সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি: রাষ্ট্র তো যন্ত্র, কাঁপেও না কাঁদেও না!

যখন সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণে হতাহতের পাশে দাঁড়িয়েছে সাধারণ মানুষ, তখন সেখানে গিয়ে হামলার শিকার হলেন গণতন্ত্র মোর্চার নেতারা
ছবি: প্রথম আলো

সত্য নাকি আগুনের মতো। সীতাকুণ্ডের আগুনের জ্বলন্ত সত্যটা কী? ফেসবুকে দুটি ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটি হলো দুর্যোগ ও ত্রাণমন্ত্রীর খাওয়ার ছবি, বিরাট টেবিলে এলাহি আয়োজন। সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল পরিদর্শন করার পর তিনি এই ভোজে অংশ নেন বলে সেখানে দাবি করা হয়েছে। আরেকটি ছবি হচ্ছে ছাত্রলীগের হামলায় রক্তাক্ত গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান নেতা জোনায়েদ সাকির। তাঁর জোট গণতন্ত্র মোর্চার নেতাদের নিয়ে তিনি হাসপাতালে ভয়াবহ যন্ত্রণায় ভুগতে থাকা দগ্ধ মানুষদের দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সাকির পরিণতি ভোজসভার মতো হয়নি। হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আহত হন গণসংহতি আন্দোলনের চট্টগ্রাম শাখার সমন্বয়ক শ্রমিক নেতা হাসান মারুফ রুমী, গণ অধিকার পরিষদের রাশেদ খানসহ অনেকে। বিপজ্জনক রাসায়নিক রাখার তথ্য গোপনকারী বিএম ডিপোর মালিক নন, ভিলেন হলেন সাকি!

হামলাকারীদের পরিচয় হিসেবে ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শাখার অমুক গ্রুপের তমুক নেতার নাম বলা হচ্ছে না, বলা হচ্ছে খোদ ছাত্রলীগেরই কথা। এর এক দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর মিছিলেও হামলা হয়েছে। তাতে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি অনীক রায় রক্তাক্ত হয়েছেন। তাঁরাও সীতাকুণ্ডের কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছিলেন। একই আচরণ যদি কেন্দ্রীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে করা হয়, তাহলে বলতে হবে এ বিষয়ে এটাই তাঁদের দলীয় অবস্থান। যখন সাধারণ মানুষ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পাশে সুপারম্যানের মানবিকতা নিয়ে জান বাঁচাতে হাজির, তখন ছাত্রলীগ মারতে হাজির হয়েছে।

বিপদে কিছু মানুষ যায় বাঁচাতে, কিছু আসে মারতে। গত বছরের আগস্ট মাসে নারায়ণগঞ্জের হাশেম ফুডসের ভয়াবহ আগুন দেখে ছুটে আসা মানুষদের পুলিশ পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করে। পরে নাগরিক তদন্ত কমিটি দেখতে পায়, কারখানার ফটক বন্ধ থাকায় হতাহত ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পরও কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ফটক বন্ধ রাখার কথা বলেছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। আর এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলার ‘অপরাধে’ পেটানো হচ্ছে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের।

প্রশাসন ও সরকারের পরীক্ষিত সৈনিকেরা ঠিকই জানেন, কাকে বাঁচাতে হবে আর কাকে মারতে হবে। সীতাকুণ্ড বিস্ফোরণে ফায়ার ব্রিগেডের ৯ কর্মীসহ যে ৪৩ জন মানুষের দুঃসহ পরিণতি হলো, তার প্রধান দায় অবশ্যই ওই ডিপোর মালিকের। সেখানে বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্য ছিল, এই তথ্যটা গোপন করা অবশ্যই অপরাধ। কিন্তু তিনি তো চট্টগ্রাম জেলা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ! তিনি বাঁচলেই না দল বাঁচবে।

বাক্‌স্বাধীনতা ছাড়া জীবনের নিরাপত্তাও থাকে না। এ জন্যই জান ও জবানের স্বাধীনতার দাবিতে সরব হয়েছিলেন তরুণেরা। আপনি যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারেন, সুস্পষ্ট সরকারি অবহেলা, বহু প্রাণনাশের হোতাদের দলীয় দায়মুক্তির বিরুদ্ধে যদি কথা বলা না যায়, তাহলে এমন গণপ্রাণহানি বেশুমারভাবে ঘটে চলবেই। তাজরীন ফ্যাশনসে আগুনে পুড়ে অজস্র মানুষের মৃত্যুর মামলার আসামি এখন আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গসংগঠনের বড় নেতা। হাশেম ফুডসের ঘটনায় কী হয়েছে? সড়ক ও নৌপথে যে মশা-মাছির মতো মানুষ মরে, তার বিচার কতটা হয়? বরং দেখা যায়, সরকারের মন্ত্রী দোষীদের পক্ষে সাফাই গান।

তাজরীন থেকে সীতাকুণ্ডে জ্বলন্ত আগুনের সত্য এটাই যে এই দেশে যেনতেনভাবে মুনাফা করাই পবিত্র অধিকার, যেনতেনভাবে মানুষ মারার সমালোচনাই বরং পাপ। সত্য এটাই যে মানুষের জীবন এখানে দেদারে খরচযোগ্য। দেশটাকে যারা পোকামাকড়ের ঘরবসতি মনে করেন, খেটে খাওয়া মানুষ তাঁদের চোখে প্রাণীর চেয়ে বেশি কিছু না। যেন এসব মৃত্যু দুঃখজনক হলেও নিষ্ঠুর অপরাধ নয়। এই দেশে প্রধান অপরাধ একটাই তা হলো, প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করা। ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি ইমরান আহমেদ কোনো রকম সংকোচ ছাড়াই তাই বলে দিয়েছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য দেওয়ায় ছাত্র ও যুবকেরা জোনায়েদ সাকিদের প্রতিহত করেছে’। প্রতিহত করার এই দায়িত্ব তাঁদের কে দিয়েছে? কোন আইনের বলে তাঁরা এটা করেছেন? যখন তাঁরা হামলা করেন, তখন সেখানে উপস্থিত থাকা পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের কে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল? এই হামলা ও নিষ্ক্রিয়তার জন্য তাঁরা কি শাস্তি পাবেন, না পুরস্কার পাবেন?

