সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কি গণমাধ্যমের জন্য হুমকি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গণতন্ত্রের এই মূল্যবোধগুলোকে হঠাৎ একটা কঠিন পরীক্ষার ভেতর ফেলে দিয়েছে।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যদি ক্ষতিগ্রস্ত বা বাধাগ্রস্ত হয়, তবে তা স্বাভাবিক গণতন্ত্রের জন্য এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য ভয়ংকর হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সংবাদপত্রও তো অনেক সময় নিরপেক্ষ থাকে না। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের সময় সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে সংবাদমাধ্যমের সমর্থন করার সংস্কৃতি যুক্তরাজ্যের মতো গণতন্ত্রের স্বর্গে অনেক দিন ধরেই চালু। তবুও কখনো কি সংবাদপত্রকে গণতন্ত্রের মুখোমুখি করা হয়েছে? হয়নি বা যায়নি। কারণ, সংবাদপত্র সংবাদনির্ভর প্রতিষ্ঠান। প্রকাশিত সংবাদের দায় প্রতিষ্ঠানকে নিতে হয়। পেশাদার সংবাদকর্মীরা সেখানে কাজ করেন। যেকোনো একটা ঘটনা শুধু কারও ব্যক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দের হিসেবে (সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষায় লাইক, মন্তব্য কিংবা শেয়ারের কারণে) সংবাদ হয়ে ওঠে না।

আস্থা, তথ্যবহুল মতবিনিময়, সত্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা, পারস্পরিক সম্মতি এবং জনসাধারণের স্বাভাবিক অংশগ্রহণ—এই হলো গণতন্ত্রের মৌলিক মূল্যবোধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গণতন্ত্রের এই মূল্যবোধগুলোকে হঠাৎ একটা কঠিন পরীক্ষার ভেতর ফেলে দিয়েছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গণতন্ত্রের কিছু কিছু গুণকে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু কেউ কেউ আবার এই ‘কিছু কিছু নিয়ন্ত্রিত গুণাবলি’কে গণতন্ত্রের প্রাণ হিসেবে ভাবার চেষ্টা করছেন। মতের প্রকাশ গণতান্ত্রিক হতে পারে, সেটি হতে পারে ভুলেরও নিদর্শন।

আমাদের মনে রাখতে হবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। গণতন্ত্র কিন্তু সে রকম কিছু নয়। আপনার স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক মতামতের জন্য আপনার নগদ প্রাপ্তির আশা নেই বললেই চলে। আপনি বলতে পারেন যে ৫০০-১০০০ নোটের বিনিময়ে আপনি ভোট দিয়েছেন। কিন্তু সেটা যে ভোট কিংবা ভোটের গণতান্ত্রিক প্রয়োগ নয়, তা বোঝার জন্য আপনাকে কোনো সংবাদপত্রে কলাম লিখতে হবে না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা এবং উপার্জন এখন এতটাই বেড়েছে যে শীর্ষ ধনীর তালিকায় সেগুলোর মালিকদের নাম হরহামেশাই উঠে আসছে। বর্তমানে ফেসবুকের দখলে আছে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশের ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজার এবং গোটা পৃথিবীতে ফেসবুকের দখলে আছে ৮ শতাংশের ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজার। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই বাজার এবং এই দখলবাজি গত চার বছর মোটামুটি একই রকম অবস্থায় আছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা এবং উপার্জন এখন এতটাই বেড়েছে যে শীর্ষ ধনীর তালিকায় সেগুলোর মালিকদের নাম হরহামেশাই উঠে আসছে। বর্তমানে ফেসবুকের দখলে আছে যুক্তরাষ্ট্রের ২০ শতাংশের ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজার এবং গোটা পৃথিবীতে ফেসবুকের দখলে আছে ৮ শতাংশের ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের বাজার। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই বাজার এবং এই দখলবাজি গত চার বছর মোটামুটি একই রকম অবস্থায় আছে।

রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার কথা বিবেচনা করলে বলা যায় সংসদীয় গণতন্ত্র এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফল এবং জনপ্রিয় ব্যবস্থা। আপনি বলতে পারেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও তো জনপ্রিয়। হ্যাঁ, অবশ্যই। তবে এই জনপ্রিয়তার মূল কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করতে আপনাকে কোনো পয়সা গুনতে হয় না। উপরন্তু আপনি এই প্ল্যাটফর্ম থেকে অর্থ উপার্জনও করতে পারেন। এই যে বিনা মূল্য, এটাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম মূলনীতি।

জনপ্রিয়তার আরও একটি মূল কারণ হিসেবে আপনি হয়তো বলবেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই হাজারো মানুষের সঙ্গে সহজে অবাধ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা যায়। কিন্তু ব্যক্তিগত যোগাযোগের বাইরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ একে অন্যের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ করে বা কথা বলে কি? সাধারণত মানুষ যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো পোস্ট দেয় বা মন্তব্য করে তখন তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য থাকে সেই মন্তব্যটি সবাই পড়ুক এবং দ্রুত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাক। এই ‘সবাই পড়ুক’ এবং ‘সবাইকে পড়াতে চাই’ ধারণা দিয়ে কি কোনো গঠনমূলক আলোচনা দাঁড় করানো সম্ভব? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতিও বৈষম্যমূলক, গণতন্ত্রের মতো সর্বজনীন নয়। সহজ করে বললে, গণমানুষের জন্য যে গণতান্ত্রিক ধারণা তা সিরিয়ার রাকাহ থেকে বাংলাদেশের ঢাকা পর্যন্ত একই রকম। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ নিয়ম মেনে চলে। যেহেতু তুরস্কে ব্লাসফেমি আইন আছে তাই ফেসবুক সেখানে শার্লি হেব্দোর কোনো ধর্মীয় কার্টুন প্রকাশ করতে দেয় না। কিন্তু ফ্রান্সের ক্ষেত্রে তাদের এ নিয়ম পুরোপুরি উল্টো।

গঠনগত দিক থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হলো ‘কমিউনিকেটিভ ক্যাপিটালিজমের’ একটি পণ্য। প্রতিষ্ঠানগুলোর লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন, চিন্তা-চেতনাকে কনটেন্টে রূপান্তরিত করে সেই কনটেন্ট থেকে অর্থ উপার্জন অথবা আরও পুঁজি সংগঠিত করা। ফেসবুকের অ্যালগরিদমকে ভয়ংকর হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কারণ, এ অ্যালগরিদম ব্যবহার করে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

সংবাদপত্র, রেডিও, টিভি—এসব গণমাধ্যমকে আমরা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি মনে করিনি। কারণ, তাদের যেই রাজনৈতিক অবস্থানই থাকুক না কেন, ঢালাওভাবে কারও সাফাই গাওয়ার সুযোগ তাদের তেমন একটা নেই। কারণ, সংবাদের জন্য পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এককভাবে রাত-দিন একটা পত্রিকা কিংবা টিভি চ্যানেলের ওপর নির্ভর করে না। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে, ফেসবুক পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের তথ্যের প্রাথমিক জোগানদাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

আপনি যদি নিজেকে প্রশ্ন করেন এই বলে যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আপনি কেন ব্যবহার করেন বা আপনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী করেন? তার সহজ উত্তর হলো আপনি মূলত ‘তথ্য বা কনটেন্ট’ কনজিউম বা ক্রিয়েট করার জন্যই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শরণাপন্ন হন। মোটামুটিভাবে বলা যায় কিছু ব্যতিক্রম বাদে আপনি আর দশজন মানুষের মতোই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চব্বিশ ঘণ্টার অবৈতনিক শ্রমিক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তো নির্ধারিত কর্মঘণ্টা এবং ন্যূনতম আয়ের ধারণা আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ধারণাতে এ রকম কোনো কিছুরই কোনো অস্তিত্ব নেই।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানুষকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসহ যেকোনো ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার জন্য আকর্ষণীয় প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্নকারীদের সামাজিক ও ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তার ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে তৈরি হওয়া নিরাপত্তা ঝুঁকি খুবই সংগোপনে এবং নিঃশব্দে সংঘটিত হচ্ছে। আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার আগে বা ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণের শিকার হওয়ার আগে ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে তা অনুধাবন করাই কঠিন হয়ে পড়ছে।

আগের যুক্তিতে ফেরত যাই। সংবাদপত্র, রেডিও, টিভি—এসব গণমাধ্যমকে আমরা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি মনে করিনি। কারণ, তাদের যেই রাজনৈতিক অবস্থানই থাকুক না কেন, ঢালাওভাবে কারও সাফাই গাওয়ার সুযোগ তাদের তেমন একটা নেই। কারণ, সংবাদের জন্য পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ এককভাবে রাত-দিন একটা পত্রিকা কিংবা টিভি চ্যানেলের ওপর নির্ভর করে না। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে, ফেসবুক পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের তথ্যের প্রাথমিক জোগানদাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ফেসবুকের সক্রিয় ব্যবহারকারী বর্তমানে প্রায় ২ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন।

পৃথিবীতে ফেসবুক হচ্ছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সংবাদ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, যাদের না আছে কোনো সত্যিকারের নিউজ রুম, না আছে দায়িত্বশীল সম্পাদক।

প্রফেসর রবার্ট ই গুডিন তাঁর ‘ডেমোক্রেটিক ডেলিবারেশন উইদইন’ নিবন্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে আখ্যায়িত করেছেন ‘ব্লিংকারড ডেলিবারেশন’ বা ‘সংকীর্ণ মতামত’ প্রকাশের জায়গা হিসেবে। তিনি আরও জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোনোভাবেই গণমানুষের চিন্তাকে প্রতিফলিত করে না, বরং তা জনগণের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট চিন্তাকে উপস্থাপন করে। ডগলাস কেলনার মনে করেন, শুধু এই সীমাবদ্ধতার কারণেই ইন্টারনেট দুনিয়া সাধারণ মানুষের দুনিয়া হতে পারেনি।

একটা সময় ছিল যখন বই বা সংবাদমাধ্যম ছিল আমাদের রেফারেন্সের আশ্রয়স্থল। মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যের সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠতার সম্পর্ক ছিল। তথ্যকে বস্তুনিষ্ঠতার বৈতরণি পার হতেই হতো এবং সেই তথ্যকে জ্ঞানে পরিণত হওয়ার আগে কিছু নির্দিষ্ট পথও পারি দিতে হতো। এই আচরণ ছিল আমাদের তথ্য ব্যবহারেরই সংস্কৃতির অংশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই সভ্যতায় সেই সংস্কৃতির আদতে কিন্তু কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কিন্তু এখন আমাদের জ্ঞানের প্রাথমিক উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ফেসবুক, টুইটারের মতো প্রতিষ্ঠান। আমরা আমাদের স্বাভাবিক বিচার, বিবেচনাবোধ এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। এমনকি রোগের চিকিৎসার মতো গুরুতর বিষয়ও বাদ যাচ্ছে না।

প্রশ্ন ছিল গণতন্ত্র কি আক্রান্ত হচ্ছে? উত্তরে আরও বিতর্ক কিংবা আলোচনার সুযোগ আছে। কিন্তু উদাহরণ দেওয়াই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত এখানে। প্রশ্ন করুন ‘ব্রেক্সিট’ ভোটাভুটির আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘রাশিয়ান প্রপাগান্ডা’র ভূমিকা নিয়ে। আরও বড় প্রশ্নকে উদাহরণ হিসেবে আনতে চাইলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা নিয়েও আলোচনা করা যেতে পারে।

লেখার তথ্য এবং চিন্তা সূত্র: ভিনসেন্ট মস্কো, প্রফেসর রবার্ট ই গুডিন-এর ‘ডেমোক্রেটিক ডেলিবারেশন উইদইন’, হেইলি হাঙ এবং ডানিয়েল গেও-আভেল’র নিবন্ধ।

রিনভী তুষার যুক্তরাজ্যে কর্মরত অভিবাসন উন্নয়নকর্মী।

[email protected]