সিস্টার সারা ও নারীর প্রতীকী ক্ষমতায়ন

কিছু বাংলা শব্দের পুংলিঙ্গ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যেমন, রাঁধুনি, মেয়েলিপনা, বঙ্গললনা ইত্যাদি। এ শব্দগুলো দেখতে, বলতে এবং শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় এগুলোর যে পুংলিঙ্গ হতে পারে, সে চিন্তাও বোধ করি আমাদের মনে আজ আর উদয় হয় না। সম্ভবত একটি মাত্র রচনায় ‘মেয়েলিপনা’ শব্দটির পুংলিঙ্গের ব্যবহার দেখা যায়। তা-ও আবার সেটির রচয়িতা একজন নারী সাহিত্যিক এবং সেটাও আবার আজ থেকে ১১২ বছর আগে। সিমন দ্য বোভোয়ার কিংবা জুডিথ বাটলারের জেন্ডারবিষয়ক তত্ত্ব ও রচনাবলি প্রকাশেরও বহু আগে। নারীর ক্ষমতায়ন, নারী স্বাধীনতা, নারীর অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে আজ জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে যাঁরা আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলছেন, তাঁদেরও আবির্ভাবের অনেক আগে।

সেই সাহিত্যিক চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু সে স্বাধীনতা প্রকাশে উগ্র ছিলেন না মোটেই। তিনি নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠায় আপসহীন ছিলেন, কিন্তু সে জন্য আক্রমণাত্মক হননি কখনো। তিনি সংঘবদ্ধ প্রয়াসে বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু সেই সংঘের কার্যক্রম প্রচারের মাধ্যমে মনোযোগ আকর্ষণে ব্যস্ত ছিলেন না। তিনি পুরুষকে বন্দী করার পক্ষপাতী ছিলেন না, কিন্তু নারীর মুক্তি ও অধিকারের জন্য ছিলেন নিবেদিত। শব্দচয়নের নৈপুণ্য ও দৃঢ়তা যাঁর রচনার সহজাত বৈশিষ্ট্য, রসবোধ প্রকাশে তাঁরই পারঙ্গমতায় সমসাময়িক সাহিত্যিকেরা শ্রদ্ধায় মাথা নত করতেন।

এসব বৈশিষ্ট্যের সাধারণ একটি উদাহরণ দেখা যায় তাঁর রচনায়, যেখানে লজ্জায় আড়ষ্ট সুলতানা যখন নারীস্থানে ঘরের বাইরে হাঁটতে সংকোচ করছিল, তখন সিস্টার সারা তাঁকে বললেন, এ দেশে ‘অমন পুরুষপনা চলবে না, মেয়েরা এখানে স্বাচ্ছেন্দ্যে চলাচল করে’। মেয়েলিপনা শব্দের পুংলিঙ্গের বোধ করি এই একমাত্র ব্যবহার। অবশ্য, চিন্তায় সময়ের চেয়ে অগ্রগামী এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালে তাঁর রচনায় এ সংলাপ ব্যবহার করলেও এবং পুরুষপনাকে যে অর্থে ব্যবহার করেছেন, তা বোধগম্য হলেও বাংলাদেশে ২০২০ সালে নারী ধর্ষণের ঘটনাগুলো নির্দেশ করে যে ১১২ বছর পরও এ দেশে পুরুষপনা মানে অবিনয়ী, ঔদ্ধত্যপূর্ণ, স্বেচ্ছাচারী ও আক্রমণাত্মক আচরণ, যার ভয়ে ভীত থাকতে হয় বলে মেয়েরা এখনো স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারে না।

বলছিলাম সুলতানার স্বপ্ন–এর রচয়িতা বেগম রোকেয়ার কথা। এ রচনার অন্যতম চরিত্র সিস্টার সারার জবানিতে যে অপূর্ব সাহসিকতাপূর্ণ সংলাপ শোনা যায়, তা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না এই চরিত্রের কারিগর বেগম রোকেয়া কী অসীম সাহস ও কী বিশাল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। আর মস্তিষ্কের কী অসাধারণ ব্যবহারই না করেছেন নিজের জীবনব্যাপী। ৯ ডিসেম্বর রংপুরে আজ থেকে ১৪০ বছর আগে তাঁর জন্ম। ধর্মীয় অনুশাসনের নামে ঘরের ভেতর অনেকটা বন্দী হয়ে জীবন যাপন করা ছিল সে সময়ের নারীদের জন্য বাস্তবতা। অথচ সে সময়েই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন জ্ঞানী হওয়ার, শৃঙ্খল ভাঙার, মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করে জীবনকে অর্থপূর্ণ করার। তা-ও আবার কেবল নিজের জন্য নয়, সমাজের সব নারীর জন্য। আজকের বাংলাদেশে অধিকসংখ্যক গার্মেন্টস কর্মী নারী, গুটি কয় অফিসের বস নারী, কিংবা সংসদে কিছু নারী সদস্য আছেন—নারীমুক্তি বা নারীর ক্ষমতায়নের এ রকম প্রতীকী উদাহরণে কি আমরা সন্তুষ্ট? মেধা প্রয়োগে মানবকল্যাণে ভূমিকা রাখার মতো যোগ্যতা যে তারও আছে, সে কথা কি শিশুকাল থেকে কন্যাসন্তানটিকে আমরা বুঝতে সাহায্য করি?

