সব শিশুকে নিরাপদে স্কুলে ফেরাতে হবে

বিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারে শিক্ষার্থীদের হাতে জীবাণুনাশক দেয়া হচ্ছে। সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে, রংপুর
ফাইল ছবি: মঈনুল ইসলাম

এ লেখা যখন লিখছি, তখন শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাচ্ছে। পরীক্ষা দিচ্ছে। কেউবা পরীক্ষার ফলাফলের জন্য প্রতীক্ষা করছে। করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর স্কুল খুলেছে। নতুন বছরে নতুন ক্লাসের জন্য তৈরি হচ্ছেন শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক—সবাই।

স্কুল খুলে গেছে, এটা একদিকে যেমন আমাদের সবার জন্য আনন্দের বিষয়, অন্যদিকে সার্বিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে শিশুদের নিরাপদে স্কুলে ফেরানোর বিষয়টিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। করোনা সংক্রমণ থেকে শিশুদের নিরাপদ রাখতে স্কুলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি এ মুহূর্তে আমাদের মাথায় রাখতে হবে বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম আর ঝরে পড়ার ঝুঁকি কাটিয়ে শিশুদের নিয়মিতভাবে স্কুলে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি। লিখতে বসে সেই চিন্তাগুলোই ঘুরেফিরে মাথায় আসছিল। আসলেই কতটা প্রস্তুত আমরা শিশুদের নিরাপদে স্কুলে ফেরাতে?

কয়েক দিন আগে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার একটা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কয়েকজন শিশু আর অভিভাবকের সঙ্গে কথাও হলো। কথার মধ্যে দুজন মেয়েশিশু জানাল, তারা আগে স্কুলে যেত, কিন্তু এখন আর যাচ্ছে না। কারণ, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। মা-বাবা জানতেন না কবে স্কুল খুলবে। অভাবী পরিবারে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই হয়তো তাদের কাছে সবচেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে। সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় আশঙ্কাজনক হারে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির খবর বেরিয়েছে। করোনাকালে কত মেয়েশিশুর বিয়ে হয়ে গেছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। কারণ, অনেকেরই রেজিস্ট্রেশন ছাড়া বিয়ে হয়েছে, অনেককেই অন্য এলাকায় নিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিশুদের নিরাপদে স্কুলে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনায় বাল্যবিবাহ বন্ধ করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। বিবাহিত মেয়েশিশুদেরও স্কুলে ফেরাতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে।

শিশুশ্রম বিষয়টিও এ মুহূর্তে আমাদের বেশ ভাবাচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে পরিবারে অভিভাবকদের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া বা আয় কমে যাওয়ায় শিশুরা শ্রমে জড়াতে বাধ্য হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা জরিপ বলছে, দেশের দারিদ্র্য পৌঁছেছে ২২ থেকে ৩৫ শতাংশে। দারিদ্র্যকবলিত মানুষের সন্তানেরা শিক্ষা থেকে ক্রমে দূরে সরে যাবে, সেটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। সবার স্কুলে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে হবে।

এর বাইরে আরেকটি বিষয়ে খুবই যত্নবান হওয়া দরকার, তা হলো মানসিক স্বাস্থ্য। করোনার সময় প্রায় দুই বছর আমরা সবাই কমবেশি প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছি। মানসিকভাবে এ ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াটা বড়দের জন্য যেমন কঠিন, শিশুদের জন্য তা আরও চ্যালেঞ্জিং। করোনার আগে ২৪ ঘণ্টা একসঙ্গে একটি ঘরে থাকার অভ্যস্ততা সবার ছিল না। নিম্ন আয়ের মানুষ এক ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হয়েছে। ফলে সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই সহিংসতা বা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, যার শিকার হয়েছে শিশুরা। এ সময় শিশুরা এমন কিছু মানসিক সমস্যার শিকার হয়েছে, যার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। তার ওপর স্কুলে যেতে না পারা, বাইরে বেরোতে না পারা, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে না পারা কিংবা করোনা নিয়ে আতঙ্কে থাকা—এসব কিছুই শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেওয়াটা তাই খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে স্কুলে কাউন্সেলিংয়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা জরুরি। সব স্কুলে সব ক্ষেত্রে বাস্তবে সম্ভব না হলে অন্তত অনলাইনে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের যুক্ত করে মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।

মানসম্মত শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে পড়ালেখা থেকেই দূরে ছিল বেশির ভাগ শিক্ষার্থী। তাদের অনেকেই এখন স্কুলে গিয়ে পড়ালেখার সঙ্গে নিজেকে আর খাপ খাওয়াতে পারছে না। অনেক শিক্ষার্থী লিখতে ভুলে গেছে। অনেক শিক্ষার্থী পড়তে ভুলে গেছে। এই শিক্ষার্থীদের আবার পড়ালেখার মধ্যে ফেরাতে হবে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করতে হবে।

পত্রপত্রিকার সংবাদে উঠে আসছে, এখনো দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা নেই, সামাজিক দূরত্ব মেনে ক্লাস করার সুযোগ নেই, শিক্ষাকে আনন্দময় করার ব্যবস্থা নেই। এসব চ্যালেঞ্জ আমাদের ভাবাচ্ছে। শিক্ষার উপকরণ, শিক্ষাপদ্ধতির ক্ষেত্রে ভিন্নভাবে সক্ষম শিশুদের কথাও মাথায় রাখতে হবে। তাদের ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি কাজ করবে না। তাদের জন্য আলাদা কিছু করতে হবে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য আলাদা কাজ করা প্রয়োজন। প্রান্তিক শিশুদের কথা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করলে সবাই উপকৃত হবে।

শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনতে সরকারের উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। এখন প্রয়োজন উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে সমন্বিত প্রচেষ্টা আর সেই সঙ্গে নতুন কী কী উদ্যোগ নিতে হবে, তা পরিকল্পনায় নিয়ে আসা। সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক ও দেশীয় উন্নয়ন সংস্থাগুলো এক হয়ে শুরু করেছে ‘নিরাপদ ইশকুলে ফিরি’ প্রচারাভিযান। শিক্ষামন্ত্রী এ কার্যক্রম উদ্বোধন করেছিলেন। ২১টি উন্নয়ন সংস্থা বর্তমানে এ প্রচারাভিযানের আওতায় একযোগে কাজ করছে। আমরা সবাই মিলে সরকারের পাশে থাকার চেষ্টা করছি। শিশুরা যেন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, সে জন্য আমরা কাজ করছি। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন। সবাই যেন শিক্ষার আওতায় আসে ও মানসম্মত শিক্ষা পায়, সে জন্য আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

সরকার সব শিশুর জন্য নতুন বই ছাপানোর ব্যবস্থা করেছে। সবার হাতে নতুন বই পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ২০২২ সাল শিক্ষার্থীর কলরবে স্কুলগুলো ভরে উঠুক। শিক্ষার্থীরা নিরাপদে স্কুলে ফিরবে, এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা।

  • রিফাত বিন সাত্তার ডিরেক্টর, প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোয়ালিটি, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