
‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’, ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা’, ‘ও আমার আট কোটি ফুল দেইখো গো মালি’ প্রভৃতি দেশাত্মবোধক গানের বাণী যেমন সমকালীন, তেমনি চিরকালীন; যেমন আধুনিক, তেমনি গভীর; যেমন চিত্তাকর্ষক, তেমনি প্রেরণাদায়ক।
কালজয়ী এসব গানের স্রষ্টার নাম নজরুল ইসলাম বাবু। এ প্রজন্ম কি তাঁর নাম জানে? আমরা যাঁরা তাঁর এসব গান শুনে শুনে বড় হয়েছি, তাঁরা কি মনে রেখেছি তাঁকে? আমাদের গণমাধ্যমগুলোই-বা কতটা স্মরণ করে তাঁর অবদানকে? অথচ একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোলোই ডিসেম্বরের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো তাঁর গানগুলো ছাড়া পূর্ণতা পায় না।
উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে তিনি জামালপুরের আশেক মাহমুদ কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর ডাকে এই গীতিকবি অস্ত্রহাতে সরাসরি অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। তাঁর অন্যতম দায়িত্ব ছিল বিস্ফোরক দিয়ে ভারী ও মজবুত পুল বা ব্রিজ ধ্বংস করে হানাদারদের যোগাযোগবিচ্ছিন্ন করা। ১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার চরনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। দেশাত্মবোধক গানের পাশাপাশি বেশ কিছু জনপ্রিয় আধুনিক গানের জন্যও তিনি অমর হয়ে থাকবেন। উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে, ‘ডাকে পাখি খোলো আঁখি’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘কাল সারারাত ছিল স্বপনের রাত’, ‘আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’ ইত্যাদি। লিখেছেন হাজারখানেক গান। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ বেতারে এবং ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে পেশাদার গীতিকার হিসেবে তালিকাবদ্ধ হন।
তিনি এখন সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে। কিন্তু ভাবতে খুব কষ্ট হয়, তাঁর মতো প্রতিভাধর ও কালজয়ী গীতিকবির কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি আজও! সম্প্রতি নজরুল ইসলাম বাবুর পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। তাঁর স্ত্রী শাহীন আক্তার একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত। সাড়ে চার বছর আর ছেচল্লিশ দিন বয়সের দুই শিশুকন্যাকে রেখে তাদের বাবা মারা যান।
এই পরিচয়ের সুবাদেই জানতে পারলাম, শাহীন আক্তারের অমানুষিক শ্রমে কয়েক মাস আগে প্রকাশিত হয়েছে নজরুল ইসলাম বাবু স্মারকগ্রন্থ। নতুন বইয়ের প্যাকেট তখনো খোলা হয়নি। সামনে ঘটা করে একটা প্রকাশনা উৎসব করে তবেই বই বাজারে ছাড়বেন। আর কী পরিকল্পনা আছে? জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, সামনের দিনগুলোতে বাবুর জন্য কিছু-না-কিছু করতে চান। এই বই বিক্রির টাকায় নজরুল ইসলাম বাবুকে নিয়ে একটা জীবনীগ্রন্থ বের করতে চান। তাঁর প্রত্যাশা, বাবু যে হাজারখানেক গান লিখেছেন, সেগুলো বাংলা একাডেমি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করুক। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে বেশির ভাগ গানই তিনি সংগ্রহ করেছেন।
স্মারকগ্রন্থে শাহীন আক্তার লিখেছেন, ‘মানুষ হাঁটতে হাঁটতে, কাজ করতে করতে কিংবা একা হলে তাঁর প্রিয় গানগুলো গায়। মানুষের মুখে মুখে তাঁর অনেক গান আজও বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এটাই আমার বড় পাওয়া। আমার দুই মেয়ে নাজিয়া ও নাফিয়া পিতাকে নিয়ে এভাবেই গর্ব করে, প্রেরণা পায়। তারপরও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে একজন সৃজনশীল মানুষের কাজের মূল্যায়ন বিশেষ সম্মানের।’ তিনি লিখেছেন, ‘‘‘সব কটা জানালা খুলে দাও না” গানের সুরকার ও শিল্পীকে একুশে পদক প্রদান করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে যাঁর সৃষ্ট পঙ্ক্তিমালা দিয়ে গানটি রচিত, তাঁকেও মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।’
বাণী ও নিবন্ধ মিলিয়ে গ্রন্থটিতে ৩২ জনের লেখা স্থান পেয়েছে। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর তাঁর বাণীতে বলেছেন, ‘গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু আমাদের গর্ব। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে হাতে তিনি শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন, স্বাধীনতার পর আবার সেই হাতে কলম ধরেছেন। তিনি সব সময় হৃদয়ে বাংলাদেশকে ধারণ করেছেন, এ দেশের মাটি, প্রকৃতি ও মানুষকে ভালোবেসেছেন।’
গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন আরেক স্বনামধন্য গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান। এর পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন মাদারগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ওবায়দুর রহমান বেলাল। এ গ্রন্থে আরও লিখেছেন শেখ সাদী খান, আলাউদ্দীন আলী, সাবিনা ইয়াসমিন, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, অ্যান্ড্রু কিশোর প্রমুখ।
এমন একজন গুণী মানুষকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হলে শুধু ব্যক্তিমানুষটির স্মৃতির প্রতিই শ্রদ্ধা জানানো হবে না, সেই পুরস্কার এবং পুরস্কারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও সম্মানিত হবেন। আমাদের প্রত্যাশা, বর্তমান সরকার গুণী এই মানুষের ক্ষেত্রে উদারতার পরিচয় দেবে।
ইসমাইল সাদী: পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।