সঞ্চয়কারীরা অপরাধী নন

বেশির ভাগ মানুষের জীবনে একটা সময় আসে, যখন আয়–উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়। সঞ্চয় তখন হয়ে যায় জীবনযাপনের অবলম্বন। যেহেতু গড় আয়ু বেড়েছে, তাই মূল সঞ্চয় ভেঙে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাই সঞ্চয় থেকে যা আয় হয় তার ওপর নির্ভর করেন অনেকে। টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রাখলে সুদ (ইসলামি ব্যাংক হলে মুনাফা) পাওয়া যায়। তবে সময়ের সঙ্গে দ্রব্যমূল্য বাড়ে বা মুদ্রাস্ফীতি হয়। তাই সুদ বা মুনাফা থেকে মূল্যস্ফীতির হার বাদ দিলে যা থাকে, তাই সঞ্চয় থেকে আয়। সুদ বা মুনাফার হার বেশি হলে এবং মূল্যস্ফীতি কম হলে সঞ্চয় থেকে আয় বাড়ে। আবার সুদ বা মুনাফার হার কমলে বা মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে সঞ্চয় থেকে আয় কমে। সুদ বা মুনাফার হার থেকে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হলে সঞ্চয় থেকে আয় না হয়ে বরং তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে এক বছর মেয়াদি আমানতের সুদের হার ব্যাংকভেদে বিভিন্ন হলেও এর গড় ৫ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশ। এ ছাড়া রয়েছে সুদের ওপর ১০ শতাংশ কর ও ব্যাংকে আদায় করা বাহারি নামের বিবিধ ফি। সামগ্রিকভাবে বর্তমানে বাংলাদেশে সঞ্চয় থেকে আয় না হয়ে তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।

আমানতের সুদের হার কম করা হয় কেন

আমানতের সুদের হার কম করার পেছনে একটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব আছে। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অর্থনীতিবিদ এডওয়ার্ড শ ও রোনাল্ড ম্যাককিনন উন্নয়নশীল দেশসমূহে সরকারের প্রবৃদ্ধিবিরোধী নীতির সমালোচনা করতে গিয়ে এ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। ‘আর্থিক নিষ্পেষণ’ (ফাইন্যান্সিয়াল রিপ্রেশন) নামের এ তত্ত্বের মূল বিবেচনা হলো সরকারের ঋণব্যয় কমানো। যার মাধ্যমে সরকার ব্যক্তি খাত থেকে অত্যন্ত কম সুদে সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে। এর ফলে আমানতকারীরা মূল্যস্ফীতি অপেক্ষা কম হারে সুদ লাভ করে। তাই ব্যবস্থাটিকে আর্থিক নিষ্পেষণ বলা হয়ে থাকে।

অর্থনীতিবিদ কারমেন রাইনহার্ট ও বেলেন সেব্রান্সিয়ার মতে, আর্থিক নিষ্পেষণ কার্যকর করার পদ্ধতি হলো এক. সুদের সর্বোচ্চ হার নির্ধারণ; দুই. সরকার কর্তৃক দেশীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ; তিন. দেশে নির্ধারিত মূল্যে সরকারকে ঋণ প্রদানের বাজার সৃষ্টি করা; চার. আর্থিক খাতে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ; পাঁচ. নির্ধারিত শিল্পের দিকে ঋণপ্রবাহ ধাবিত করা। দেখা যায় যে আর্থিক নিষ্পেষণের প্রায় সব লক্ষণই বর্তমান বাংলাদেশে বিদ্যমান।

আর্থিক নিষ্পেষণের সমস্যা

আর্থিক নিষ্পেষণের কথিত সুবিধার বিপরীতে এর বিরূপ প্রভাব ব্যাপক। প্রথমত, সঞ্চয়কারীদের আয় সংকোচন করার ফলে ঈপ্সিত সঞ্চয় হার হ্রাস পায়, যা বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির জন্য আবশ্যক। ফলে সঞ্চয় ও বিনিয়োগকারীর মধ্যে মধ্যস্থতা ব্যাহত হয় ও বিনিয়োগকারীদের আর্থিক প্রাপ্যতা হ্রাস ও এ খাতে স্থিতিশীলতা ব্যাহত হয়। দ্বিতীয়ত, এর ফলে বাজারে ভুল সংকেত যায়। সর্বোচ্চ উৎপাদনশীল খাতের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম উৎপাদনশীল বা অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ ধাবিত হয়। ফলে গড় উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়। তৃতীয়ত, নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্ষুদ্র সুবিধাভোগীদের সহায়তা করার কারণে অপচয় ও দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে যে আর্থিক নিষ্পেষণের ফলে ০.৪-.০৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায়। আর্থিক নিষ্পেষণকে কেউ কেউ ‘চোরা কর’ বলে অভিহিত করেছেন। কেননা এটা ঋণগ্রহীতাকে পুরস্কৃত ও সঞ্চয়কারীদের শাস্তি দিয়ে থাকে। এর ফলে অবসরভোগীরা বিশেষভাবে সঞ্চয়ের আয় থেকে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হন, যার সম্পর্কে আগেই বলেছি।

