সম্প্রীতি ও উন্নয়নের জন্য সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য

গারো জাতিগোষ্ঠীর উৎসব
ছবি: আশরাফুল আলম

গত ২১ মে ছিল সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য দিবস। ২০০১ সালে ইউনেসকো সর্বজনীন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে। পরের বছর ২০০২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৫৭/২৪৯ রেজল্যুশনের মাধ্যমে ২১ মে ‘ওয়ার্ল্ড ডে ফর কালচারাল ডাইভার্সিটি ফর ডায়ালগ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ হিসেবে ঘোষিত হয়। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে গুরুত্বপূর্ণ দিবসটি উপেক্ষিত রয়ে গেছে। অনেক শিক্ষিত মানুষ এ বিষয়ে অবগত বলে আমার মনে হয় না। পরে ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল সময়কে জাতিসংঘ ‘সংস্কৃতির সম্প্রীতি দশক’ ঘোষণা করে, যেখানে পারস্পরিক বোঝাপড়াকে বিকশিত করা এবং জ্ঞান, সংস্কৃতি, নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

কেন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য গুরুত্বপূর্ণ—এই প্রশ্নের উত্তরে ইউনেসকো বলেছে, পৃথিবীর বড় বড় সংঘাতের ৪ ভাগের ৩ ভাগই সাংস্কৃতিক সংঘাত থেকে সৃষ্ট। সংস্কৃতির কারণে যে ব্যবধান রচিত হয়, তার দ্রুত নিরসন হওয়া জরুরি শান্তি, স্থিতি ও উন্নয়নের জন্য। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উন্নয়নের চালিকা শক্তি। এটি শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং মানুষের আধ্যাত্মিক, আবেগ, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এমন একটি সম্পদ, যা দারিদ্র্য দূরীকরণ ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্য অবশ্যপ্রয়োজনীয়। একই সঙ্গে ইউনেসকো বলছে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য শুধু স্বীকৃতি প্রদানই যথেষ্ট নয়, একে গ্রহণ ও উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের বিকাশ সাধন করতে হবে। এ জন্য মিডিয়া ও তথ্যপ্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

উন্নয়ন ও শান্তির জন্য একে অন্যকে শ্রদ্ধা ও সম্মান না করে আমাদের উপায় নেই। পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্যই মানবসমাজকে এই ভিন্নতাকে স্বীকার করে নিতে হবে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও সত্যকে মেনে নিতে হবে। সরকারকে এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সমাজে সহনশীলতা ও সহমর্মিতাকে এগিয়ে নিতে হবে।

আমাদের দেশ ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জাতিবৈচিত্র্যের দেশ। লিঙ্গবৈচিত্র্য ও প্রতিবন্ধিতার বৈচিত্র্য নিয়েও আজকাল আলোচনা হচ্ছে। জোহানেসবার্গ ঘোষণাপত্রে স্লোগান ছিল, ‘আমাদের সমৃদ্ধ বৈচিত্র্য, আমাদের সম্মিলিত শক্তি।’ ইউনেসকো কনভেনশনে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বোঝার জন্য চারটি লক্ষ্য অর্জনের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো: সংস্কৃতি গঠনের জন্য টেকসই পদ্ধতিকে সহযোগিতা করা, সাংস্কৃতিক সামগ্রী ও সেবার ভারসাম্যপূর্ণ প্রবাহ অর্জন, টেকসই উন্নয়নকাঠামোতে সংস্কৃতিকে সম্পৃক্তকরণ এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার বিকশিতকরণ।

এই কনভেনশনে শুরুতে বলা হয়েছে, ‘আত্মপরিচিতি, বৈচিত্র্য ও বহুত্ব’ মানবতার সাধারণ ঐতিহ্য। মানবতার এই সাধারণ ঐতিহ্যকে (হেরিটেজ) স্বীকৃতি দিতে হবে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। এভাবে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য থেকে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের দিকে অগ্রসর হতে হবে। শুধু তা-ই নয়, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে উন্নয়নের জন্য অন্যতম ফ্যাক্টর হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশটা সুন্দর ও বৈচিত্র্যময়। এখানে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমা নদী আছে, আবার সাংগু-মাইনি-সোমেশ্বরী-সীমসাং-চেঙ্গী নদী আছে। আর স্মরণাতীত কাল ধরে আছে গারো, হাজং, সাঁওতাল, খাসিয়া, মণিপুরী, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুণ্ডা, কোচ, লুসাইসহ নানা জাতির মানুষ। এখানে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে ৫০টি আদিবাসী জাতিসত্তার স্বীকৃতি দিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট একটি সমীক্ষায় পেয়েছে, দেশে ভাষা আছে ৪১টি। এখানে বাংলা ও উর্দু বাদে বলা যায়, ৩৯টি ভাষা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের ভাষা। সরকারের এই প্রতিষ্ঠান বলছে, এদের মধ্যে কমপক্ষে ১৪টি ভাষা বিপন্ন।

