সোশ্যাল মিডিয়ার বিশেষজ্ঞরা কেন বিপজ্জনক

একসময় মনে করা হতো, ইংরেজিতে সবচেয়ে কঠিন তিনটি শব্দ হলো আই লাভ ইউ। সময় বদলে গেছে। অর্থনীতিবিদ স্টিভেন ডি লেভিট এবং সাংবাদিক স্টিফেন জে ডুবনার বলছেন, এই সময়ের মানুষের কাছে সবচেয়ে কঠিন তিনটি শব্দ হচ্ছে ‘আই ডোন্ট নো।’ বিষয়টা হাস্যকর মনে হলেও আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত জানেন না, আপনি কী জানেন না, ততক্ষণ পর্যন্ত কি আপনি ঠিক করতে পারেন, আপনি কী শিখতে চান বা কী শিখবেন?

এবার প্রশ্ন হলো, যেকোনো বিষয়ে আমাদের বিশেষ জ্ঞান বা দক্ষতা কীভাবে খুব সহজেই তৈরি হয়ে যায়?

এই প্রশ্নের অনেক উত্তর থাকতে পারে। বিতর্কও থাকতে পারে। কিন্তু খুবই সাধারণ একটা দক্ষতাকে আমরা এখানে চিহ্নিত করতে পারি। সেই দক্ষতা হলো সম্পর্ক খুঁজে বের করার দক্ষতা, গবেষণার ভাষায় যাকে বলে কো-রিলেশন, বা পারস্পরিক সম্পর্ক।

আমাদের ধারণা হতে পারে যে খোলা চোখে খুব সহজেই বোঝা যায়, পারস্পরিক সম্পর্ক আছে বা নেই, যা আমাদের খুব অল্প সময়ে বিশেষজ্ঞ বানিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তা অতটা সোজা নয়, যতটা আমরা ভাবি। এমনকি আপনার হাতে যদি যথেষ্ট তথ্য থাকে, তবু তা আপনার দাবি করা সত্যের জন্য যথেষ্ট না-ও হতে পারে।

তথ্যের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে পাওয়া এমন কিছু কো-রিলেশনের উদাহরণ দিচ্ছি।
যেমন, এক এলাকায় ঘি খাওয়ার প্রবণতা যত কমেছে, বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাও তার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে।

বা, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি খাতে আমেরিকা যত ব্যয় বাড়িয়েছে, মানুষ তত গলায় দড়ি দিয়ে বা দম আটকে আত্মহত্যা করেছে।

যদিও ওপরের সব কটি বিষয়ই তথ্যের সম্পর্কে সম্পর্কিত, তবু এরা কেউই কারও কার্যকারণ নয়। গবেষণার ভাষায় তাই বলা হয়, ‘কো-রিলেশন ইজ নট কোজেশন।’

আত্মহত্যার প্রসঙ্গ চলে এল। যুক্তরাষ্ট্রে বছরে প্রায় ৩৮ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে ১৫-২৪ বছর বয়সী মানুষের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। তবু এই বিষয়ে জানতে বা কথা বলতে কি আমাদের বিশেষজ্ঞ হতে হবে?
সোশ্যাল মিডিয়া তো বটেই, পত্রপত্রিকারও অন্যতম মুখরোচক আলাপের বিষয় আত্মহত্যা। পরিচিত যে কারও আত্মহত্যার পেছনের কারণ তো আমরা চট করেই বলে দিতে পারি। বিষণ্নতা, প্রেমে ব্যর্থতা, অভিমান, পরীক্ষায় ফেল, পারিবারিক আঘাত—মোটাদাগে এসবই তো কারণ, তাই না?

সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষণ্নতাকে আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ‍তুলে ধরতে বিশেষজ্ঞ হওয়া কি খুব জরুরি? এই প্রশ্নের সহজ এবং কঠিন দুই ধরনের উত্তরই আছে।

উত্তর পাওয়ার আগে চলুন মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড লেস্টারের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই। নিউ জার্সির রিচার্ড স্টোকটন কলেজে পড়ান ভদ্রলোক। আত্মহত্যা নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন তিনি। খুঁজেছেন কী কী বিষয়ের সঙ্গে আত্মহত্যার সম্পর্ক থাকতে পারে। অ্যালকোহল। রাগ-ক্ষোভ। বিষণ্নতা। রাশি। জৈব রসায়ন। রক্তের গ্রুপ। শরীরের ধরন-গড়ন। সুখ-অসুখ। বিনোদন। ভ্রমণ। মানসিক অসুস্থতা। ইন্টারনেটের প্রভাব। মাইগ্রেন। চন্দ্র-সূর্য। গান-বাজনা। জাতীয় সংগীত। যৌনতা। ধূমপান। আধ্যাত্মিকতা। টিভি দেখা। মোটের ওপর কিছুই বাদ দেননি। আত্মহত্যা নিয়ে গোটা দুনিয়ায় এত গবেষণাপত্র কেউ ছাপেনি। লিখেছেন আড়াই হাজারের বেশি গবেষণাপত্র।

কিন্তু এত গবেষণা করে আত্মহত্যা সম্পর্কে কী জানলেন প্রফেসর লেস্টার? ‘তেমন কিছুই না। আসলেই আমাদের ধারণা নেই ঠিক কেন নিজেকে খুন করে মানুষ। এমনকি এটাও জানা সম্ভব হয়নি, কত ভাগ আত্মহননকারী মানসিকভাবে অসুস্থ।’
এতটুকু পর্যন্ত যদি কষ্ট করে পড়েই ফেলেন, তবে একটা অনুরোধ, কেউ যদি কখনো কোথাও আত্মহত্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত দেন, তবে প্রফেসর লেস্টারকে সেই বিশেষজ্ঞের খোঁজ জানাতে ভুলবেন না।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ডেমোক্রেটিক সিনেট সদস্য এবং সমাজবিদ ডানিয়েল প্যাট্রিক ময়নিহান বলেছেন, মতামত নিজস্ব হতেই পারে কিন্তু সত্য নিজস্ব হতে পারে না। মানে যেকোনো বিষয়ে আপনার স্বতন্ত্র মত থাকতেই পারে কিন্তু স্বতন্ত্র সত্য বলে কিছু থাকতে পারে না। আপনি পৃথিবীকে চার কোনা বা গোলাকার থালার মতো দাবি করতেই পারেন। কিন্তু আপনার দাবি যত জোরালোই হোক না কেন, আপনার মতামত বা সত্য ভুল প্রমাণিত হবেই।

বন্ধু তালিকায় কারা কারা ফুটবলামোদী তা আপনার অজানা থাকার কথা নয়। অনেক ফুটবলামোদীর মধ্যে পরামর্শ করার জন্য কাকে বেছে নেবেন? যার পোস্টে লাইক, শেয়ার, কমেন্ট বেশি। সোজা কথায় যার লাইক যত বেশি, তিনি তত বড় ফুটবল বিশেষজ্ঞ।

লেখার শেষ পর্যায়ে আপনাকে একটা পাটিগণিত করার অনুরোধ করব। ধরে নিন আপনি একজন ফুটবল দর্শক। টাইব্রেকার চলছে। আপনার দলের খেলোয়াড়ের চূড়ান্ত শট নেওয়ার পালা। এই খেলোয়াড় সফল হলেই দল চ্যাম্পিয়ন। মহামূল্যবান এই শটের সাফল্য এবং ব্যর্থতা নিয়ে আপনি বাজি ধরতে চান। কিন্তু বাজি ধরার আগে আপনাকে কারও সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। কাকে বেছে নেবেন? প্রথমত, সোশ্যাল মিডিয়া। কারণ, সোশ্যাল মিডিয়া তার অ্যালগরিদমের মাধ্যমে আপনার আগ্রহের খোঁজখবর রাখে। তাই বন্ধু তালিকায় কারা কারা ফুটবলামোদী তা আপনার অজানা থাকার কথা নয়। অনেক ফুটবলামোদীর মধ্যে পরামর্শ করার জন্য কাকে বেছে নেবেন? যার পোস্টে লাইক, শেয়ার, কমেন্ট বেশি। সোজা কথায় যার লাইক যত বেশি, তিনি তত বড় ফুটবল বিশেষজ্ঞ।

আপনার বাছাই করা সেই বিশেষজ্ঞকে সহজ প্রশ্ন খানিকটা ঘুরিয়ে করুন। জিজ্ঞেস করুন, গোলের কোন দিকে শট নিলে গোল হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি? ডান, বাঁ, না সোজা? এবার ভাবুন আপনি হলে কোন দিকে মারতেন—ডান, বাঁ, নাকি সোজা? বিশেষজ্ঞ কোন দিকে মারতে চান?

গবেষণা বলছে: শট নিতে যাঁরা ডান পা ব্যবহার করেন, তাঁরা বাঁ দিকে শট করেন শতকরা ৫৭ ভাগ সময়। আর ডান দিকে শতকরা ৪১ ভাগ সময়। সোজাসুজি শতকরা ২ ভাগ সময়। গোলরক্ষকেরও এতটুকু গণিত জ্ঞান আছে। তাই তাঁর ডান কিংবা বাঁয়ে ঝাঁপানোর প্রবণতা যথাক্রমে ৪১ ও ৫৭।

আমাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল গোল হবে কি হবে না। গবেষণা বলছে, গোলপোস্টের সেন্টার বরাবর সোজাসুজি শট নিলে গোল হওয়ার সম্ভাবনা আমাদের প্রচলিত ধারণার চেয়ে বেশি। সুতরাং যে খেলোয়াড় আপনার এই গণিতের আওতায় পড়বেন, তার ওপর বাজি ধরলে বাজিতে জেতার সম্ভাবনাও বাড়বে।

বাজি ধরার ক্ষেত্রে কে বেশি নির্ভরশীল? অ্যালগরিদমে পাওয়া সোশ্যাল মিডিয়ার বন্ধু, নাকি গবেষণার তথ্য? পছন্দ আপনার।

প্রযুক্তি ছাড়া আমাদের জীবন কল্পনা করাও কঠিন। জীবনের প্রতিটা পদে আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন। পথ চলতে গুগল, কিছু জানতে গুগল। কাকে বিয়ে করব, কাকে বন্ধু বানাব, ঠিক করতে ফেসবুক। কীভাবে কী রান্না করব কিংবা কী করে টাই বাঁধব, জানতে ইউটিউব। কাকে চাকরি দেব, জানতে লিংকডইন। এভাবেই আমরা সোশ্যাল মিডিয়া এবং তাতে থাকা কৃত্রিম বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি মনুষ্যবিশেষজ্ঞদের মতামত নিই। কিন্তু মতামত নেওয়ার সময় আমরা কি সমাজবিদ ডানিয়েল প্যাট্রিক ময়নিহানের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘মতামত নিজস্ব হতেই পারে, কিন্তু সত্য নিজস্ব হতে পারে না’—মনে করতে পারি না?

আমার মনে হয় সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে আমাদের তাই ভাবতে হবে। ঋত্বিক ঘটকের সিনেমার ভাষায় ভাবার প্র্যাকটিস করতে হবে। ভাবনা বিষয়ে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের প্রতিষ্ঠাতা জর্জ বার্নাড শ বলেছেন, কিছু মানুষ বছরে দুই কিংবা তিনবার ভাবে, কিন্তু আমি ভাবি সপ্তাহে এক থেকে দুবার।

সুতরাং আমাদেরও সপ্তাহে অন্তত একবার ভাবার চর্চা করতে হবে।
এই লেখার কিছু তথ্য এবং চিন্তার সূত্র: স্টিভেন ডি লেভিট এবং স্টিফেন জে ডুবনারের থিংক লাইক আ ফ্রিক। ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা যুক্তি তক্কো আর গপ্পো। ইউভাল নোয়া হারিরির হোমো ডিউস। প্রফেসর ব্যারি মেডোমের শ্রেণিকক্ষের গবেষণা।

রিনভী তুষার রাজনীতি গবেষক এবং অভিবাসন উন্নয়নকর্মী।
kurchiphool@gmail. com