৭ নভেম্বরের কুশীলবেরা কে কোথায়

৭ নভেম্বরকে এখন আর কেউ বিপ্লব বলে না। জাসদের ‘সিপাহি জনতার বিপ্লব’ এবং বিএনপির ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ সময়ের ব্যবধানে ফিকে হয়ে গেছে। কিন্তু ৭ নভেম্বর ইতিহাসের বুকে যে ক্ষত রেখে গেছে, তা সহজে উপশম হওয়ার নয়।

৭ নভেম্বর কী ঘটেছিল, জাসদ কী ঘটাতে চেয়েছিল, তার বিক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যায় বিভিন্ন বই ও পত্রপত্রিকায়। সেই সময়ের অস্থির রাজনীতি নিয়ে মহিউদ্দিন আহমদ বই লিখেছেন ‘জাসদের উত্থান-পতন’। সে সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, যিনি পরবর্তী সময় মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ একটি লিফলেট তাঁর হাতে পৌঁছায়। সে লিফলেটে লেখা ছিল, ‘সৈনিক-সৈনিক ভাই-ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই। ‘এ থেকে আমি বুঝলাম, রাতে কিছু একটা হবেই হবে। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমত, নিজে বেঁচে থাকতে হবে, দ্বিতীয়ত, সেনাবাহিনীকে বাঁচাতে হবে।’

৭ নভেম্বর প্রথম প্রহরে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হলেও বেলা ১১টার দিকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফকে তাঁর দুই সহযোগী কর্নেল নাজমুল হুদা ও লে. কর্নেল এ টি এম হায়দারসহ হত্যা করা হয়।

খালেদ মোশাররফ হত্যাকাণ্ডের বিবরণ একটি বইতে তুলে ধরেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, যিনি পরবর্তী সময় নির্বাচন কমিশনার হয়েছিলেন। ‘৭ নভেম্বর রাত ১২টার পর ঢাকা সেনানিবাস থেকে যখন সিপাহি বিপ্লবের সূচনা হয়, তখন খালেদ মোশাররফ ও অন্যরা বঙ্গভবনেই ছিলেন। এসব সংবাদ শুনে খালেদ মোশাররফ কর্নেল হুদার মাধ্যমে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক নওয়াজেশের সঙ্গে যোগাযোগ করলে নওয়াজেশের ইউনিটে তাঁদের আসার জন্য বলা হয়। কিন্তু সেটা পরে রটে যায় যে তারা আরিচা হয়ে উত্তরবঙ্গের দিকে একটি বেসামরিক গাড়িতে যাওয়ার পথে আসাদ গেটের নিকট তাদের গাড়ি বিকল হয়ে পড়লে তারা নিকটস্থ একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে কাপড় বদলিয়ে ১০ ইস্ট বেঙ্গলের দিকে হেঁটে অধিনায়কের অফিসে পৌঁছায়। ভোরের দিকে জিয়াউর রহমান খালেদ মোশাররফের অবস্থান জানার পর তার সঙ্গে কথা বলেন এবং দুজনের মধ্যে কিছু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। পরে জিয়াউর রহমান নওয়াজেশকে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেন। এ কথা মরহুম নওয়াজেশ নিজেই আমাকে বলেছিলেন। নওয়াজেশ সকালে তাদের জন্য নাশতার বন্দোবস্ত করে এবং তার বর্ণনামতে এ সময় খালেদ মোশাররফ অত্যন্ত স্বাভাবিক ও শান্ত ছিলেন। তবে কর্নেল হুদা ও হায়দার কিছুটা শঙ্কিত হয়ে উঠলে খালেদ মোশাররফ তাদেরকে স্বাভাবিক সুরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বলেন। ইতিমধ্যে সেনানিবাস থেকে কিছু বিপ্লবী সৈনিক ১০ ইস্ট বেঙ্গলের লাইনে এসে সেখানকার সৈনিকদের বিপ্লবের সপক্ষে উত্তেজিত করতে থাকে এবং খালেদ মোশাররফ ও তার সহযোগীদের হস্তান্তরের জন্য অধিনায়কের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। নওয়াজেশ উত্তেজিত সৈনিকদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এর কিছুক্ষণ পর কিছুসংখ্যক সৈনিক অধিনায়কের অফিসের দরজা একপ্রকার ভেঙে তিনজনকেই বাইরে মাঠে নিয়ে এসে গুলি করে হত্যা করে।’ (‘বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায়: ১৯৭৫-৮১’)

