্ট হোটেল ও ছোট দোকানের সারি কয়েক শ মিটার দূরেই। যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে দুজন সরকারি কর্মকর্তা, বিবিসির গাড়িচালক ও টেলিভিশন চ্যানেল টোলোর যন্ত্রকারিগর আছেন।

আফগানিস্তানের প্রখ্যাত সাংসদ ওয়াঝমা ফ্রোগ বলেছেন, ‘এই হামলা কাবুলের শ্রমজীবীদের ওপর, যেসব টেলিকম, ব্যাংক, বেসরকারি কোম্পানি ও দূতাবাস আফগানিস্তানকে ভালো জায়গা বানানোর চেষ্টা করছিল, তাদের ওপর।’

এখন পর্যন্ত কোনো গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করেনি। আর আফগানিস্তানের প্রেক্ষাপটে এই লক্ষ্যবস্তু এতটাই অস্বাভাবিক যে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বিস্ফোরক জায়গামতো পৌঁছানোর আগেই বিস্ফোরিত হয়েছে। তবে কাবুলে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে এ পরিমাণ বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটলে এর চেয়ে কম মানুষ মারা পড়ত। এখন এই হামলার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, এই হামলার মধ্য দিয়ে কাবুল শহরের লাখ লাখ মানুষের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ল।

আইএসের তো বেসামরিক মানুষ মারতে বাধে না, আবার আফগানিস্তানে তাদের সংগঠনও বড় হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহটা তাদের ওপর গিয়েই পড়ছে। এটা যদি তারা করে থাকে, তাহলে বলা যায়, তাদের সক্ষমতা বাড়ছে।

তালেবানরা দ্রুতই এর দায় অস্বীকার করেছে। কিন্তু জাতীয় গোষ্ঠী হিসেবে সরকার গঠনের লক্ষ্যে তারা সমর্থন জোগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। আবার হামলার দায় স্বীকারের ক্ষেত্রে তাদের অতীত ইতিহাস নির্ভরযোগ্য নয়। অতীতে এমন হয়েছে যে হামলার সঙ্গে তাদের যুক্ত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকার পরও তারা দায় অস্বীকার করেছে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া।

এমা গ্রাহাম-হ্যারিসন: দ্য গার্ডিয়ানের আন্তর্জাতিক-বিষয়ক সাংবাদিক