সচেতন হওয়ার এখনই সময়

মাতৃগর্ভে ২৩ সপ্তাহ থাকার পর গালিবা হায়াতের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু বাঁচেনি শিশুটি। এটা খুবই দুঃখজনক একটি ঘটনা। সাধারণত ২৮ সপ্তাহের আগে কোনো বাচ্চা হলে আমরা একে গর্ভপাত বলে থাকি। এ ধরনের শিশুকে বাঁচানোটা একটু কঠিন। আমাদের দেশে যেসব যন্ত্রপাতি ও ইনজেকশন আছে, ২৮ সপ্তাহ পর কোনো বাচ্চা হলে সেসব যন্ত্রপাতি ও ইনজেকশন দিয়ে সেই বাচ্চাকে আমরা বাঁচাতে পারি। একটি শিশু মাতৃগর্ভে কমপক্ষে ৩৮ সপ্তাহ থাকলে এবং তার ওজন কমপক্ষে আড়াই কেজি হলে তাকে পরিণত শিশু বলা হয়। অপরিণত শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম হয়। তাই তাদের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। এ ধরনের শিশুর সেপটিসেমিয়া, জন্ডিস ও বিভিন্ন সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। এসব রোগে আক্রান্ত হলে ওই শিশুর বাঁচার সম্ভাবনা কম থাকে।

শিশু পরিপূর্ণ হওয়ার আগে জন্ম নিলে হঠাৎ তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তখন শিশুটিকে দেখে মনে হয় মৃত। এ ক্ষেত্রে সন্দেহ হলে অবশ্যই সেই শিশুকে বড় হাসপাতালে পাঠাতে হবে বা ভালো শিশুবিশেষজ্ঞের কাছে নিতে হবে। ডাক্তারের পরীক্ষা ছাড়া কোনো শিশুকে মৃত ঘোষণা করা ঠিক হবে না। গর্ভকালীন নানা জটিলতা থেকে সময়ের আগেই সন্তান প্রসব হতে পারে। এ জন্য যেকোনো নারীর গর্ভকালীন যত্ন খুবই জরুরি।

বাংলাদেশে অপরিণত শিশু জন্মের অন্যতম কারণ হচ্ছে মায়ের অপুষ্টি। অপুষ্টিতে আক্রান্ত মায়েদের জরায়ু দুর্বল হয়। দুর্বল জরায়ু অনেক সময়ই ৩৮ সপ্তাহ সন্তান ধরে রাখতে পারে না। এ ছাড়া আরও নানা কারণ আছে, যেমন গর্ভাবস্থায় মায়ের খুব জ্বর হলে, রক্তচাপ বেড়ে গেলে, ডায়াবেটিস থাকলে, হাম ও কলেরা রোগে আক্রান্ত হলে বা থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে সময়ের আগেই শিশুর জন্ম হতে পারে। একজন সুস্থ মা-ই পারেন একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশু জন্ম দিতে। তাই গর্ভবতী মায়ের জন্য প্রয়োজন সঠিক যত্ন ও পরিচর্যা। গর্ভকালীন যত্ন শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে সাহায্য করে।

প্রতিটি পরিবারের উচিত গর্ভবতী মায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। তাঁর যত্ন নেওয়া। তাঁকে পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। তাঁকে পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দিতে হবে। তাঁকে নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে। একজন নারী তাঁর গর্ভাবস্থায় কমপক্ষে চারবার চিকিৎসকের কাছে যাবেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, প্রথম ভিজিট: ১৬ সপ্তাহ (৪ মাস), দ্বিতীয় ভিজিট: ২৪-২৮ সপ্তাহ (৬-৭ মাস), তৃতীয় ভিজিট: ৩২ সপ্তাহ (৮ মাস), চতুর্থ ভিজিট: ৩৬ সপ্তাহ (৯ মাস)।

আমরা চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক গর্ভবতী নারী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসুন এবং চিকিৎসাসেবা নিন। সন্তান প্রসব হোক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। আমাদের দেশে এখনো বাড়িতে সন্তান প্রসবের হার ৬৮ শতাংশ। আর এসব সন্তান হয় অদক্ষ ধাইয়ের হাতে। এখনো সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতি লাখে ১৭০ জন মা মারা যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় সাড়ে চার লাখ শিশু জন্ম নেয় অপরিণত অবস্থায়। এর মধ্যে ২৬ হাজার শিশুরই মৃত্যু ঘটে। এগুলো খুবই দুঃখজনক।

আমাদের দেশে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে মেয়েদের বাল্যবিবাহ। এখনো দেশে ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার আগে। বিশেষ করে, গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারে বাল্যবিবাহের হার অনেক বেশি। অল্প বয়সে বিয়ের ফলে তারা অল্প বয়সে মা হচ্ছে। অথচ মা হওয়ার জন্য তাদের শরীর তৈরি থাকে না। গর্ভকালীন যত্ন সম্পর্কেও তারা কিছু জানে না। ফলে তারা অপুষ্টিসহ গর্ভকালীন নানা জটিলতায় ভোগে। অনেকেই অপরিণত শিশু জন্ম দিচ্ছে। পরিণত শিশু জন্ম দিলেও এসব শিশু অপুষ্টিসহ নানা রোগে ভোগে। এ জন্য সবার আগে মেয়েদের বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হবে। বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জনগণকে জানাতে হবে। সবাইকে এ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।

তবে সবার আগে প্রয়োজন অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের সচেতন করা। সন্তান জন্মদানের কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। নারীদের বুঝতে হবে একে হেলা করার কিছু নেই। দেশের প্রত্যেক অন্তঃসত্ত্বা নারী যদি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেন, তাহলে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার দুটোই কমবে। আর অপরিণত শিশু জন্ম দেওয়ার হারও কমে আসবে। তাহলে আমাদের আর গালিবা হায়াতের মৃত্যুর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ও হৃদয়বিদারক ঘটনা দেখতে হবে না।

গালিবা হায়াতের মৃত্যু থেকে আমাদের শিক্ষা হচ্ছে, কোনো অন্তঃসত্ত্বা নারীকে অবহেলা করা চলবে না। প্রতিটি অন্তঃসত্ত্বা মায়ের যত্ন নিতে হবে। আপনাদের কারও ঘরে যদি অন্তঃসত্ত্বা মা থাকেন, তাহলে তাঁর যত্ন নিন। এক্ষুনি তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিন। এ ক্ষেত্রে দেরি করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা সবাই সচেতন হলে কোনো অপরিণত শিশু জন্মাবে না, কোনো নবজাতকের মৃত্যু হবে না, কোনো প্রসূতিরও মৃত্যু হবে না।

ডা. রওশন আরা: স্ত্রীরোগ  প্রসূতি বিশেষজ্ঞ