একটি পরাধীন দেশে নারীর ভোটাধিকার, স্বাধীন পেশা নির্বাচনের অধিকার, এমনকি উচ্চশিক্ষা অর্জনের পথও যখন ছিল রুদ্ধ, সেই সময়ে বেগম রোকেয়া এমন একটি দেশের কল্পনা করেছিলেন যেখানে রাজা নেই, আছে রানি। সুলতানার স্বপ্ন রচনায় সেই নারীর নেতৃত্বে দক্ষ হাতে রাজ্যের সব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে নারীরা। প্রযুক্তি পণ্য বা লেটেস্ট মডেলের গাড়ির বিজ্ঞাপনের মডেল হয়ে নয়, বরং ন্যায়ের প্রতিপালক হিসেবে, নগর রক্ষাকারী হিসেবে, যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা গবেষণাগারে কৌশল ও মেধা প্রয়োগে দেশ সুরক্ষার মাধ্যমে। শত্রুর সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে বরং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা সূর্যের আলো দূর থেকে শত্রু সীমান্তে নিক্ষেপ করার মাধ্যমে এ রচনার চরিত্ররা যুদ্ধ জয় করেছেন।

আজকের বাংলাদেশে অধিকসংখ্যক গার্মেন্টস কর্মী নারী, গুটি কয় অফিসের বস নারী, কিংবা সংসদে কিছু নারী সদস্য আছেন—নারীমুক্তি বা নারীর ক্ষমতায়নের এ রকম প্রতীকী উদাহরণে কি আমরা সন্তুষ্ট? মেধা প্রয়োগে মানবকল্যাণে ভূমিকা রাখার মতো যোগ্যতা যে তারও আছে, সে কথা কি শিশুকাল থেকে কন্যাসন্তানটিকে আমরা বুঝতে সাহায্য করি?

বেগম রোকেয়া মাত্র ২৯ বছর বয়সে বিধবা হলেও নিজেকে স্বামীহীন-অসহায় না ভেবে নিজের জীবনের লক্ষ্য স্থির করেছিলেন নারীশিক্ষার প্রসার। স্বামীর নামে ভাগলপুরে গার্লস স্কুলে একটি বেঞ্চ ও পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করেন অন্তহীন প্রতিকূলতার মাঝে। স্বামীর আগের পক্ষের কন্যা ও জামাতার চক্রান্তে কিছুদিন পর বাধ্য হয়েছিলেন স্কুল গুটিয়ে কলকাতায় চলে যেতে। সেখানে গিয়েও কিছুদিনের মধ্যে আবার স্কুল প্রতিষ্ঠা। এবার দুটি বেঞ্চ, আটজন ছাত্রী। সেই ছাত্রীও সংগ্রহ করতেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে। এর মধ্যে স্কুল চালানোর অর্থ রাখা ছিল যে ব্যাংকে, সেটি দেউলিয়া হয়ে গেল। এ রকম প্রতিকূলতার মধ্যেও হতাশ হননি তিনি।

এরপর হলো প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল। প্রকৃত শিক্ষা যে মানুষকে আত্মমর্যাদাশীল করে, সেই ধারণাটি তিনি প্রোথিত করেন তাঁর শিক্ষার্থীদের মাঝে। আজকে নারী স্বাধীনতা নিয়ে সভা–সমাবেশে বক্তব্য রাখতে রাখতে যাঁরা কণ্ঠ শুকিয়ে ফেলেন এবং তারপর ঘরে ফিরে স্বীয় স্বামীর হাতে নিগৃহীত হন, এই রকম নারীমুক্তি তিনি চাননি। সাংসদ হওয়ার সুবাদে একটি আসন দখল করে অবদানহীনভাবে দিন কাটিয়ে কোনো রকমে মেয়াদ পার করে দেওয়ার মতো নারীর ক্ষমতায়নও তাঁর কাঙ্ক্ষিত ছিল না। সমাজে বিশেষ করে মিডিয়াতে নারীকে পণ্য হিসেবে কিংবা ধর্মীয় কোনো কোনো নেতার বক্তব্যে নারীকে অক্ষম, অধস্তন, পরনির্ভরশীল হিসেবে উপস্থাপন করা হবে, এমন সমাজও তিনি চাননি।

