ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্তবিদ্যাস্থানেভ্য এব চ।।
এই মন্ত্রধ্বনির মাধ্যমে শুরু হবে বিদ্যাদেবীর আরাধনা। হিন্দু ধর্মানুসারীদের বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি আনন্দঘন দিন হচ্ছে সরস্বতী পূজা। প্রতিবছর মাঘ মাসের শুল্ক পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে দেবী সরস্বতীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সনাতন ধর্ম মতে, ঈশ্বরের বিদ্যা, সংগীত, শিল্পকলা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী প্রজ্ঞাশক্তিরূপ দেবী মাতা সরস্বতী। ঈশ্বর সব ধরনের শক্তির উৎস। হিন্দু দর্শনমতে, তিনি যখন জ্ঞানদাতা হিসেবে কাজ করেন, তখন তাঁকে মাতৃরূপে পূজা করা হয়। মা যেমন স্নেহবাৎসল্যে, সোহাগে শিশুকে জন্মের পর থেকে আধো আধো বুলির মাধ্যমে পৃথিবীর জ্ঞান প্রথম প্রদান করেন, তেমনি ঈশ্বর মাতৃরূপেই আমাদের জ্ঞান দান করেন। যিনি মানুষের অন্তরে মহান জ্ঞানসমুদ্রকে প্রকাশ করেন এবং মেধা ও মননকে দীপ্তি দান করেন। সনাতন ধর্ম মতে, দেবী সরস্বতী শুভ্রকান্তি, শ্বেত পদ্মাসনে আসীনা; তাঁর হাতে পুস্তক ও রুদ্রােক্ষর মালা, তিনি শ্বেত চন্দনে চর্চিতা, শ্বেত বীণাধারিণী এবং শ্বেত অলংকারে ভূষিতা। সরস্বতী বিদ্যা, জ্ঞান, শিল্প, কলা ও সংগীতের দেবী। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায় অধ্যয়নরত বিদ্যার্থীরা এই পূজা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করে থাকে।

ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু তিনি বহুরূপে বিরাজমান। মহাবিশ্বে যেমন শক্তির ভৌগোলিক ভিন্নতা রয়েছে, তেমনি ঈশ্বর সাধনা ও তাঁর রূপেরও ভিন্নতা আশ্চর্যের কিছু নয়। স্বরূপলক্ষণে তিনি সগুণ, সাকার, সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কার্যের অধিকর্তা, তিনি এই নিখিল বিশ্বের প্রভু, তিনিই ঈশ্বর, তিনিই জ্ঞানময়। সরস্বতী সর্বশুক্লা, তাঁর শ্রীহস্তে বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্তদি, তিনি বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, তিনি সব তমঃ নাশ করেন, তিনি বাগ্দেবী, তাঁর নয়ন বিশাল ও পদ্মের ন্যায়, তিনি সব ঐশ্বর্যের সিদ্ধিদায়িনী। জ্ঞানময়ী বা চিন্ময়ীরূপে তিনি সর্বত্র, সর্বব্যাপিনী। তাঁর অমিয়ধারা বিশ্বে বিশ্বে পরিব্যাপ্ত। সে প্রভাময় আলোক জগতের জমাটবাঁধা তমোরাশি অপনীত করে।
পরমেশ্বর যখন জ্ঞানময় তখন তিনি সরস্বতী। ‘সরস’ শব্দের অর্থ জ্যোতি ও জল আর আলোকময়ী বলেই তিনি সর্বশুক্লা। বেদে কখনো তাঁকে নদীরূপে কখনো দেবীরূপে আবাহন করা হয়েছে। নদী কেবল জলের আধার নয়, নাদ তথা শব্দেরও আদি উৎস। বাক্দেবীরূপে সরস্বতী তাই নাদময়ী। বৈদিক যুগে পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে সরস্বতী নামে নদীর অস্তিত্বের কথা উল্লেখ রয়েছে। এখানেই ঋষিরা ধ্যানস্ত সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন। এখানেই ফুটেছিল পৃথিবীর প্রথম বিদ্যালোক। সরস্বতী দেবী এবং উচ্ছ্বাসময়ী নদী সরস্বতী উভয়েই অভিন্ন।
সর্বস্বত্বময়ী, সর্বশুক্লা বলে তাঁর বর্ণ সাদা, হাঁসও সেই শুভ্রতার প্রতীক। হাঁসের বিচরণ জলে, স্থলে, আকাশে। অর্থাৎ আমরা যেন জীবনের সব স্তরে সমান জ্ঞানের অধিকারী হই, এই বার্তাই প্রতিবছর মা সরস্বতীর বাহন হংসের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত হয়। আবার হাঁসই একমাত্র প্রাণী, যে কি না মিশ্রিত দুধ ও জলের মধ্য থেকে শুধু সার অংশ দুধই গ্রহণ করে। জ্ঞানীরা যেভাবে সংসারের সারতত্ত্ব গ্রহণ করে থাকেন, এ কারণে জ্ঞানীদের বলা হয় পরমহংস। অসত্য ও অনিত্য ভোগস্পৃহা পরিত্যাগপূর্বক নিত্য সত্যের দিকে ধাবমান হওয়াই দেবী পূজার লক্ষ্য। আবার হাঁসের পালক এমনভাবে তৈরি যে জলে থেকেও হাঁস জলযুক্ত হয় না, যেন সংসারে থেকেও সংসারে নেই।
বেদে সরস্বতী সম্পর্কে স্পষ্ট করেই উল্লেখ করা হয়েছে। সুপ্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে বিশেষত বেদে আমরা মাতা সরস্বতীকে পাই। সরস্বতী তাই বৈদিক দেবী। বৈদিক যুগে মাতা সরস্বতী বিভিন্নভাবে পূজিতা হয়ে থাকলেও তাঁকে ঋষিরা প্রধানত দুটি রূপে বন্দনা করে থাকতেন। (১) নদীরূপে (২) মাতৃ বা দেবীরূপে। তিনি যেমন মাতৃগণের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ, তেমনি নদীর মধ্যেও। এই সরস্বতী এক বিশাল নদী ছিল বৈদিক যুগে, যদিও বর্তমানে সেটা লুপ্ত। বৈদিক যুগে সরস্বতী নদীর তীরে মনোরম প্রাকৃতিক নতুন পরিবেশে, কল্লোলিনীর উচ্ছল জলতরঙ্গে শ্বেতশুভ্র রাজহংসের আনাগোনায়, সামগানের সুমধুর সুরে ভাবুক ঋষিমনে জ্ঞানদায়িনী সরস্বতী মাতার আবির্ভাব হয়। বেদে সরস্বতী শুধু বিদ্যাদায়িনী বা জ্ঞানদায়িনী নন, তিনি অশুভ শক্তি ধ্বংসকারীও বটে।
সরস্বতী পূজার দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পারিবারিক মণ্ডপে খুব সকালে শুরু হয় পূজার আয়োজন। সব ধর্মের মানুষের আগমনে অন্যান্য উৎসবের মতো এই দিনটি আবার আমাদের উদার ও প্রগতির পথপ্রদর্শন করে। শিক্ষা ও জ্ঞানের কোনো ধর্ম হয় না, আর যে কারণে বাংলাদেশের মুক্তচিন্তায় আলোকিত মানুষ এমন উৎসবমুখর দিনটিকে ধর্মীয় সংকীর্ণ গণ্ডিতে বিচার না করে বৃহৎ সামাজিক জীবনের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করেন। জ্ঞান সাধনার সঙ্গে আত্মিক ক্রমবিকাশের সম্পর্ক নিবিড়। সরস্বতী পূজার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের জ্ঞানের ক্ষুদ্র ধর্মীয় গণ্ডি অতিক্রম করে বৃহৎ জ্ঞানসমুদ্রে বিচরণ। সরস্বতীর শ্বেতশুভ্র ভূষণের মতো স্বচ্ছ আলোয় ধুয়ে যায় কূপমণ্ডূক কট্টরবাদিতার কালিমা, মনের মলিনতাকে পরিহার করে ব্যবহারিক জীবন ও পারলৌকিক জীবনের পরিপূর্ণতাই সরস্বতী পূজার মহান আদর্শ। পদ্মে আসীনা মাতা সরস্বতী জ্ঞানরূপ চক্ষু দিয়ে জগতে শতদলের মতো প্রস্ফুটিত সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষকে অশুভ পরিহার করে মঙ্গল আলোয় উদ্ভাসিত করার শিক্ষা দেন।
কোনো জাতির সমাজ ও সভ্যতার পরিচয় লুকিয়ে থাকে তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে। জ্ঞান ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষ সবার আরাধ্য, তাই সরস্বতী পূজা প্রতিবছর আমাদের সেই সর্বস্তরের মানুষের মিলন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সবার অংশগ্রহণ ও ধর্মীয় সহাবস্থানের কারণে সরস্বতী পূজা দেশের সর্বোচ্চ জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও কল্যাণমুখী শিক্ষায় উৎসাহিত করছে। অসাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থার ভিত দৃঢ় ও সকল প্রকার অন্ধকারাচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক শিক্ষার অবসান হোক। সব শিক্ষার্থীর মনে নির্মল জ্ঞানের আলোক জ্বলে উঠুক। প্রকৃত শিক্ষালাভের মাধ্যমে আমরা যেন মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পারি। উপনিষদের সেই বাণী আমাদের সবার অন্তরের জ্ঞানের সুপ্ত আলোকে বিকশিত করুক—
অসতো মা সদ্গময়।
তমসো মা জ্যোতির্গময়।
মৃত্যোর্মা অমৃতংগময়।
আবিরাবীর্ম এধি।।
সঞ্জয় সরকার: প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।