‘বানান’ ব্যাপারটাই অনেকের কাছে ঝামেলা। এই অনেকের মধ্যে আমিও একজন। স্কুলে ‘ভুল’ বানান ভুল করায় পণ্ডিত মশাই দশবার লিখিয়েছিলেন-‘জীবনে আর কখনো ভুল করিয়াও ভুল বানান ভুল করিব না।’
আরও একটা বানানও মনে আছে ভুল করতাম। ‘মুহূর্ত’। দেখা হলেই পণ্ডিত মশাই জিজ্ঞাসা করতেন, ‘ওই, মুহূর্ত বানান কী?’ আমি সংক্ষেপে উত্তর দিতাম হ-এ দীর্ঘ-উ-কার। হাসতেন স্যার।
লেখক হুমায়ূন আহমদের কথা মনে পড়ছে। কেউ একবার বলেছে, বানান একটু বেশি ভুল হয়, স্যার! হুমায়ূনের উত্তর ছিল: ‘তাতে অসুবিধা কী? প্রুফ রিডার আছে কী জন্য?’
হ্যাঁ, ওই রকম একজন লেখকের পক্ষেই ওটা বলা সম্ভব। কিন্তু অন্যদের বেলায়?
একটি শব্দ ঢাকার মানুষ প্রায়ই উচ্চারণ করেন, ‘সরণি’। যেমন বিজয় সরণি বা প্রগতি সরণি, বেগম রোকেয়া সরণি। কিন্তু ওই সব এলাকায় গিয়ে সাইনবোর্ড ইত্যাদিতে খেয়াল করেছেন কি? সরণি বানানের কী হাল হয়েছে?
আমার ধারণা, গিনেস বুক অব রেকর্ডসে স্থান পেয়ে যাবে এই বানান ভুলের রকমফেরের সংখ্যা। আমি একটু নমুনা দিই: স্মরনি, সরনি, সরনী, স্বরনী, স্মরনী, শরণি, শরণী স্বরণি, স্মরণি, স্বরণী, স্মরণী, সরণি, (শুদ্ধ) সরণী (শুদ্ধ) শরনি, শরনী। ইত্যাদি। গবেষণা করলে আরও বিভিন্ন রকম বানান পাওয়া যেতে পারে।
ইদানীং বানান নিয়ে আমরা যারা পুরোনো মানুষ, একটু বিভ্রাটে পড়ি, কারণ নতুন ধারায় অনেক দীর্ঘ ই-কার হ্রস্ব ই-আকার হয়ে গেছে। যেমন, বাড়ি, গাড়ি, শাড়ি, রানি, পাখি, শ্রেণি ইত্যাদি। এ ছাড়া বানানের আবার কিছু ঘরানা সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, আনন্দবাজার, প্রথম আলো, যায়যায়দিন ইত্যাদি।
আপনারা হয়তো ভাবছেন বানান নিয়ে পড়লাম কেন হঠাৎ। হ্যাঁ, কারণ তো একটা আছেই। সেদিন দেয়াললিখন দেখলাম একটা ‘গণতন্ত্রের ভীত মজবুত হয়েছে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানেই শেষ নয়, কেউ একজন ইটের টুকরো দিয়ে ‘ভীত’ শব্দটাকে শুদ্ধ করেছে। একটা হ্রস্ব-ই কার জুড়ে দিয়ে করেছে ‘ভীতি’। ভুলের মাশুল!
এবার চলুন বানান নিয়ে দুচারটে গালগল্প করা যাক। ইংরেজি শব্দ অ্যাটেনশনের বানান নিয়ে গল্পটা বোধকরি সবারই জানা। বানানে একটা ‘টি’ ব্যবহার করায় শিক্ষকের বকুনি খেয়ে ছাত্র বলেছিল, ‘স্যার একটা টি’ও হয়, তবে দুটো দিলে শক্ত হয়।’
এক প্রেমিক কী করেছিল শুনুন। এটা কথাসাহিত্যিক বনফুলের লেখা থেকে নিচ্ছি।
পুলিশ সুপারের মেয়ে পালিয়েছে কারও সঙ্গে। তার সু্যটকেস ঘেঁটে পাওয়া যায় প্রচুর প্রেমপত্র। বিভিন্নজনের লেখা। প্রত্যেক পত্রলেখককে গ্রেপ্তার করে হাজির করা হয় সুপারের সামনে। তার মধ্যে একজন ছিল কবি। তার লেখা পত্রটা তুলে ধরে সুপার জিজ্ঞাসা করেন: ‘এই চিঠি তুমি লিখেছ?’
‘আজ্ঞে, দেখি। হ্যাঁ, আমারই লেখা।’
‘উহ্! লেখার কী ছিরি। তুমি আমার চাঁদ।’
‘স্যার কলমটা একটু দেবেন, চাঁদের চন্দ্রবিন্দুটা মিস করে গেছি!’
আর একটা বলি।
অ্যালবার্ট নামের এক ভদ্রলোক স্ত্রীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তিনি স্বর্গের দ্বারে পৌঁছালে স্বর্গের দারোয়ান বলে, আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে তুমি ভেতরে ঢুকতে পারবে, নইলে নয়। লাভ বানান করো তো!’
‘এ তো সোজা! এল, ও, ভি, ই।’
‘যাও, ভেতরে যাও। আর শোনো, আমার ভেতরে একটু জরুরি কাজ আছে, তুমি গেটে দাঁড়াও, আমি একটু আসছি। এর মধ্যে কেউ এলে একটা প্রশ্ন করে উত্তর দিতে পারলে ভেতরে যেতে দেবে।’
ঘটনাক্রমে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার স্ত্রী কার অ্যাক্সিডেন্টে নিহত হয়ে ওই গেটে আসে। ভেতরে ঢুকতে যেতেই অ্যালবার্ট স্ত্রীকে আটকায়, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।’
‘বলো।’
‘চেকোস্লোভাকিয়া (Czechoslovakia) বানান করো দেখি?’
স্ত্রীর তো ভিমরি খাওয়ার দশা।
শেষ গল্পটা কলকাতার এক পৌর ইন্সপেক্টরের বানানভীতি নিয়ে। এই লোকটার ডিউটি ছিল প্রতিদিন কোন কোন রাস্তায় কয়টা করে বেওয়ারিশ কুকুর মারা হচ্ছে তার তালিকা পরদিন সকালে বসের কাছে লিখিতভাবে দেওয়া। বস আবার বানানের ব্যাপারে খুবই কট্টর। এদিক-ওদিক হলেই প্রচণ্ড ঝাড়ি দিয়ে থাকেন।
একদিন ইন্সপেক্টর সাহেব ডিউটি করতে গিয়ে দেখে বাঞ্ছারাম অক্রুর লেনে একটি কুকুর নিধন করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে খাতায় লিখতে গিয়েই বিপত্তি। প্রথম হোঁচট খেল বাঞ্ছারাম-এর ঞ, ছ নিয়ে। সেটা কোনোরকমে পেরোলেও ‘অক্রুর’ আর পেরোনো গেল না। ক-এ র ফলা হ্রস্ব-উর ঠোঁটটি ওপরের দিকে হবে না নিচের দিকে হবে এই গবেষণা করে ঘর্মাক্ত হয়ে ক্ষান্ত দিল ‘বাঞ্ছারাম অক্রুর’ লেখা। তারপর মরা কুকুরটার লেজ ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে ফেলল পাশের গলিতে, যার নাম ‘রামদাস লেন’। এবং খাতায় চট করে লিখে ফেলল, ‘রামদাস লেনে একটা কুকুর মারা হয়েছে।’
আমাদের দেশের অনেক সমস্যাকেই আজকাল লেজ ধরে টেনে নিয়ে ফেলা হচ্ছে রামদাস লেনে।
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।