‘স্ত্রী-জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে ১৯০৫ সালে তিনি লেখেন, ‘আমাদের উচিত যে, স্বহস্তে উন্নতির দ্বার উন্মুক্ত করি।’ কারণটাও পরিষ্কার ছিল তাঁর লেখায়, ‘ইহাও স্মরণ রাখা উচিত যে ঊর্ধ্বে হস্ত উত্তোলন না করিলে পতিতপাবন হাত ধরিয়া তুলিবেন না। ঈশ্বর তাহাকেই সাহায্য করেন যে নিজে নিজের সাহায্য করে।’

বেগম রোকেয়ার এগিয়ে চলার পেছনে তাঁর স্বামীর অনুপ্রেরণার কথা আমরা সবাই জানি। সুলতানার স্বপ্ন–এ সে সময়ের সমাজ ও নারীর শোচনীয় অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পুরুষপনা শব্দের ব্যাখ্যা শুনে তাঁর স্বামী বলেছিলেন, (সমাজের ওপর) এ এক ভয়ংকর প্রতিশোধ। আজকের স্বামীদের সময় হয় স্ত্রীর সৃষ্টিকে উৎসাহ দেওয়ার বা তাঁর রচনা পাঠান্তে এ রকম অন্তর্দৃষ্টিমূলক মন্তব্য করার?

জীবনটা যে অন্যের অনুগ্রহে-করুণায় কাটানোর বিষয় নয়, সে কথা কি আজকের আধুনিক অভিভাবকেরা তাঁদের কন্যাসন্তানকে বলেন? সেলেনা গোমেজ আর লেডি গাগাদের ভিড় এড়িয়ে বেগম রোকেয়াকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করা কিশোরী কন্যার জন্য কেন আজ এত কঠিন? বেগম রোকেয়ার মতিচূর গ্রন্থ, পদ্মরাগ উপন্যাস অথবা সুলতানার স্বপ্ন বিদ্যালয়গামী পুত্র-কন্যার হাতে তুলে দেন কি অভিভাবকেরা? একদিকে রোলমডেল হিসেবে বেগম রোকেয়ার মতো মহীয়সীদের সামনে তুলে ধরার অভাব, অন্যদিকে নৈতিকতা ও শুদ্ধাচারবিবর্জিত পন্থায় সন্তান প্রতিপালন, সেই সঙ্গে রাষ্ট্রে আইনের শাসনের ঘাটতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার—এসবের পরিণতিতে যা ঘটতে পারে, তার যথেষ্ট নমুনা আমরা দেখেছি ২০২০ সালে ঘটে যাওয়া একের পর এক নারী নিগ্রহের ভয়াবহ সব ঘটনায়।

বেগম রোকেয়া আক্ষরিক অর্থেই জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত নারীমুক্তির কাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর রাতে তিনি মারা যান। সে রাতেও রুটিনমাফিক কর্মব্যস্ত দিনের শেষে যথারীতি লিখছিলেন। কলম হাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। টেবিলের ওপরে পেপার ওয়েটের নিচে একটি অসমাপ্ত লেখা—নারীর অধিকার। নারীশিক্ষা প্রসার ও নারীর অধিকার নিয়ে চিন্তা-চেতনায় যে সাহিত্যিক এত অগ্রসর ছিলেন, পশ্চিমা জগতে মাত্র ৬০ বা ৭০ দশক থেকে শুরু হওয়া ফেমিনিজমের চমক লাগানো প্রবক্তাদের কাছে কেন তিনি ম্রিয়মাণ? সে আলোচনা অন্য সময়ের জন্য থাক।

আজ শুধু পরম শ্রদ্ধায় মহীয়সী বেগম রোকেয়াকে স্মরণ করি। সিস্টার সারার মাধ্যমে নিজের চেতনার কথা যিনি এত দৃঢ়তার সঙ্গে বলে গেছেন, আজকের বাংলাদেশে নারীর প্রতীকী ক্ষমতায়নের বৃত্ত ভাঙার জন্য তাঁকে বড্ড প্রয়োজন ছিল। মানুষ হিসেবে বিজয়ী বেগম রোকেয়াকে বিজয়ের মাসে তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দিবসে জানাই কৃতজ্ঞতা।

ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, এবং সমন্বয়কারী, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়