স্কুল খুলেছে, সবাই কেন ফেরেনি

প্রথম দিনের উপস্থিতির গড় হার ছিল উৎসাহের। তোমরা সঙ্গে যাও বা না যাও আমি একাই যাব—শিশুদের এমন কথায় অভিভাবকদের দ্বিধা কেটে যায়। নিয়ম বুঝতে না পেরে কোথাও কোথাও সবাই এসে ভিড় করেছিলেন। তবে এসব সাময়িক। শিক্ষার্থীদের খুশিটা ধরে রাখা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষক আর বিদ্যায়তনের কর্মীদের সেটা পারতে হবে। ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে শিশুদের ভালো লাগার মতো আচরণে মনোযোগী হতে হবে। আর্থিক ও মানসিক সংকটে জেরবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এমপিও-সমর্থিত নন এমন শিক্ষকদের কাছ থেকে খুব বেশি সৃজনশীল ও পরিবর্তিত আচরণ এই মুহূর্তে আশা করা ঠিক হবে না। তবে নির্দেশনা আর তালিম পাওয়া সরকারি এবং এমপিওভুক্ত বিদ্যায়তনগুলোর শিক্ষকেরা নিশ্চয় স্কুলের সময়টুকু আনন্দময় করে তুলতে পারবেন।

উপস্থিতির গড় হারে আত্মতুষ্টি!

পরিসংখ্যানের গড়ে প্রকৃত অবস্থা সব সময় ঠাওর হয় না। কিছু কিছু স্কুলে একেবারেই শিক্ষার্থীরা আসেনি বা এলেও ঘর বা বসার জায়গা খুঁজে না পেয়ে রোদের মধ্যে ঘণ্টা দুয়েক দাঁড়িয়ে বা গাছতলায় বসে ক্লাস করেছে। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার শাহ আরফিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসে দেখে ওস্তাগাররা কাজ করছেন। দেড় বছরেও কাজ শেষ হয়নি। কথা ছিল পার্শ্ববর্তী মন্দিরে আপাতত ক্লাস হবে। সেটাও না হলে ‘দাবায়ে’ রাখা যায়নি শিক্ষার্থীদের, তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ক্লাস করেছে। রংপুরের কাউনিয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল। সেখানকার বিদ্যালয়টি এখন সড়ক ও জনপথের গুদাম। উপজেলার শহীদবাগ ইউনিয়নে নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়টিতে মোট ১১৯ জন শিক্ষার্থী ছিল। এ রকম সরকারি বা এমপিওভুক্ত না হওয়া স্কুলগুলোর বেশির ভাগই চলছে না। বন্ধ আছে কিন্ডারগার্টেনগুলো।

কোভিডের আগে কুমিল্লার হোমনা উপজেলায় ১২০টির মতো কিন্ডারগার্টেন ছিল। এর মধ্যে ৬৫টি স্কুল সরকারের বই সহযোগিতা পেত এবং শিশুরা পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা দিতে পারত। এর অনেকগুলো বসে গেছে। শিক্ষার্থীদের অনেকেই মাদ্রাসা, এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে চলে গেছে। বড় একটা অংশ রুটিরুজির সন্ধানে নেমে গেছে, তাদের ফেরার পথ এখন নেই। যশোরের মনিরামপুরের কুলিপাশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন পরিণত হয়েছে পাটের গুদামে। আর কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের রামনগর পশ্চিমপাড়া বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ধানখেতের বেষ্টনীতে ঢাকা পড়ে গেছে। বিদ্যালয় কমিটির সভাপতি সংবাদমাধ্যমকে জানালেন, ‘এত বড় একটি জায়গা ফেলে রাখব কী করে। তাই ধান চাষ করেছি।’

পৌর এলাকা আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের ফারাক

হাতিয়ার চর কিং ইউনিয়নের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির ১৫ জনের মধ্যে ফিরেছে মাত্র ৫ জন আর চতুর্থ শ্রেণির ২২ জনের মধ্যে ৬–৭ জন। দুই শ্রেণিতেই ছাত্রীর সংখ্যা দু-একজন মাত্র।

লক্ষ্মীপুরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোভিডের আগে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছিল ৪৭ জন। এখন সেটা কমে ৩০ জন। সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার বোয়ালকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণির ৪২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে আসতে পেরেছে মাত্র ৭ জন। একজন মাত্র মেয়েশিক্ষার্থী।

এই লেখায় যখন প্রান্তিক অঞ্চলগুলোর হিসাব-নিকাশ কষছিলাম, তখন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বন্ধু জুলিয়ান ফ্রান্সিস জানালেন তাঁর নাতি তাঁকে জানিয়েছে, ঢাকার বনানীতে যে স্কুলে সে পড়ে, সেখানে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ১৯৮ জনের মধ্যে ৭০ জন আর আসবে না। এদের মা-বাবা কাজ হারিয়ে গ্রামে চলে গেছেন বা এমন কোনো কাজ করছেন, যা দিয়ে বাচ্চাদের পড়ার খরচ চালানো সম্ভব নয়।

বিয়ে হয়ে গেছে

একটি বেসরকারি সংস্থা দেশের ২১টি জেলার ৮৪ উপজেলায় জরিপ করে দেখেছে, বিগত এপ্রিল, ২০২০ থেকে অক্টোবর, ২০২০ পর্যন্ত এসব উপজেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। এরা সবাই ছিল শিক্ষার্থী। ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সের এসব মেয়ের মধ্যে ৫ হাজার ৮৯ জন ইতিমধ্যেই অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ করেছে। এদের কারও আর পড়াশোনায় ফেরা হবে কি? বেশি বাল্যবিবাহ হয়েছে বরগুনায়। সে সংখ্যাটা ১ হাজার ৫১২টি। এ ছাড়া কুড়িগ্রামে ১ হাজার ২৭২, নীলফামারীতে ১ হাজার ২২২, লক্ষ্মীপুরে ১ হাজার ৪১ এবং কুষ্টিয়ায় ৮৮৪টি। সারা দেশের খণ্ডচিত্র টিত্র এটি। এতেই বোঝা যায়, কী কঠিন সামাজিক বোঝা তৈরি হয়েছে।

অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের কী হবে

দেশের সব কিন্ডারগার্টেন এবং এমপিওবহির্ভূত বেসরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা এক কোটির কম হবে না। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ব্যয় অনেক বেশি। আবার শিক্ষকদের বেতন ও চাকরির শর্ত বড়ই নাজুক। অনেকেই টিকে থাকার জন্য নানা পেশায় নিয়োজিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন (বগুড়ার এক শিক্ষিকা হোটেলে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ নিয়েছিলেন)। যাচাই করে এসব প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের প্রণোদনার আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারে সিদ্ধহস্ত তথাকথিত কারখানা মালিকদের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের টাকায় যদি প্রণোদনা দেওয়া যায়, তবে মানুষ গড়ার কারিগরদের কেন দেওয়া যাবে না?

যারা ফিরেছে, তাদের ধরে রাখাটাও একটা চ্যালেঞ্জ

যারা এসেছে, তারা স্কুলে ভয়ভীতিহীন এক আনন্দময় পরিবেশ না পেলে আবার ‘মুক্ত’ জীবনে বা কর্মজীবনে ফিরে যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা কেন স্কুল ছেড়ে চলে যায়, তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। সব গবেষণায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার প্রধান কারণ হিসেবে পরীক্ষার চাপ আর ক্রমেই শিক্ষার ব্যয় বেড়ে যাওয়াকে উল্লেখ করা হয়েছে। যা এখন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। এ ক্ষেত্রে এখনই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ইত্যাদি বলে মাথা খারাপ করা ঠিক হবে না। এখন মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কার ও শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা চলমান রাখা ও বিস্তারের জন্য দরিদ্রবান্ধব কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।

ঝরে পড়াদের কী বিধান

নানা কারণে যারা মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, তাদের ফিরিয়ে আনার নানা কর্মসূচি সরকারের ছিল। দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়ার এ কর্মসূচি ‘আউট অব এডুকেশন প্রোগ্রাম’ (পিইডিপি-৪)-কে পরিবর্তিত বাস্তবতার আলোকে প্রয়োজনে নতুন করে সাজাতে হবে। ২০১৯ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭ দশমিক ৯। এখন পর্যন্ত যে আলামত দেখা যাচ্ছে, তাতে এই হার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের বেশি হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এই কর্মসূচিকে বেগবান করতে হবে। এই কর্মসূচির ৩০০ জন সমন্বয়ক নিয়োগের জন্য দেড় বছর ধরে নিয়োগপ্রক্রিয়া চলছে। চারটি ধাপে মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষা নিয়েছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো। ফলাফল প্রকাশিত হয়নি। এসব গড়িমসি ছেড়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে দৃঢ় পায়ে চলা শুরু না করলে সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছে।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

nayeem 5508 @gmail. com