১৯৭৬ সালে বিশেষ সামরিক আদালতে যে বিচারের মাধ্যমে কর্নেল আবু তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়, সেই বিচারকে ২০১১ সালে উচ্চ আদালত অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করেছেন। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার আবু তাহেরের অপহৃত মর্যাদাও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এ রায়ের মধ্য দিয়ে পঁচাত্তরের কথিত সিপাহি বিপ্লবসৃষ্ট বিতর্কের অবসান হয়নি। তথ্য-প্রমাণে দেখতে পাই, সেদিন সিপাহি-জনতার বিপ্লব ও জাতীয় সংহতি ঘটেছিল দুই পক্ষের অভিন্ন শত্রু ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে।

৭ নভেম্বরের কুশীলবদের ভাষায় তিনি ছিলেন ‘সম্প্রসারণবাদী রুশ এবং আধিপত্যবাদী ভারতের’ মিত্র। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী ও ঘাতকদের বিরুদ্ধে যখন খালেদ মোশাররফ পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটালেন, তখনই ৭ নভেম্বরের কুশীলবেরা তাঁর বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আদালতে দেওয়া কর্নেল আবু তাহেরের জবানবন্দিতে ছিল: ‘ওই দিন (৩ নভেম্বর) বহু সেনাসদস্য, এনসিও এবং বেসিও আমার নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে এলেন। তাঁরা আমাকে জানালেন, ভারত খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে মদদ জুগিয়েছে এবং বাকশালের সমর্থকেরা আবার ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে।’এরপর তিনি বলছেন, ‘৩ নভেম্বরের পর জাতি কী ভয়ংকর ও নৈরাজ্য পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তা কারওই অজানা নয়। আমাদের জাতীয় সম্মান ও সার্বভৌমত্ব কীভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সময় জনগণের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ভারত খালেদ মোশাররফকে মদদ দিচ্ছিল।’

৩ নভেম্বরের পর সেনানিবাসের ভেতরে ও বাইরে কেউ একটি গুলি ছুড়েছে, কিংবা কেউ কারও হাতে নিহত হয়েছে-এ দাবি কেউ করতে পারবেন না। তাহলে পরিস্থিতি ভয়ংকর হলো কীভাবে?

১৫ আগস্ট রশীদ-ফারুক চক্র সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরও দেশে কোনো ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন না ৭ নভেম্বরের কুশীলবরা। তাঁদের সঙ্গে ফারুক-রশীদ চক্রের একেবারে যোগাযোগ ছিল না, তা-ও বলা যাবে না। কর্নেল রশীদের একজন প্রতিনিধি ফোনে মুজিব হত্যার খবর দিয়ে তাহেরকে বাংলাদেশ বেতার ভবনে যেতে বলেন। তাহেরের ভাষ্য: ‘আমি তখন রেডিও চালিয়ে দিয়ে জানতে পেলাম শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা দখল করেছেন। এ খবর শুনে আমি যথেষ্ট আঘাত পাই। আমার মনে হলো, এতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে।...১৭ আগস্ট পরিষ্কার হয়ে গেল যে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান এ ঘটনার নেপথ্য নায়ক।’ (অসমাপ্ত বিপ্লব, লরেন্স লিফশুলজ, ঢাকা, বাংলা ভাষান্তর)

অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘মোশতাক সরকার জনগণকে মুজিব সরকারের চেয়ে কোনো ভালো বিকল্প উপহার দিতে পারেনি। পরিবর্তন হয়েছিল শুধু রুশ-ভারতের প্রভাববলয় থেকে মুক্ত হয়ে দেশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষপুটে ঝুঁকে পড়েছিল। সত্যিকার অর্থে দেশ বেসামরিক একনায়কতন্ত্র থেকে সামরিক একনায়কতন্ত্রের কবলে পড়েছিল।’ (সূত্র: ওই)

তাঁর ভাষায় দেশ যখন ‘বেসামরিক একনায়কতন্ত্রের’ কবলে ছিল, তখন সেই সরকারের পতন ঘটাতে ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান ঘটানোর ডাক দিল জাসদ। কিন্তু সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে তারা কিছুই করল না, কেবল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকল এবং পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষা করল। তারা মোশতাকের ‘সামরিক একনায়কতন্ত্রের’ প্রধান সেনাপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলল। তাঁকে পরামর্শ দিল খালেদ মোশাররফকে কোনো দায়িত্ব না দেওয়ার। (সূত্র: ওই)

মার্কিন সাংবাদিক ও তাহেরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু লরেন্স লিফশুলজ লিখেছেন, ‘মুজিব উৎখাতের কয়েক মাস আগে থেকে জাসদ এক গণ-অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। স্বাধীনতাযুদ্ধের সাবেক সৈনিক সমবায়ে গঠিত বিপ্লবী গণবাহিনী ও কার্যরত সৈনিকদের গোপন সংগঠন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা; জাসদের এই দুই সশস্ত্র শাখা নিয়ে গোপন সামরিক অধিনায়ক তাহেরের নেতৃত্বে এই প্রস্তুতি চলছিল।’ (অসমাপ্ত বিপ্লবী, লিফশুলজ, পৃষ্ঠা ১৯, বাংলা সংস্করণ)

জনগণকে বাদ দিয়ে সেনানিবাসকেন্দ্রিক গণ-অভ্যুত্থানের প্রস্তুতির দ্বিতীয় নজির পৃথিবীতে নেই, সামরিক অভ্যুত্থানের অসংখ্য নজির আছে। বাংলাদেশেও পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর একটি প্রাণঘাতী সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, কোনো বিপ্লব নয়। কর্নেল তাহের খালেদ মোশাররফকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করলেও খন্দকার মোশতাকের নিয়োগপ্রাপ্ত বিমানবাহিনীর প্রধান এম জি তোয়াবের ব্যাপারে কোনো বিরূপ মন্তব্য করেননি। খালেদ মোশাররফকে উৎখাত করার পর তিনি ভবিষ্যৎ জাতীয় সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে যে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন, তাতে অন্যদের মধ্যে এম জি তাওয়াব ও মাহবুব আলম চাষীও ছিলেন।

এর আগে ৪, ৫ ও ৬ নভেম্বর প্রতিদিন রাতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও গণবাহিনী নেতাদের সঙ্গে তাহেরের বৈঠক হতো। এসব বৈঠকে খালেদ মোশাররফ চক্রকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা, বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা, বিপ্লবী সামরিক কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা, দলমত-নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তিদান, রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার, বাকশালকে বাদ দিয়ে একটি সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করা এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত হয়।

খালেদ মোশাররফ কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী ছয় মেজরের বাড়াবাড়ি রোধ এবং সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে রুশ-ভারত দূরের কথা, দেশেরও কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতার সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে জানা যায় না। অনেকের মনে থাকার কথা, খালেদ মোশাররফ যে তিন দিন ক্ষমতায় ছিলেন, ছায়াসঙ্গীর মতো ছিলেন সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খান ও শাহাদত চৌধুরী। তাঁরা কেউ ভারত বা রুশপন্থী ছিলেন না। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন কর্নেল শাফায়েত জামিল। এর আগে শাফায়েত জামিল জিয়ার কাছেও চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি রাজি হননি। খালেদ মোশাররফ রাজি হয়েছিলেন। শাফয়েত জামিলের সাক্ষ্য: ‘৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা, ১৫ আগস্টের বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের বিচার, সংবিধানবহির্ভূত অবৈধ সরকারের অবসান এবং একজন নিরপেক্ষ সৈনিকের অধীনে ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা।’

৬ নভেম্বরের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বাসভবনে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠছি, তখন ব্রিগেড মেজর হাফিজ আমাকে বলল, স্যার, একটা জরুরি কথা আছে। হাফিজ জানাল, একজন প্রবীণ জেসিও বলেছে, ওই দিন রাত ১২টায় সিপাহিরা বিদ্রোহ করবে। জাসদ ও সৈনিক সংস্থার আহ্বানেই তারা এটা করবে। খালেদ ও আমাকে মেরে ফেলার নির্দেশও সৈনিকদের দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে জিওসিটি।’ [একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর]

৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থান বা কথিত বিপ্লব প্রয়াসের কুশীলবেরা এখন কে কোথায় সেটি বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। অভ্যুত্থানের দুই প্রধান কুশীলব জিয়াউর রহমান ও কর্নেল আবু তাহের বেঁচে নেই। তাহের বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে তাঁর (জিয়া) জনপ্রিয়তার কারণে। কিন্তু তাহের ও জাসদ যে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন করেছিল, তার সদস্যরা বিপ্লবের প্রথম প্রহরেই ‘সৈনিক সৈনিক, ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’ স্লোগান তোলেন এবং ১২জন অফিসারকে হত্যা করেন।

এ অবস্থায় জিয়াউর রহমানের কাছে একটি পথই খোলা ছিল, হয় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার দাবি মেনে নিয়ে সেনাবাহিনীকে ‘অফিসারমুক্ত’ করা অথবা সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। তিনি দ্বিতীয়টি বেছে নেন এবং জাসদ ও সৈনিক সংস্থার বিপ্লব সেখানেই শেষ।

পরবর্তী সময় জিয়া তাঁর ক্ষমতা নিষ্কণ্টক করতে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে তাহেরকে ফাঁসি দেন। তার আগে তাহেরও জিয়াকে উৎখাতের চেষ্টা করেছিলেন। ক্ষমতার লড়াইয়ে জিয়া জয়ী হন, তাহেরকে জীবন দিতে হয়। যেই মামলায় তাহেরের ফাঁসি হয়েছিল, সেই মামলায় সিরাজুল আলম খান ও এম এ জলিলের যাবজ্জীবন এবং আ স ম রব, হাসানুল হক ইনু, আখলাকুর রহমান, আনোয়ার হোসেন ও নুরুল আম্বিয়ার বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু তাঁদের কাউকেই পুরো মেয়াদে জেল খাটতে হয়নি। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে জেল থেকে নেতারা সমঝোতার ভিত্তিতে ছাড়া পান। সবশেষে ছাড়া পান জাসদের তাত্ত্বিক গুরু সিরাজুল আলম খান। তাহেরকে ফাঁসি দেওয়ার চার বছরের মাথায় ১৯৮০ সালে জাসদ যে ১৮ দফা কর্মসূচি দেয়, তাতে শর্তসাপেক্ষে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঐক্য এবং সরকারে যোগদানের কথাও ছিল। ১৮ দফা প্রশ্নে মতভেদের কারণে জাসদ ভেঙে বাসদ প্রতিষ্ঠিত হয়।

৭ নভেম্বরের ঘটনায় যেসব রাজনৈতিক নেতা বিপ্লব বাসনা বা ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা এখন স্পষ্ট দুই শিবিরে বিভক্ত। আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, আবদুল মালেক রতন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নামে বিএনপি শিবিরে, যদিও প্রথমজন শেখ হাসিনার প্রথম মন্ত্রিসভায় পাঁচ বছর মন্ত্রিত্ব করেছেন, দ্বিতীয়জন ৮ বছর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও নগর নেতা আবদুস সালামও এক সময়ে জাসদে সক্রিয় ছিলেন।

আবার হাসানুল হক ইনু, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, আনোয়ার হোসেন ১৪ দলের নামে আওয়ামী লীগ শিবিরে আছেন। প্রথমজন বর্তমান মন্ত্রিসভায় তথ্যমন্ত্রী । মন্ত্রিসভার অপর সদস্য শাজাহান খান মাদারিপুর গণবাহিনীর নেতা ছিলেন। তাহেরের ছোট ভাই ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল এখন আওয়ামী লীগের সাংসদ। আরেক ভাই ২৬ নভেম্বর ১৯৭৫-এ ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণ করতে গিয়ে নিহত হন।

১৯৭৫ সালের সাত নভেম্বর যারা সিপাহী বিপ্লব করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে ‘তাহের হত্যাকারী’ জিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের অনেকে এখন আওয়ামী লীগের কিংবা বিএনপির সঙ্গে নিজেদের ভাগ্য বেঁধে ফেলেছেন। বিপ্লব ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র পেছনে ফেলে তারা ক্ষমতার হিস্যা নিতেই তারা এ দলে ও দলে ভাগ হয়ে আছেন। কিন্তু তাঁদের তাত্ত্বিক গুরু সিরাজুল আলম খান পাঁচ শ আসনের সংসদ নিয়ে বেশ কিছু কাল হই চই করে এখন রাজনীতি থেকে পুরোপুরি ‘অবসর’ নিয়েছেন।