![অলংকরণ: তুলি](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2017%2F03%2F15%2Fa61ef3cb239ddc6f6c4ffbe8f634b800-58c848fd7398f.jpg?auto=format%2Ccompress)
দরিদ্র মানুষের অভাব-অনটন এবং দীর্ঘমেয়াদি দুর্দশা লাঘবের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিসমূহ সামাজিক পরিবর্তন সাধনে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ভূমিকা পালন করতে পারে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার একটি জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল (এনএসএসএস) প্রণয়ন করেছে। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের মূল উদ্দেশ্য হলো সম্পদের আরও দক্ষ ও কার্যকর ব্যবহার, মজবুত সেবা প্রদানের কাঠামো প্রতিষ্ঠা এবং সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র ও ঝুঁকিগ্রস্ত সদস্যদের অগ্রাধিকার দিয়ে জীবনচক্রীয় সমস্যাবলি কার্যকরভাবে মোকাবিলায় সক্ষম একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলা।
দরিদ্র নারী ও পুরুষের ঝুঁকি বা সমস্যা এক রকম নয়। যেমন পুষ্টি, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য, জনসেবা, অর্থনীতি, বাজারব্যবস্থা, কর্মসংস্থান ইত্যাদিতে বৈষম্যের শিকার হওয়া নারীদের জন্য একটি বিশেষ সমস্যা। কিশোরী মেয়েদের পরিবারের জন্য উপার্জন করতে বা বিভিন্ন প্রকার গৃহস্থালির ও পরিচর্যামূলক কাজের (ছোট ভাইবোন বা প্রতিবন্ধী দাদা-দাদির পরিচর্যা) মতো অলিখিত কিছু পারিবারিক দায়িত্ব পালনের জন্য স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনা হয়। এরপরও যেসব মেয়ে স্কুলে টিকে থাকে, তাদের স্কুলের লেখাপড়া ও পারিবারিক দায়িত্ব পালনের দ্বিগুণ ভার বহন করতে হয়। এ ছাড়া নারীরা সীমিত চলাচল, গর্ভধারণ ও মাতৃত্ব, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, বিবাহবিচ্ছেদ বা প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য কলঙ্কের শিকার হওয়া, বৈধব্যের কারণে সম্পদহানি এবং বৃদ্ধ বয়সে ও অসুস্থ অবস্থায় পরিবারের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত কম সহায়তা পাওয়ার মতো নানা ধরনের জীবনচক্রীয় ঝুঁকির মুখোমুখি হয়ে থাকেন।
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে জীবনচক্রভিত্তিক সামাজিক সুরক্ষার ধারণা অবলম্বন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিবারের অভ্যন্তরে নারীর পরিবর্তনশীল চাহিদাসমূহ বিবেচনা করা হয়েছে। এর ফলে নারীদের আরও ভালো সেবা প্রদান ও জেন্ডার-সমতা প্রসারের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারসাধনের পথ সুগম হয়েছে। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে বিবেচিত এ ধরনের সংস্কারের মধ্যে রয়েছে:
শুধু ভাতা নয়, জ্ঞান হস্তান্তর
তথ্যপ্রমাণ থেকে দেখা যায় যে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি পরিবারের অভ্যন্তরে পুষ্টি বা শ্রমের অসম বণ্টনের মতো সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আচরণগত পরিবর্তনের জন্য সচেতনতামূলক বার্তার সমন্বয় ঘটালে তা কার্যকরভাবে সামাজিক রীতিনীতির সংস্কার সাধন করতে পারে। বাল্যবিবাহ, গর্ভধারণ ও পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক শিক্ষা এ ক্ষেত্রে বেশ সহায়ক। পারিবারিক সহিংসতা, উত্তরাধিকার আইন ও আইনগত অধিকার বিষয়ে প্রশিক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জ্ঞানই শক্তি। সচেতনতামূলক প্রচারণা ও উঠান প্রশিক্ষণ সেশনগুলোতে শুধু নারীদের অংশগ্রহণ থাকলেই হবে না, বরং কমিউনিটির সব সদস্যকে এতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানকারীদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো সরকার, বিচারব্যবস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বেসরকারি খাতসমূহ এখনো পিতৃতান্ত্রিকতা চর্চায় গভীরভাবে আটকে আছে। যদিও সংবিধানে নারীদের সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে, তবু তাঁরা নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হন। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ও বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন নারী অধিকার রক্ষায় মূল্যবান রক্ষাকবচ। এ সম্পর্কে নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণ
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে প্রদত্ত সহায়তার লক্ষ্য হতে হবে সময়ের সঙ্গে নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করা। নারীরা যখন চরম দারিদ্র্য থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটানোর চেষ্টা করেন, তখন তাঁরা যেসব বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন, সেগুলো অতিক্রম করে দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের জন্য একটি সার্বিক প্যাকেজ সহায়তা প্রদানের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হয়েছে। এককভাবে নগদ অর্থ বা সম্পদ-সহায়তা যথেষ্ট নয়। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের অগ্রগতির জন্য নারীদের প্রয়োজন অর্থ, বাজারব্যবস্থা ও আয় বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবাসমূহ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ এবং তাঁদের পরিবর্তিত অবস্থাকে টেকসই করতে প্রয়োজন একটি কার্যকর সঞ্চয় কৌশল। পল্লি অঞ্চলে ও দুর্গম এলাকায় বসবাসরত নারীদের কার্যকরভাবে সহায়তা দেওয়ার জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ডিজিটাল পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। কর্মজীবী দরিদ্র নারীরা মূলত স্বল্প দক্ষতাভিত্তিক উৎপাদন খাতে (তৈরি পোশাক খাত) অথবা অনানুষ্ঠানিক খাতে (নির্মাণকাজ বা গৃহস্থালির কাজ) কাজ করেন। তাঁদের ক্ষুদ্র উপার্জন তাঁদের সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্তির জন্য অযোগ্য করে তোলে এবং এর ফলে তাঁরা আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়েন। বেশির ভাগ কর্মক্ষেত্রে শ্রম অধিকার বা প্রজননের অধিকার, স্বাস্থ্যবিমা, মাতৃত্বকালীন সুবিধা ও শিশু পরিচর্যাব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া মর্যাদাপূর্ণ কাজের নিশ্চয়তা নেই এবং মজুরিতে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য রয়েছে।
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে বেসরকারি খাতের চাকরিদাতা কর্তৃক দিবা পরিচর্যা সেবা প্রদান ও কন্ট্রিবিউটরি প্রাইভেট পেনশন চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। এর ফলে সরকারি খাতে প্রদত্ত বিভিন্ন সুবিধা বেসরকারি খাতে ব্যাপকভাবে চালু করার জন্য বেসরকারি খাতের চাকরিদাতাদের সঙ্গে গভীর সম্পৃক্ততার প্রয়োজন হবে। কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত সংস্কারসমূহ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শ্রমবাজার গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
শিশু পরিচর্যা
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে বিভিন্ন প্রকার শিশু সহায়তা প্যাকেজ ও গর্ভবতী নারীদের জন্য পুষ্টি-সহায়তা কার্যক্রম প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে দুই লাখের চেয়ে কম নারী মাতৃত্বকালীন ভাতা ও স্তন্যদায়ী মায়েদের জন্য ভাতা—এই দুটি কর্মসূচির আওতায় সহায়তা পাচ্ছেন, অথচ এখনো প্রায় দুই কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। শৈশবে পর্যাপ্ত পুষ্টি না পেলে শিশুরা ভবিষ্যতে উৎপাদনশীল পূর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। কাজেই এ ক্ষেত্রে এখনই বিনিয়োগের পক্ষে যথেষ্ট জোরালো যুক্তি রয়েছে।
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে নগর অঞ্চলে বসবাসরত কর্মজীবী দরিদ্র নারীদের শিশু পরিচর্যা ও মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা-সহায়তা প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। এটি একটি প্রশংসাযোগ্য সুপারিশ। কারণ, বর্তমান ব্যবস্থায় নগরের দরিদ্র ব্যক্তিরা ব্যাপকভাবে অবহেলিত। এই সহায়তা শিশুশ্রম নির্মূল করতে এবং কিছুটা বয়স্ক ও কম বয়সী ছেলেমেয়েদের তত্ত্বাবধানে শিশুদের রেখে নারীদের কাজে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট ঝুঁকিসমূহ দূর করতে সাহায্য করবে।
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে শিক্ষা উপবৃত্তির আওতা ও সহায়তার পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ছেলে ও মেয়ে উভয়ের ক্ষমতায়ন করবে। তবে তথ্যপ্রমাণ থেকে দেখা যায় যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পর মেয়েরা আবারও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। বাল্যবিবাহ ও পারিবারিক সহিংসতা রোধ করতে কারিগরি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে কিশোরী মেয়েদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এই ঝুঁকিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানের জন্য সুনির্দিষ্ট সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে।
অন্যান্য সেবাপ্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধি
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিসমূহ উপকারভোগীদের স্বাস্থ্য, গৃহায়ণ, স্যানিটেশন, নিরাপদ পানি সরবরাহ ও অন্যান্য সেবা, আর্থিক ও আইনি সহায়তার মতো বিভিন্ন সেবা প্রদানকারীর সঙ্গে সংযুক্ত হতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সম্পদের অধিকারী নারীদের অন্যান্য সেবার প্রয়োজন হয়। প্রতিবন্ধী নারী ও প্রতিবন্ধী সন্তানের মায়েদের জন্য শুধু প্রতিবন্ধী ভাতাই যথেষ্ট নয়; তাঁদের স্বাস্থ্যসেবা, পারিবারিক বন্ধন, চলাচলে সহায়তা এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রয়োজন। উপকারভোগীদের সহায়তা প্রদানে এবং ইউনিয়ন কমিটিগুলোতে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের (সহায়তা প্রদানকারী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের) প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এসব চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করতে নারী ইউপি সদস্যদের অতিরিক্ত কিছু প্রশিক্ষণ ও দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে।
সামাজিক পুঁজি ও কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা
দলগত কার্যক্রম, একে অন্যের থেকে শেখা ও কমিউনিটিকে উদ্বুদ্ধকরণের মতো যেসব উপাদান সামাজিক পুঁজি গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, সেগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। দলবদ্ধভাবে কাজ করলে নারীদের জোরালো বাক্স্বাধীনতা ও দর-কষাকষির ক্ষমতা থাকে। নারীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মতামত দিলে তা আরও বেশি গুরুত্বের সঙ্গে শোনা ও বিবেচনা করার সম্ভাবনা থাকে।
ডিজিটাল পরিবীক্ষণ ব্যবস্থা
কর্মসূচির প্রভাব পরিবীক্ষণ আরও জোরদার করা ও জেন্ডার-সূচক পরিমাপ করা প্রয়োজন। কাগজপত্রভিত্তিক পরিবীক্ষণের দিন শেষ। দ্রুত ও কার্যকর ডিজিটাল পরিবীক্ষণ অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী এবং আরও বেশি কার্যকর।
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে যেমনটি প্রস্তাব করা হয়েছে, সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে জেন্ডার-সমতার প্রসার ঘটাতে হলে নারীর দৃশ্যমান ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে এমন কর্মসূচির পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণে মনোযোগের প্রয়োজন। এই লক্ষ্য সামনে রেখে একটি জেন্ডার নীতিমালা প্রণয়ন করলে তা এ ধরনের সংস্কারের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
মোহাম্মদ শফিউল আলম: মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং সভাপতি, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসমূহের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি (সিএমসি)।