সতর্কতা যেখানে উপেক্ষিত

‘সেফটি ফার্স্ট’ এই সতর্কবার্তাটিকে উন্নত বিশ্বে যেকোনো নির্মাণকাজে একটি অবশ্যকরণীয় নির্দেশনা হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। নির্মাণ প্রকল্পের চারপাশে তাই দৃশ্যমানভাবে এই বাক্য ঝুলিয়ে রাখা হয় সবাইকে সতর্ক করার জন্য। নির্মাণের বিশাল দক্ষযজ্ঞে সামান্য অসতর্কতায় যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় কোনো দুর্ঘটনা। জীবনের মূল্য সবচেয়ে বেশি—উঁচু দালান কিংবা ফ্লাইওভারের চেয়েও। সুতরাং, আগে জীবন বাঁচাও, তারপর দালান।

পাবলিক প্লেসে নির্মাণের ক্ষেত্রে সতর্কতার মাত্রা আরও বেশি হয়ে থাকে। নির্দিষ্ট অঞ্চল ঘিরে বেষ্টনী, পাশাপাশি জনগণের ভোগান্তি সৃষ্টির জন্য ক্ষমা চেয়ে ঝোলানো বার্তা। জাপানিরা এ ব্যাপারে আরও এক ধাপ এগিয়ে। টোকিওতে অবস্থানকালে কোনো এক শীতের সকালে, বৃষ্টির মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার পথে খোঁড়াখুঁড়ির জন্য রাস্তার কিয়দংশ বেষ্টনী দিয়ে বন্ধ করায় কিছুটা ঘুরে যেতে হলো। আর এ জন্য সড়ক বিভাগেরই এক কর্মীকে দেখলাম প্রায় প্রতিটি গাড়ি এবং পথচারীকেই মাথা নুইয়ে ‘সুমিমাসেন’ বলে দুঃখ প্রকাশ এবং পাশাপাশি সতর্ক করছেন। এটা অবশ্য জাপানে একটি স্বাভাবিক রীতি। তবে আশ্চর্য হলাম তখন, যখন দুপুরবেলা খেতে যাওয়ার সময় সকাল আটটার সেই কর্মীকে একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে প্রচণ্ড শীত আর বৃষ্টির মাঝে একই কায়দায় রোবটের মতো মাথা নুইয়ে প্রতিটি গাড়ি ও পথচারীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে দেখলাম। উন্নত বিশ্বে এ ধরনের গল্প হরহামেশাই শোনা যায়, যেমন যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলের মাঠে খেলতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে এক ছাত্র আহত হলে স্কুল কর্তৃপক্ষকে জরিমানা করা হয়। তাদের অপরাধ, তারা মাঠটিতে শেওলা জমতে দিয়েছে। সিঙ্গাপুরে বাসের হাতল ভেঙে এক ব্যক্তি আহত হওয়ায় বাস কোম্পানিকে চিকিৎসা খরচ বহনের পাশাপাশি ওই ব্যক্তিকে সারা জীবনের জন্য ভাতা প্রদানে বাধ্য করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চিত্রটি একেবারেই ভিন্ন। নির্মাণ আর খোঁড়াখুঁড়িতে ক্ষমা চাওয়া দূরে থাক, রাস্তার অর্ধেকজুড়ে ইট, বালু আর সিমেন্ট স্তূপ করে রেখে পথচারীদের হরহামেশা হেনস্তা করাই বরং এখানকার নির্মাতাদের স্বভাবসুলভ আচরণ। পানির পাইপে পড়ে শিশুর মৃত্যু, ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে  মৃত্যু, নির্মাণকাজে অসতর্কতার জন্য শ্রমিক কিংবা নির্মাণাধীন ভবনের ইট/নির্মাণসামগ্রী পড়ে পথচারী আহত এবং নিহত হওয়া ইত্যাদি এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। খুব কমসংখ্যক নির্মাণ সাইটেই দেখা যায় যে নির্মাণকর্মীরা হেলমেট পরছেন। সুউচ্চ ভবনের দেয়ালে রং করছেন দড়িতে ঝুলে কোনো সেফটি বেল্ট না পরেই। ব্যস্ত মার্কেট কিংবা স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, যেখানে প্রতি মুহূর্তে শত শত মানুষের আনাগোনা, সেই সব স্থানেও প্রায়ই দেখা যায় কোনো প্রকার নিরাপত্তাবেষ্টনী/জাল/মাচা ছাড়াই বহুতল ভবন তৈরি হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নির্মাণের ন্যূনতম সাবধানতাও নিশ্চিত করা হচ্ছে না।