বাংলাদেশ বহু জাতি, বহু ভাষাভাষী ও বহু সংস্কৃতির দেশ—এভাবে চিন্তা করলে আমাদের দেশটা সুন্দরতর হয়। বৈচিত্র্যের মধ্যে সৌন্দর্য ও ঐকতান কথাটি আমাদের জন্য প্রযোজ্য। কত জাতি, কত ভাষা, কত বর্ণ, কত সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের এক পৃথিবী।

সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উদ্‌যাপনের জন্য মানবমর্যাদার উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। সাংস্কৃতিক অধিকার অর্জন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ তৈরি করে। আবার বাক্‌স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ভাষার বহুত্ববাদ, শিল্পকলা, প্রযুক্তিজ্ঞান ও বিজ্ঞানশিক্ষায় সমান অধিকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে। সমাজে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সম্মানীয় হলে তা ফলপ্রসূ সংলাপকে সহায়তা করে ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করে। শুধু তা-ই নয়, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সমাজে সামাজিক বন্ধন, পারস্পরিক সহযোগিতা, যোগাযোগ, উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠা, সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

তাই ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যময়তাকে শক্তি হিসেবে গ্রহণ করা এবং উদ্‌যাপন করা জরুরি। বৈচিত্র্য কোনো হুমকি নয়, বরং সৌন্দর্য কথাটি সবার মধ্যে ছড়িতে দিতে হবে। মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে শ্রদ্ধাবোধ জাগানোর একটি সংস্কৃতি আমাদের গড়ে তুলতে হবে। কবি শামসুর রাহমান ‘কথা ছিল’ কবিতায় লিখেছেন, ‘প্রত্যেককে দেখাব অনিন্দ্য সূর্যোদয়।’ অন্য ধর্মের কারণে, ভিন্ন ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির কারণে কেউ যেন বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার না হন। একটি সুন্দর অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখি, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় সব ধর্মের ও সংস্কৃতির মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন, জীবন দিয়েছিলেন।

ক্যারিবীয় অঞ্চলের বিখ্যাত লেখক, রেক্স নিটলফোর্ড বলেছিলেন, আপনি ভূপৃষ্ঠের দিকে তাকান, সেখানে নানা ধরনের অনেক গাছ দেখতে পাবেন, কিন্তু সেটি অভিন্ন ভূপৃষ্ঠ বা ল্যান্ডস্কেপ। ধরিত্রী সম্পর্কে মানুষের ভাবনা এমন হওয়া উচিত। আমাদের দেশে মানুষকে, সমাজ ও সংস্কৃতিকে এই দৃষ্টিতে দেখার মানুষের সংখ্যা বাড়াতে হবে।

উন্নয়ন ও শান্তির জন্য একে অন্যকে শ্রদ্ধা ও সম্মান না করে আমাদের উপায় নেই। পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্যই মানবসমাজকে এই ভিন্নতাকে স্বীকার করে নিতে হবে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও সত্যকে মেনে নিতে হবে। সরকারকে এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সমাজে সহনশীলতা ও সহমর্মিতাকে এগিয়ে নিতে হবে। মানুষদের মধ্যে আমরা যদি সংলাপ ও আলোচনার সংস্কৃতি চালু করতে পারি, তবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সংবেদনশীল সমাজ গড়ে উঠবে।

দেশে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য দিবস চলে গেল অনেকটা নীরবে। এটি কাম্য নয়। ভবিষ্যতে আমাদের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে অনুধাবন করতে হবে।

সঞ্জীব দ্রং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী। [email protected]