বাংলাদেশে আর্থিক নিষ্পেষণ

বাংলাদেশে আর্থিক নিষ্পেষণ নীতি শুরু হয় ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে যখন আমানতের ওপর সর্বোচ্চ সুদ হার ৬ শতাংশ এবং ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। অনেকে যাকে আর্থিক খাতে ‘নয়–ছয়’ বলে অভিহিত করেছেন। একই সঙ্গে সরকারি সঞ্চয় স্কিমগুলোতেও সুদের হার কমানো হয়। তখন এ যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হলে বেসরকারি বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি বাড়বে। ইতিমধ্যে ২০১৯ সালের শেষ দিকে করোনাভাইরাস হানা দেয় এবং ২০২০ সালের জুন মাসে সরকার প্রণোদনা হিসেবে খাতভেদে ৪-৫ শতাংশ ঋণ ছাড় প্রদান করে। এখন দেখা যাচ্ছে যে এসব রেয়াতি ঋণপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের অনেকেই ঋণখেলাপি বা ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণ করেছে। অর্থাৎ এরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উৎপাদনশীল নয়। গ্রাহক-ব্যাংক সম্পর্কের দোহাই দিয়ে প্রকৃত উৎপাদনশীল বিনিয়োগকারীদের রেয়াতি হারের ঋণ সুবিধাবঞ্চিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশে বিদ্যমান আর্থিক নিষ্পেষণের প্রধান উদ্দেশ্য যে অত্যন্ত কম সুদে সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য তহবিল সংগ্রহ, তা একটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হবে। সম্প্রতি অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে আট হাজার কোটি টাকার ইজারা সুকুক বন্ড চালু করার জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। সংগৃহীত অর্থ দিয়ে সারা দেশে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হবে। পাঁচ বছর মেয়াদি এ বন্ডের ইজারা বাবদ প্রতি ছয় মাসে প্রদেয় হার নির্ধারণের জন্য বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ঘোষিত সরকারের ইসলামিক বিনিয়োগ বন্ডের মুনাফার হারকে ভিত্তি ধরা হয়েছে। ঘোষিত হার ৩.৬৯ শতাংশের সঙ্গে আরও ১ শতাংশ যোগ করে ইজারার হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৪.৬৯ শতাংশ (বার্ষিক হার আনুমানিক ৫ শতাংশ), যা মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশ থেকে কম। ফলে স্থিরমূল্যে সুকুক বন্ডে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

মালয়েশিয়ায় সুকুক বন্ড বেশ জনপ্রিয়। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে সেখানে সুকুক বন্ডগুলোর গড় আয় ৩.৫৬ শতাংশ, যেখানে সাধারণ বন্ডের আয় ৩.৩৪ শতাংশ। আপাতদৃষ্টে মনে হবে, বাংলাদেশের প্রস্তাবিত হার বেশি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ২০২০ সালে মালয়েশিয়ায় মূল্যস্ফীতির হার ০.৬২ শতাংশ। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীরা তাদের সঞ্চয় থেকে প্রায় ৩ শতাংশ আয় করবে। আর বাংলাদেশের বিনিয়োগকারীরা ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ধরলে স্থিরমূল্যে ১ শতাংশ ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।

যদি এমন হতো যে বেসরকারি খাতের তুলনায় সরকার তহবিল বিনিয়োগে অধিকতর উৎপাদনশীল, তাহলে অত্যন্ত কম সুদে সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্য তহবিল সংগ্রহের এ ব্যবস্থা সমর্থন করা যেত। কিন্তু আমরা জানি যে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প মানেই দুর্নীতি, অপচয় ও প্রকল্প–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় প্রমোদভ্রমণ। প্রস্তাবিত সুপেয় পানি প্রকল্প নিয়ে ভিন্ন কিছু হবে, এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই।

সরকার কী করতে পারে

সার্বিকভাবে আমরা লক্ষ করেছি যে বর্তমানে আর্থিক নীতিতে কেবল সরকার ও গোষ্ঠীবিশেষের স্বার্থ সংরক্ষিত হচ্ছে। আমরা চাই সার্বিক জনস্বার্থে বিদ্যমান আর্থিক নিষ্পেষণ নীতি পরিহার করে সরকার সুদের হার নির্ধারণ বাজারের ওপর ছেড়ে দিক। ন্যূনপক্ষে সঞ্চয়কারীরা যাতে মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় স্থিরমূল্যে ৩-৪ শতাংশ আয় করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করুক।

বর্তমানে সঞ্চয়কারীরা ন্যূনতম প্রত্যাশিত আয় না পাওয়ায় পি কে হালদারের পিপলস লিজিংয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। অথবা ব্যাংকে বিনিয়োগ করে সঞ্চয় খোয়াচ্ছেন। সঞ্চয়কারীরা কোনো অপরাধী নন যে তাঁদের এভাবে শাস্তি দিতে হবে!

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