একটি ভবন তৈরি করার পরও অনেক ধরনের সতর্কতা নিশ্চিত করতে হয়। যেমন লিফট কিংবা এসকালেটর ঠিকভাবে কাজ করছে কি না, বিদ্যুৎ বা গ্যাসের সংযোগ কতটা নিরাপদ, অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডারটি ঠিক জায়গায় আছে কি না বা ফায়ার এসকেপ রুট আছে কি না ইত্যাদি। বাংলাদেশের শপিং মলগুলোতেও এসকালেটরের ব্যবহার আজকাল বেড়েছে। রীতিমতো আতঙ্কে থাকতে হয়, কখন না আবার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। লিফট আটকে মৃত্যুর ঘটনা দেশে ঘটেছে বেশ কয়েকবার। ফুটওভার গুলোর রেলিং ভাঙা, এমনকি রেলস্টেশনে পথচারী পারাপারের জন্য তৈরি কাঠের ব্রিজের মাঝখানে কয়েকটি পাটাতনই নেই বা ভাঙা! মূলত সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এর অন্যতম কারণ। আগুনে মৃত্যুর ঘটনা তো হররোজই হচ্ছে।

অথচ বাংলাদেশ নির্মাণ বিধিমালায় (বিএনবিসি) স্পষ্ট করেই বলা আছে যে কোন ধরনের নির্মাণে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। নির্মাণকর্মীদের মাথায় হেলমেট, ঝুলে কাজ করার ক্ষেত্রে সেফটি বেল্ট, বিশেষ ধরনের পোশাক—এ সবকিছুই বিধিতে বলা আছে। উঁচু ভবনের ক্ষেত্রে নাইলনের জাল দিয়ে চারপাশ ঢেকে দেওয়া এবং পর্যাপ্ত শক্তিসম্পন্ন নিরাপত্তামূলক মাচা (কেনপি) দেওয়া, যা কিনা ওপর থেকে পড়ন্ত কোনো ভারী বস্তুকে ঠেকাতে পারে—নির্মাণবিধি অনুযায়ী এ সবকিছুই বাধ্যতামূলক। ভবনের চারপাশে প্রদর্শন করতে হবে সাবধানবাণী এবং সতর্কতার মাত্রা নিরূপণকারী বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন। বলা আছে লিফট, বিদ্যুৎ, গ্যাসের সংযোগ কেমন হবে বা আগুন নির্বাপণ যন্ত্র কয়টা এবং কোথায় রাখতে হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

আফসোসের কথা হচ্ছে, বিধিমালা করেই কর্তৃপক্ষ খালাস। এগুলো তদারকির জন্য প্রকৃত অর্থে কেউ আছেন বলে মনে হচ্ছে না। কেননা লোকচক্ষুর অন্তরালে নয়, বরং বড় রাস্তার ওপর সবার সামনেই যখন নিয়মগুলো ভাঙা হচ্ছে, কর্তৃপক্ষ যে–ই হোক, দেখতে অসুবিধা হওয়ার তো কথা নয়। বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে, নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্ট’ বা ‘নির্মাণ ব্যবস্থাপনা’ নামে একটি মাস্টার্স প্রোগ্রাম খোলারও চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বাদ সাধল সরকারের উচ্চতর মহল। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং আর আর্কিটেকচারের বাইরে এ ধরনের বিষয়ের নাম সম্ভবত তারা শোনেনি, কিংবা  এটার প্রয়োজনীয়তা তারা অনুভব করে না। অথচ উন্নত বিশ্বে, এটি একটি বহুল প্রচলিত বিষয়, যার আছে ব্যাপক চাহিদা। সিঙ্গাপুরে একজন সার্বক্ষণিক ‘সেফটি অফিসার’ ছাড়া আপনি কোনো নির্মাণকাজ শুরুই করতে পারবেন না।

একটুখানি অসতর্কতা আপনার জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। আমি অনেক তাগড়া যুবককেও দেখেছি যে ওপরে ফুটওভারব্রিজ রেখে নিচে চলন্ত গাড়ির মাঝ দিয়ে রাস্তা পার হতে। অথচ কোনো উন্নত দেশে জেব্রা ক্রসিং বা ফুটওভারব্রিজ ছাড়া রাস্তা পার হওয়ার কথা বোধ হয় কেউ স্বপ্নেও ভাবে না। হেলমেট কিংবা সেফটি বেল্ট থাকার পরও তা পরতে নারাজ আমাদের নির্মাণকর্মীরা। সম্ভবত পয়সার চেয়েও বড় কিছু এখানে লাগে বৈকি। আর তা হচ্ছে সঠিক শিক্ষা আর সচেতনতাবোধ। এলডিসি থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। এরই সঙ্গে আমাদের কিছু স্বভাবচরিত্রেরও উন্নতি প্রয়োজন। রাস্তা পারাপার থেকে আরম্ভ করে ভবন নির্মাণ সবখানে ‘সতর্কতাই প্রথম’, এ বোধের উন্মেষ ঘটাতে হবে।

মো. সিরাজুল ইসলাম: অধ্যাপক, সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও ডিন, স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সেস, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।