সবাই শারমিনের মতো সাহসী হোক
এই কয়েক দিন আগেও শারমিন আক্তারকে তেমন কেউ একটা চিনত না। ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সত্যনগর গ্রামের এই কিশোরীকে চেনার কোনো কারণও ছিল না। কিন্তু এখন শারমিনের নাম মুখে মুখে। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও শারমিন আক্তার এখন খুব পরিচিত একটি নাম। তার সাহসিকতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ তাকে এই পরিচিতি এনে দিয়েছে। শারমিন অসীম সাহসিকতার সঙ্গে নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছিল।
এই সাহসিকতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ (আইডব্লিউসি) ২০১৭’ পুরস্কার পেয়েছে শারমিন। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০০৭ সাল থেকে সাহসিকতার জন্য নারীদের এই পুরস্কার দিয়ে আসছে। শারমিনকে নিয়ে আজ শনিবার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় একটি খবর প্রকাশিত হয়। সেই সঙ্গে ছাপা হয় শারমিনের হাস্যোজ্জ্বল একটি ছবি। খবরটি পড়ে মনে এক অদ্ভুত প্রেরণা ও সাহস জেগে ওঠে।
পত্রপত্রিকার কল্যাণে শারমিনের এই বাল্যবিবাহ ঠেকানোর কাহিনি এখন প্রায় সবার জানা। ২০১৫ সালে শারমিন যখন মাত্র নবম শ্রেণির ছাত্রী, তখন তার মা গোলেনূর বেগম প্রতিবেশী এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেন। এতে শারমিন রাজি না হলে তাকে মারধর করা হয়। এমনকি যে যুবকের সঙ্গে শারমিনের বিয়ে ঠিক হয়, তাঁর সঙ্গে শারমিনকে এক ঘরে আটকে রাখেন তার মা। পরে বাড়ি থেকে পালিয়ে এক সহপাঠীর সহযোগিতায় শারমিন থানায় গিয়ে তার মা ও ওই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা করে। একজন গ্রামের মেয়ে হয়ে শারমিন যে সাহস দেখিয়েছে, তা অতুলনীয়।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখনো শারমিনের মায়ের বিরুদ্ধে করা মামলাটি চলছে। মায়ের সঙ্গে এখন তার কোনো সম্পর্ক নেই। তার বাবা, দাদি, ফুফু—সবাই তার সঙ্গে আছেন। এখন সে ঢাকায় ফুফুর বাসায় আছে। এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।
শারমিন ভাগ্যবতী। মা তার ওপর একটি অন্যায় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাইলেও পরিবারের অন্য সদস্যরা তা সমর্থন করেননি। তাঁরা শারমিনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা তার লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সাহায্য করছেন। কিন্তু এ দেশের সব মেয়ে শারমিনের মতো ভাগ্যবতী নয়। মা-বাবা বা অভিভাবকের ইচ্ছার কাছে হার মেনে অনেক মেয়ে অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসছে। প্রতিবাদ করার সাহস তাদের নেই বা প্রতিবাদ করার প্রয়োজনই মনে করে না। এই মেয়েদের ক্ষেত্রে এরপর যা যা ঘটে, সেগুলো হলো: তারা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ে। অল্প বয়সে গর্ভধারণ করে। সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় তারা নানা জটিলতার মধ্যে পড়ে৷ তাদের বড় একটা অংশ মারা যায়। যারা বেঁচে থাকে, তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ কম ওজন এবং এবং অপুষ্ট শিশু জন্ম দেয়৷ পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার কারণে তারা আর কর্মশক্তিতে অংশ নিতে পারে না৷ নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রেও তারা পিছিয়ে পড়ে৷ এই মেয়েদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিকভাবে সব সম্ভাবনার মৃত্যু ঘটে৷ কিন্তু বাল্যবিবাহের এসব কুফল সম্পর্কে কতজন জানে? বিশেষ করে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের বেশির ভাগই এসব তথ্য জানে না। তাদের পাঠ্যসূচিতে নেই বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে কোনো অধ্যায়। এখন সময় হয়েছে শিশু, কিশোর, কিশোরীদের এসব জানানোর। তারা যদি এসব তথ্য না জানে, তাহলে প্রতিবাদ করবে কিসের ভিত্তিতে?
গত বছরের শেষ নাগাদ প্রকাশিত ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) এক গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গত দুই দশকে বাল্যবিবাহ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে৷ এই সময়ে বাল্যবিবাহের হার ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমে ৪৩ শতাংশ হয়েছে৷ কিন্তু এই ফলাফলে আমাদের আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই। এই ৪৩ শতাংশ কোনো অংশে কম নয়। সর্বনাশা এই বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে এখন সবাইকে। শারমিন আক্তারের বাবা, দাদি, ফুফু যেভাবে শারমিনের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তেমনি আমাদের সবাইকে আমাদের সন্তানদের পাশে দাঁড়াতে হবে। শুধু বাল্যবিবাহ নয়, যেকোনো অন্যায় সিদ্ধান্ত, অনাচারের বিরুদ্ধে যাতে তারা দাঁড়াতে পারে, সেই সাহস তাদের মনে জোগাতে হবে।
শারমিন বলেছে, সে চায় বাল্যবিবাহ শব্দটি যেন বাংলাদেশে না থাকে। আমরাও শারমিনের মতো করে বলতে চাই, বাল্যবিবাহ শব্দটি দেশ থেকে শেষ হয়ে যাক।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক