সূর্য যখন থাকে না, তখন থাকে তারা

নেপালে অনূর্ধ্ব–১৪ এএফসি কাপে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের মেয়েরা
নেপালে অনূর্ধ্ব–১৪ এএফসি কাপে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের মেয়েরা

রবীন্দ্রনাথের একটা ইংরেজি কবিতার বই বেরিয়েছিল ১৯১৬ সালে, স্ট্রে বার্ডস। সেই কবিতার চীনা অনুবাদ নিয়ে সম্প্রতি হইচই পড়ে গেছে। অনুবাদটি অশ্লীল, অকারণ যৌনতায় ভরা—এই অভিযোগের মুখে বইটির সব কপি ফিরিয়ে নিতে হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, The world puts off its mask of vastness to its lover. It becomes small as one song, as one kiss of the eternal.
সোজা বাংলা করলে দাঁড়াবে, ‘বিশ্ব তার বিশালতার অবগুণ্ঠন উন্মোচন করে তার প্রেমিকের জন্য। তখন সেই বিশালতা একটা গানের সমান ছোট হয়ে পড়ে, হয়ে পড়ে একটা চিরন্তন চুম্বনের সমান।’ চীনা অনুবাদক ফেং টাং সেটাকে বানিয়েছেন:
The vast world unzips its trousers in front of its lover
Long as a tongue kiss
Slim as a verse.
ভয়াবহ অনুবাদ। বিবিসিসহ অনেক গণমাধ্যম এই নিয়ে সরগরম। এই সুযোগে স্ট্রে বার্ডস বইয়ের অপূর্ব পঙ্ক্তিগুলো পড়ার সুযোগ হলো। সেখান থেকে একটা এক লাইনের কবিতা নববর্ষের প্রথম দিনে পাঠকদের উপহার দিতে চাই।
If you shed tears when you miss the sun, you also miss the stars.‘রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা, সূর্য নাহি ফেরে, শুধু ব্যর্থ হয় তারা।’ সূর্য নেই বলে যদি তুমি অশ্রুপাত করো, তাহলে তুমি তারাদেরও পাবে না।
আজকে নতুন বছরের শুরুতে আমরা উদ্বোধিত হতে চাই নতুন আশায়, নতুন কল্পনায়, নতুন পরিকল্পনায়, নতুন কর্মোদ্যমে। বিগত বছরটাকেও আমরা পেছন ফিরে একবার দেখব। নতুন বছরের শুরুতে এটা করাও একটা রেওয়াজ। রবীন্দ্রনাথ এই বইতেই বলেছেন, ‘Man does not reveal himself in his history, he struggles up through it.’ ‘মানুষ নিজেকে ইতিহাসের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে না। সে সংগ্রাম করে ইতিহাস ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে।’

গত বছর আমরা শুরু করেছিলাম কীভাবে? তার আগের বছর? অবরোধ চলছিল, সেই অবরোধের নামে চলেছে নির্বিচার পেট্রলবোমা হামলা, আমাদের বার্ন ইউনিটগুলো ভরে উঠেছিল নারী-শিশুসমেত সাধারণ মানুষদের আর্তচিৎকারে। সেখান থেকে আজ এই ২০১৬-তে আসা। সবাই জানি, দুবছর আগের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি আর তার মিত্ররা অংশ নেয়নি। কেন নেয়নি, তা-ও জানি। কাজেই এই সরকার যে একপক্ষীয় নির্বাচনের মাধ্যমে অধিষ্ঠিত, তা বলে বোঝানোর দরকার নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা দাবি আদায়ের উপায় হিসেবে সহিংস কর্মসূচিকে সমর্থন করি না। পৃথিবীতে এমন কোনো দাবি নেই, যা প্রতিষ্ঠার জন্য আপনি অন্যের প্রাণ কেড়ে নিতে পারেন। অহিংস পথে, মহাত্মা গান্ধীজির মতো, মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো, এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের মতো ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, আত্মদান করতে হবে। অন্যের ক্ষতি করে, নাগরিকদের প্রাণ ও সম্পদহানি করে কোনো দাবি আদায়ের আন্দোলন সমর্থনযোগ্য নয়। এখানেই রবীন্দ্রনাথের কথাটা আসবে: ইতিহাসের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করা যায় না, ইতিহাস ভেঙেচুরে গড়ে নিতে হয় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
আর আমরা অনেক বছর হলো, এই নীতি গ্রহণ করেছি, এই নীতি প্রচার করছি: হরতাল-অবরোধকে ‘না’। আজকের বাংলাদেশে হরতালের রাজনীতি চলতে পারে না। এটা যেমন আমরা বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে বলেছি, তেমনি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতেও বলেছি। আমরা জানি, আমাদের গণতন্ত্র নির্ভেজাল নয়, অনিন্দ্যসুন্দর নয়। আমরা জানি, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, বাক্স্বাধীনতার ওপরেও পরোক্ষ, কখনোবা প্রত্যক্ষ চাপ আসছে। মাত্র এক দিন আগের পৌর নির্বাচনও ‘চমৎকার’ হয়নি। আমাদের গণতন্ত্রকে সুন্দর করার, জাতীয় সংসদকে অর্থবহ করার, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করার, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড় করানোর সংগ্রাম শেষ হয়ে যায়নি। বরং পাঁচ বছর আগে আমরা যেখানে ছিলাম, পাঁচ বছর পরে তার থেকে পিছিয়েছি কি না, এ নিয়ে কথা বলা যাবে। এসব নিয়ে নীরব থাকার কোনো সুযোগ নেই। এসব ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য কাজ করে যেতে হবে, চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।
কিন্তু ‘আমার যা ছিল তা হারিয়ে গেল যা নেই তার শোকে’ অবস্থা যেন না হয়। সূর্য নেই কেন, এই বলে কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে যেন আমরা চাঁদ আর তারার সৌন্দর্য হারিয়ে না ফেলি। বাংলাদেশের এখন দরকার স্থিতিশীলতা। বাংলাদেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ অভূতপূর্ব সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা সৃজনধর্মী নানা উদ্যোগের মাধ্যমে নিজেদের উন্নতি ঘটাচ্ছেন, তার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। তাঁরা আশির দশকের পর ছড়িয়ে পড়েছেন সারা বিশ্বে, মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাচ্ছেন দেশে। তাঁরা পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠা করেছেন, অর্জন করেছেন অন্যতম শীর্ষস্থান। তাঁরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছেন দেশটাকে, শুধু ধান উৎপাদন করে নয়, মাছ, ফল, সবজি, ডিম, দুধ উৎপাদনেও অনেক ক্ষেত্রে আমাদের কৃষকেরা জায়গা করে নিয়েছেন বিশ্বের শীর্ষ তালিকায়। ক্রিকেট থেকে শুরু করে সপ্তশীর্ষ জয়—আমাদের জয়ের রথ এগিয়েই চলেছে।
তবু জয় করে তোর ভয় কেন রে যায় না? শিল্পে বিনিয়োগ গতি পাচ্ছে না। ব্যাংকে অলস টাকা পড়ে আছে। বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে দিনের বেলা বিদ্যুতের ব্যবহার কম। সেটাও একটা সমস্যা; তা থেকে বোঝা যাচ্ছে শিল্পে, বাণিজ্যে বিদ্যুতের ব্যবহার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হচ্ছে না। সেটা ভালো লক্ষণ নয়। মানুষের মনে আস্থা সৃষ্টি করতে হবে, শিল্পে বিনিয়োগে মানুষ যেন উৎসাহিত হয়, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আমাদের দেশে শিল্পোদ্যোগের পথে অনেক বাধা—বলে চলেছেন শিল্প খাতের নেতারা। লাল ফিতার বাঁধন, নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা, নানা কঠিন শর্ত। তবে এই সময়ে বিনিয়োগে সবচেয়ে বড় বাধা মানসিক, বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে উদ্যোক্তারা উৎসাহিত নন। সেই মনের ভয়টা দূর করা হবে এখনকার বড় কর্তব্য। সে জন্যই দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। তা কেবল প্রশাসনিক বা আইনশৃঙ্খলা-বিষয়ক পদক্ষেপের মাধ্যমে অর্জিত হবে না, তা করতে রাজনৈতিক পরিসর সৃষ্টির মাধ্যমে। এর পেছনের কারণটা রাজনৈতিক, এর সমাধানও নিহিত আছে রাজনীতিতে।
আমরা কেবল বলব, আমরা আর পেট্রলবোমার ভয়াবহতার দিনগুলোতে ফিরে যেতে চাই না। কোনো পক্ষের ভুলেই যেন আমরা, সাধারণ মানুষ এবং আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির বলি না হয়, রাজনীতির আগুনে দগ্ধ না হয়।
একটা সমস্যা বিশ্বব্যাপী এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় ক্ষত হয়ে রক্ত ঝরাচ্ছে। উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদ। বাংলাদেশ তা থেকে মুক্ত নয়। আশুলিয়ার ব্যাংকে টাকা তুলতে গিয়ে ব্যাংক-ডাকাতদের গুলিতে মারা গেছেন যে মানুষটি, তাঁর স্বজনদের কাছে এটা কোনো বিবেচনাই নয় যে তিনি সাধারণ ডাকাতের হাতে মারা গেছেন, নাকি দেশি জঙ্গির হাতে মারা গেছেন, নাকি ওই জঙ্গির আছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। স্বজনেরা জানেন, তাঁদের প্রিয়তম মানুষটি আর ফিরে আসবেন না। বাংলাদেশ উন্নতির মহাসড়কে উঠে গেছে, এগিয়েই যাবে তরতরিয়ে, যেটা স্বীকার করছেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু, যার প্রশংসা করছেন নোবেলবিজয়ী অমর্ত্য সেন, যা পৃথিবীর অর্থনীতিবিদেরা ‘বাংলাদেশ প্যারাডক্স’ শিরোনামে পাঠ করছেন। সেখানে জঙ্গিবাদের বিষবৃক্ষ অঙ্কুরেই বিনাশ করতে পারতে হবে, আর তা করতে হবে শিকড়সহ উপড়ে ফেলার মাধ্যমে। সে জন্য যেমন আমাদের আইনরক্ষকদের প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত করতে হবে, তাঁদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, তেমনি এর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ বিবেচনায় নিয়ে ৩৬০ ডিগ্রি কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। যেখানে ধোঁয়া আছে, তার পেছনে আগুন আছে। ওই আগুনটা নেভাতে হবে। অন্ধকারের বিরুদ্ধে ছড়ি ঘুরিয়ে লাভ হয় না, আলো জ্বালাতে হয়। আমাদের সুশিক্ষার, পরমতসহিষ্ণুতার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের, সবার মত প্রকাশ ও ধারণ করার এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ার মতো আলো জ্বালাতে পারতে হবে। কাজটা সবার—লেখকের, শিক্ষকের, গণমাধ্যমের, সমাজনেতাদের, বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের এবং সরকারের। সরকারকেই পারতে হবে এ ব্যাপারে একটা জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির নেতৃত্ব দিতে। আমাদের সমাজ কখনো জঙ্গিবাদ বা চরমপন্থাকে স্থান দেয়নি; শান্তি, সম্প্রীতি ও মধ্যপন্থাই আমাদের মূলধারা। সমাজের সেই শুভ শক্তিকে আস্থায় নিতে হবে, এগিয়ে নেওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকেই নিতে হবে তার উদ্যোগ। আলাপ–আলোচনা, মতবিনিময়ের মাধ্যমে হতে পারে তার সূচনা।
আমাদের অনেক নেতি আছে। দুর্নীতি আছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দলীয়করণ, স্বজনতোষণ আছে ব্যাপক। এসব ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য কাজ করে যাওয়া থেকে এক মুহূর্তের বিশ্রাম আমাদের নেই। কিন্তু আমাদের অনেক প্রাপ্তিও আছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, তাদের শাস্তি কার্যকর করা হচ্ছে। নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানানোর কাজ এগিয়ে চলেছে। ক্রিকেটে আমরা হোয়াইটওয়াশ করেছি জিম্বাবুয়ে আর পাকিস্তানকে, সিরিজে হারিয়েছি দক্ষিণ আফ্রিকা আর ভারতকে, বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে গেছি কোয়ার্টার ফাইনালে। কোন সাতক্ষীরার গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন বালক মুস্তাফিজ, এসেই ঠাঁই করে নিয়েছেন বিশ্ব রেকর্ড বইয়ের পাতায়। কিংবা ধরুন কলসিন্দুর গ্রাম, ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী একটা গ্রাম—সেই গ্রামের স্কুল থেকে ১০ জন খেলোয়াড় খেলে অনূর্ধ্ব–১৪ জাতীয় মেয়েদের ১৮ জনের দলে। এএফসি কাপের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় সেই দল ভুটানকে দিয়েছে ১৬ গোল। শেষে ফাইনালে নেপালকে হারিয়ে তারা দেশে এনেছে চ্যাম্পিয়নের ট্রফি। প্রথম আলো তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ঢাকার অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা দিয়েছে সেই মেয়েদের, তাদের চাওয়াকে সম্মান জানিয়ে সেই গ্রামে গেছে বিদ্যুৎ, এখন ভবন পাচ্ছে স্কুল। গত বছর ধানমন্ডি বয়েজ স্কুল আর ঢাকা কলেজের প্রাক্তন ছাত্র এম জাহিদ হাসান ও তাঁর দল আইনস্টাইনের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির গবেষণাগারে আবিষ্কার করে ফেললেন ভাইল ফার্মিয়ন কণা, ৮৫ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা যা খুঁজছেন। কী প্রতিভা আর সম্ভাবনা এই দেশের মানুষের মধ্যে!
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আমরা দেখি বিজয়ী হওয়ার যোগ্যতা। আর আমরা বলি, আমাদের তো একটাই লক্ষ্য—বাংলাদেশের জয়। সেই জয়ের খবর আমরা পৌঁছে দিতে চাই সবার কাছে। সেই জয় অর্জনের পথে কোনো বাধা এলে, কোনো ব্যত্যয় ঘটলে, মানুষের কোনো দাবিদাওয়া-চাওয়া থাকলে, বঞ্চনা থাকলে, সেই খবর দেওয়াও তো আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য। ২০১৬ সালের সুন্দর আলোকিত প্রথম সকালে সবাইকে ‘শুভ নববর্ষ’ জানিয়ে বলি, নতুন বছর বাংলাদেশকে এনে দিক নতুন নতুন বিজয়, প্রত্যকের নিজস্ব পথচলায় এবং জাতির সম্মিলিত জীবনে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।