সন্তানের হাতে নিহত হওয়ার এ সময়
ছেলে হত্যা করেছে জন্মদাতাকে। পুত্র হত্যা করেছে গর্ভধারিণীকে। আপনজনের কোনো ন্যক্কারজনক বা দুঃখজনক ঘটনা সম্পর্কে মানুষ চরম আক্ষেপে বলে থাকে, ‘এটা দেখার আগেই যেন আমার মৃত্যু হয়।’ ফরিদপুরের ওই বাবা এবং চট্টগ্রামের ওই মায়ের দুর্ভাগ্য এতটাই; যা দেখা সম্ভব নয়, তা দেখেই তাঁরা মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁরা জেনেছেন, আত্মজই তাঁদের ঘাতক। এবং এটা দুঃস্বপ্ন নয়, এটাই বাস্তব।
ফরিদপুরের বাবা মানুষটাকে তো মৃত্যুর আগে পাঁচ দিন দগ্ধ শরীরের যন্ত্রণা সইতে হয়েছে। আমরা জানি না, এই কয় দিন কোন যন্ত্রণায় বেশি পুড়েছেন তিনি, আগুনে পোড়ার, নাকি সন্তানের পিতৃঘাতী হওয়ার? নাকি মরণযন্ত্রণার চেয়েও বড় হয়ে গিয়েছিল সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়? হয়তো তিনি প্রাণপণে বাঁচতে চেয়েছিলেন, যাতে সন্তান হত্যার দায় থেকে রেহাই পায়!
জীবন সুন্দর, বিচিত্র এবং একই রকম কুৎসিত ও মর্মান্তিক। কিছু সত্য অসহ্য হয়। ছাত্র আন্দোলনের দায়ে কিছুদিন জেলবাস হয়েছিল এই লেখকের। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যে ওয়ার্ডে ছিলাম, সেখানে একদিন এক ছেলেকে আনা হলো। ২০-২২ বছরের ছেলেটির বাড়ি সাভারে। বাবা ছিল না। খুবই গরিব পরিবার। মায়ের সঙ্গে থাকত, দুজনে মিলে পরিবার চালাত। মাকে কুপিয়ে হত্যার দায়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ঘটনাটি সে সময় খুব আলোচিত হয়েছিল। প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার তাগড়া সুদর্শন ছেলে। কথা বলত না একেবারেই। তাকে জিজ্ঞাসা করার কোনো মানে ছিল না যে আসলে সে-ই হত্যাকারী, নাকি ষড়যন্ত্রের শিকার?
জেলখানার ভেতরে সবাই শক্তের ভক্ত। গরম দেখাতে না পারলে সহবন্দীরা আপনাকে খেতে দেবে না, শুতে দেবে না, বিভিন্নভাবে অত্যাচার করবে। কারণ, হয়তো জায়গা ও বরাদ্দ নিয়ে টানাটানি। সেই অমানবিক পরিবেশে ছেলেটির একদল ভক্ত জুটে গেল। তাকে দেখতাম, সে তাদের জন্য খাবার ছিনিয়ে আনছে লাইন ধরে, রাতে ঠেলে ঠেলে চলাচলের জায়গায় শোয়ার জায়গা বের করছে ভক্তদের জন্য। তাকে দেখে মনে হতো না তার হাত দিয়েই আপন মায়ের হত্যাকাণ্ড সম্ভব হয়েছে। কেউ কেউ সে সময় বলা শুরু করেছিল, সম্পত্তির জন্য মায়ের ভাইয়েরা মাকে হত্যা করে ছেলেকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। বিচারের রায় কার পক্ষে গিয়েছিল, তা-ও জানা নেই।
কিন্তু নতুন মডেলের মোটরসাইকেল কিনে দেওয়া হয়নি বলে যে ছেলেটি বাবা-মায়ের গায়ে আগুন দিয়েছে, তার বিষয়ে সন্দেহ নেই। কাজটা তার দ্বারাই হয়েছে। কিংবা বড় ভাই বকাঝকা করায় চট্টগ্রামের যে ছেলেটি অসুস্থ মাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে, তার ভূমিকাও স্পষ্ট। বাবা-মাকে হত্যার দায়ে ফাঁসির আসামি ঐশীর ঘটনাও সবাই জানেন।
আদালতের কাজ অপরাধে জড়িত ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া। কিন্তু যাদের জন্য একটা নিরাপদ সমাজ দরকার, তাদের ভাবতে হচ্ছে আরও বেশি। কোন পরিস্থিতিতে আদরের সন্তান পিতা-মাতার ঘাতক হয়ে ওঠে? কী তাকে এমন হঠাৎ ক্রোধে বন্য করে তোলে? এরা তো পেশাদার অপরাধী নয়। পেশাদার খুনির নিজেকে ঘৃণা হয় না। খুনের পেছনে খুনির যুক্তিটাও খুনি হয়ে থাকে। যোদ্ধার কাছে যেমন থাকে হত্যার যুক্তি। কিন্তু কেউ যখন প্রিয়তমকে হত্যা করে, তখন সে চলে যায় সব যুক্তির বাইরের এক মনোভাবে। ক্ষণিকের জন্যও যদি হয় এমন মানসিক বিকার, তখন যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। হয়তো ওই রকম মুহূর্তে তাদের যে ‘আমি’, সেই ‘আমি’ ভয়ানক আহত হয়েছিল, হুমকিগ্রস্ত হয়েছিল, তাদের অহং ধাক্কা খেয়েছিল।
ফরিদপুরের পিতৃঘাতী ছেলেটির পুরোনো মডেলের মোটরসাইকেলে আর চলছিল না। তার দরকার হয়েছিল নতুন মডেলের বাইক। হয়তো তার মনে হয়েছিল, নতুন বাইক ছাড়া তার জীবন বৃথা। অল্পবয়সী মনে এমন হতে পারে। ঈদে পাখি মডেলের পোশাক না পাওয়ার তুচ্ছ ঘটনায় কয়েকজন কিশোরীর আত্মহত্যার ঘটনাও আমরা দেখেছি। এই বয়সে মোহ জাগে। সেই মোহের লক্ষ্য কখনো প্রেমিক বা প্রেমিকা, কখনো কোনো ইলেকট্রনিক গেজেট, কখনো গাড়ি বা পোশাক বা এ রকম যেকোনো ভোগ্যবস্তু। ভূতে ধরা লোককে ভূতই চালায় বলে যেমন বিশ্বাস করা হয়; সে তখন তার সুস্থ-স্বাভাবিক ‘আমি’ থাকে না, হয়ে যায় ‘অন্য’ কেউ। তেমনি মোহে অন্ধ মানুষ মোহের বস্তু বা মানুষ সম্পর্কে ভাবে, ‘ওটা বা ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না।’ এটা এক অস্বাভাবিক মনোবিকার; যার হয় সে আর সে থাকে না। এ অবস্থায় কেউ আত্মহত্যা করে, কেউ তার মোহলাভের বাধাকে হত্যা করে। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে প্রেমিকাকে হত্যা করাও প্রায় এমন ধরনেরই আচরণ। এ অবস্থায় প্রিয়তম হয়ে ওঠে তার কাছে ঘৃণ্যতম।
ভোগবাদের সংস্কৃতি যখন মানুষের থেকে ভোগের বস্তুকে, জীবনের থেকে পণ্যকে বড় করে দেখায়, তখন কারও কারও মধ্যে এমন চরম ধ্বংসাত্মক বাসনা জাগতে পারে। কারখানার চেইন-বেল্টের মতো আমরা পণ্যের স্রোতের মধ্যে হিমশিম খাই। সেখানে প্রতিমুহূর্তে পণ্য পিক করতে না পারলে যেন আমি আনফিট। এ অবস্থায় পণ্য ও বস্তুই হয়ে যায় মানুষ ও তার মানবিক অধিকারের বিকল্প। পণ্য ছাড়া তার ‘আমি’ যেন শূন্য হয়ে যায়।
আজকে গণহারে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটছে না সত্য। পারিবারিক পরিবেশ, বেড়ে ওঠার প্রভাব ইত্যাদি কারণও রয়েছে এর পেছনে। পাশাপাশি সম্পর্কের ভাঙন, অস্থিরতার প্রভাবও দেখতে হবে। শিশু থেকে তরুণ-তরুণীদের অনেকেই কি এমন ভোগ ও মোহের অসুখে ভুগছে না? মানুষ রেখে টাকা, জিনিস, ভোগ-বিলাসের দিকেই কি ছুটছি না আমরা? বাজার কি সেভাবেই ডাকছে না আমাদের? এর ফেরে পড়ে মানুষের ভেতর থেকে মনুষ্যত্ব ও শান্তি বেলুনের বাতাসের মতো উবে যাচ্ছে। মানুষটা তখন চুপসে যায়, তখনই সম্ভাবনা তৈরি হয় যেকোনো বিপর্যয়ের। ভোগবাদী অসন্তোষ হলো সেই আসল অসুখ। সন্তানের হাতে বাবা-মায়ের হত্যাকাণ্ড হলো সেই রোগের জ্বলন্ত ও রক্তাক্ত লক্ষণ।
আদালত হত্যার বিচার করবেন; কিন্তু সমাজমনস্তত্ত্বকে বিকৃত করার দায়টা তো কাউকে নিতে হবে। শিশুরা মায়ের গর্ভে জন্মালেও, তাদের মন-মানসিকতা গড়ে দেয় সমাজ-বাস্তবতা। সেই বাস্তবতার ওপর পরিবারের হাত নেই, হাত আছে রাষ্ট্রের, সরকারের, ব্যবস্থার। একটা সমাজব্যবস্থা যখন বিগড়ে যায় বা অসুস্থ হয়ে যায়, তখন ‘কোলাটরেল’ বা পারিপার্শ্বিক শিকার হয় অনেক অসাধারণ মানুষ। সমাজের চিকিৎসা না করে ব্যক্তির বিকারের বিহিত করা সম্ভব নয়। আমাদের তরুণেরা কেবল ঝুঁকিতে নেই, তারা নিজেরাই হয়ে উঠছে ঝুঁকি। পিতা-মাতার লাশের সামনে খুনি সন্তানের দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য সেই ঝুঁকির সতর্কঘণ্টা বাজিয়ে গেল।