আরও পড়ুন

প্রশাসন ও সরকারের পরীক্ষিত সৈনিকেরা ঠিকই জানেন, কাকে বাঁচাতে হবে আর কাকে মারতে হবে। সীতাকুণ্ড বিস্ফোরণে ফায়ার ব্রিগেডের ৯ কর্মীসহ যে ৪৩ জন মানুষের দুঃসহ পরিণতি হলো, তার প্রধান দায় অবশ্যই ওই ডিপোর মালিকের। সেখানে বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্য ছিল, এই তথ্যটা গোপন করা অবশ্যই অপরাধ। কিন্তু তিনি তো চট্টগ্রাম জেলা দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ! তিনি বাঁচলেই না দল বাঁচবে।

সাধারণ মানুষ যখন দ্রব্যমূল্যের আগুনে পুড়ছে, ঢাকার মহাসড়কে যখন পোশাকশ্রমিকেরা হাজির, সড়কে-কারখানায়-ডিপোতে যখন মানুষ মরছে, তখন অন্য এক আগুনের ভয়ে ভীত সরকারপন্থীরা। কোথাও যাতে জনরোষ ফেটে পড়তে না পারে, ক্ষুধার্ত আর নির্যাতিতরা যাতে জমায়েত না হন, তাঁদের হয়ে যেন বিরোধী রাজনীতিকেরা কথা না বলেন, অনিয়মের সংবাদ যাতে সাংবাদিকেরা না জানান; মানুষ যাতে সত্য বলতে ও জানতে না পারে, তার জন্য তাঁরা মরিয়া। এই রাজনীতিতে মানুষের জীবনের চেয়ে এক বোতল পানির দাম বেশি।

ঢাকা শহরে আগে একটা বাস চলতে দেখতাম। নাম ছিল জতুগৃহ। জতুগৃহ হলো মহাভারতের কাহিনির সেই ঘর, যেখানে পাণ্ডবেরা সাহায্যের আশায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, অথচ প্রতিপক্ষ শুকনা লতাপাতা-খড় দিয়ে সেটা সাজিয়ে রেখেছিল, যাতে সামান্য স্ফুলিঙ্গ থেকে আগুন লেগে সবাই মারা যান। দেশটা এখন তেমন এক জতুগৃহ হয়ে উঠছে। কে কোথায় কোন হত্যার আয়োজন করে রেখেছে, তা জানাও কঠিন, ঠেকানো আরও কঠিন। কারণ বাক্‌স্বাধীনতার অভাবে মানুষ ভালো করে বলতেও পারছে না যে ‘বাঁচাও’। বলতে পারছে না, ‘মানুষ বড় দুঃখে আছে, মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি তার পাশে দাঁড়াও’।

সমস্যা দক্ষতা বা প্রযুক্তিতে না। সমস্যা মানসিকতায়, সমস্যা বিচারহীনতায়, সমস্যা সমালোচকদের শত্রু মনে করায়। যে পদ্মা নদীতে উন্নত প্রযুক্তিতে বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ খরচে পদ্মা সেতু তৈরি করা হলো, তার নিচেই আবারও মান্ধাতার আমলের ট্রলার ডুবে অনেক মানুষ মারা যাবে। দেশে বিলাসবহুল লঞ্চ চলে ঠিকই, কিন্তু সেগুলোকে পানি কিংবা আগুনের বিপদ থেকে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা নেই। কেন নেই? কারণ, সেসব ছাড়াই দিব্যি ব্যবসা করা যাচ্ছে। কেউ তো বাধা দিচ্ছে না। সব থেকে বড় কারণ আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যেই পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশের কোটিপতিবহুল অর্থনীতির মূল জাদুটা রয়েছে সস্তা শ্রমের মধ্যে। এই সস্তা শ্রমের সরাসরি রপ্তানিকে বলা হয় মানবসম্পদ রপ্তানি, আর পণ্য বানিয়ে রপ্তানিকে বলা হয় বৈদেশিক আয়। আমাদের রিজার্ভের গর্বের গোড়ায় রয়েছে এই দাসশ্রম। খাদ্যনিরাপত্তার পেছনে রয়েছে কৃষকদের ঠকানোর সিন্ডিকেট। শ্রম যখন সস্তা তখন জীবনও সস্তা। অর্থাৎ কম মজুরি, সামান্য নিরাপত্তা; কিন্তু বেশি মুনাফা। মানুষ যা দেখে তা-ই তার মানসিকতা তৈরি করে। সস্তা শ্রমের দেশে জীবনও সস্তা ও খরচযোগ্য ভাবি আমরা। তাই এত এত মানুষের মৃত্যুতে ক্ষমতার তখত একটুও কাঁপে না, পদত্যাগ করেন না কোনো মন্ত্রী, বিচারের বাণীও থাকে হৃদয়হীন। লোভের আগুনে ৪৪ জন পুড়ে মরলেও কিছুই বদলায় না। কারণ রাষ্ট্র তো একটা যন্ত্র, যন্ত্রের কি আর বিবেক থাকে? জোনায়েদ সাকিদেরও সেই বাস্তবতা মানতে হবে, তা না হলে এমন পরিণতির জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে।

  • ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও কবি, প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক