হরেক রকম ব্যাংক ডাকাতি

শার্লক হোমস থাকতেন লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার এলাকার বেকার স্ট্রিটে। রাস্তাটি অভিজাত এবং খুবই ব্যস্ত। সে রাস্তারই লয়েডস ব্যাংকে ঘটে দুর্ধর্ষ এক ডাকাতির ঘটনা। ৪৮ বছরেও ডাকাতদের ধরা যায়নি, উদ্ধার হয়নি ডাকাতির অর্থ, গয়নাসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী।

ঘটনাটি বলা যাক। ব্যাংকের দুটি বাড়ি পরেই ছিল চামড়ার সামগ্রী বিক্রির একটা দোকান, লা সেক। দূরত্ব মাত্র ৫০ ফুট। ডাকাতেরা সেই দোকান ভাড়া নেয়। তারপর শুরু হয় নিচ থেকে সুড়ঙ্গ খোঁড়া। শব্দ যাতে বাইরে না যায়, তাই শুধু ছুটির দিনগুলোতে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলত। এভাবে একদিন ঠিকঠাক সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ভল্ট রুমে ঢুকে যায় তারা। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর।

তবে ডাকাতির ঘটনা একেবারেই যে কেউ টের পাননি, তা নয়। ডাকাতদের একটি দল ছিল ভল্ট রুমে, আরেক দল পাশের ভবনের ছাদে উঠে পাহারা দিচ্ছিল। তারা ওয়্যারলেস সেটে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। রবার্ট রোল্যান্ড নামে এক শৌখিন হ্যাম রেডিও অপারেটর রাত সোয়া ১১টার দিকে ওয়্যারলেসে দুই দলের কথাবার্তা শুনে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেন স্থানীয় থানায়। কিন্তু বিশ্বাস করেনি পুলিশ। এরপরে রোল্যান্ড যোগাযোগ করেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে। এরপরই টনক নড়ে পুলিশের। রাত দুইটায় পুলিশ ১০ মাইলের মধ্যে থাকা সব ব্যাংকের সামনে হাজির হয়েও কিছু বের করতে পারেনি। পুলিশ কিন্তু ঠিকই লয়েডস ব্যাংকে গিয়েছিল। তখন ডাকাতেরাও ছিল ব্যাংকের ভেতরে। কিন্তু নিরাপত্তা দরজা বন্ধ দেখে ফিরে যায়। ওই রাতে তারা নগদ ১৫ লাখ পাউন্ড (এখনকার হিসাবে ২ কোটি ৮ লাখ পাউন্ড) এবং ২৬০টি সেফ ডিপোজিট বক্স নিয়ে নিরাপদে সটকে পড়ে।

ব্যাংকটা যেহেতু বেকার স্ট্রিটে, তাই ব্যাংক ডাকাতেরা রসিকতা করতেও ভোলেনি। সটকে পড়ার সময় তারা ব্যাংকের দেয়ালে লিখে রেখে যায়, ‘এখন দেখা যাক শার্লক হোমস কীভাবে রহস্যের কিনারা করেন।’ চ্যালেঞ্জটা না হয় নিতে পারেননি শার্লক হোমস, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডও কেন পারল না। কারণ, ব্রিটিশ সরকার চায়নি রহস্যের কিনারা হোক। ঘটনার চার দিন পরে ব্যাংক ডাকাতির সব ধরনের খবর প্রচারে ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার’ কারণ দেখিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল সরকার।

বলা হয়ে থাকে, ব্যাংকের সেফ ডিপোজিট বক্সে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের বোন প্রিন্সেস মার্গারেটের কিছু খোলামেলা ছবি রাখা ছিল। এসব ছবির প্রচার হোক, তা রাজপরিবার চায়নি। এ নিয়ে অবশ্য একটা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এখনো চালু আছে। যেমন, ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআইফাইভ ডাকাতদের ভাড়া করে ব্যাংক ডাকাতি সাজিয়েছিল। কেননা, ওই ছবি ব্রিটেনে আশ্রয় নেওয়া এমন একজনের দখলে ছিল, যিনি ওই ছবিগুলো দিয়ে ব্ল্যাকমেল করতেন। ব্রিটিশ পুলিশ এ জন্য কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছিল না। সেই ছবি উদ্ধারেই ব্যাংক ডাকাতির আয়োজন। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বসহ পুরো ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা নিয়ে একটা সিনেমাও হয়েছে। আগ্রহীরা দ্য ব্যাংক জব ছবিটি দেখতে পারেন।

ব্যাংক ডাকাতি সব সময়ই আর্থিক অপরাধ জগতের অন্যতম আলোচিত বিষয়। এ নিয়ে গবেষণাও আছে অনেক। দুটি আলাদা মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির দুই অধ্যাপক জিওভান্নি মান্ত্রোবুয়োনি এবং ডেভিড এ রিভার্স গবেষণা করেছেন ব্যাংক ডাকাতদের আচরণ নিয়ে। পাঁচ হাজার ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা সমীক্ষা করে এই দুই অর্থনীতিবিদ জানালেন, যত কম সময়ে ব্যাংক ডাকাতি সম্পন্ন করা যায়, সফল হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। আর ব্যাংক ডাকাতি সফল হয় যদি তা তিন মিনিটের মধ্যে করা যায়।

তবে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাংক ডাকাত ক্লেটন রস থামের ঘটনা গবেষণারও বাইরে। ২০০৫ ও ২০০৬ সালে চুটিয়ে ব্যাংক ডাকাতি করার পরে ক্লেটন একদিন পুলিশকে ফোন করে সব স্বীকার করে স্বেচ্ছায় জেলে গেলেন। পাঁচ বছর জেল খেটে বের হয়ে ১০ বছর পর একটি বইও লিখে ফেললেন, দ্য ব্লু চিপ স্টোর: হাউ ব্যাংক রবারি চেইঞ্জড মাই লাইফ। এমনকি ক্লেটন হাজির হয়েছিলেন ‘আস্ক মি এনি কোশ্চেন’ নামের ইন্টারনেটভিত্তিক এক অনুষ্ঠানে। সেখানে তিনি নিজের পরিচয় দিতেন, ‘একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক ডাকাত’। সম্ভাব্য ব্যাংক ডাকাতদের জন্য বইটিতে ব্যাংক ডাকাতির ১০টি টিপসও দিয়েছেন ক্লেটন। আগ্রহীরা পড়তে পারেন।

সারা বিশ্বেই ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে নানা গবেষণা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এফবিআই প্রতিবছর নিয়মিতভাবে ব্যাংক ডাকাতির পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ব্যাংক ডাকাতির তথ্য নানাভাবে বিশ্লেষণ করে। ডাকাতি বেশি হয় বলে গবেষকেরা ইতালিকে ব্যাংক ডাকাতদের রাজধানী হিসেবেই বিবেচনা করেন।

হরেক রকম ও রহস্যময় ব্যাংক ডাকাতির কথা মনে পড়ল বাণিজ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে। সাধারণত ব্যাংক ডাকাতির ধরন মোটামুটি একই। অস্ত্র নিয়ে হামলা, তারপর টাকাপয়সা নিয়ে উধাও। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ভিন্ন একধরনের ডাকাতির কথা জানালেন। গত মাসে এক অনুষ্ঠানে তিনি বললেন, ‘পৃথিবীর কোথাও ব্যাংকঋণ ও আমানতের সুদের ব্যবধান ২-৩ শতাংশের বেশি নয়। বাংলাদেশেই এ হার কেবল ৫ শতাংশের ওপরে। এটা রীতিমতো ডাকাতি।’ এর আগে অবশ্য আরেক ধরনের ডাকাতির সংজ্ঞা দিয়েছিলেন ব্যাংক ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সদ্য বিদায়ী সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। গত বছর তিনি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের ডাকাত বলে সম্বোধন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছিলেন। আবার ২০১৬ সালে সে সময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি হয়েছে। বেসিক ব্যাংকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা লুটপাটের চেষ্টা চালিয়েছেন।’ অন্যদিকে ২০১৬ সালেই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরিকে কম্পিউটার নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা ডিজিটাল ব্যাংক ডাকাতি বলে আসছেন প্রথম থেকেই।

সুতরাং ব্যাংক ডাকাতির দিক থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি একটু অন্য রকম হলেও এক জায়গায় খানিকটা মিল আছে। বিশেষ করে, রহস্যের বিষয়টি। আমরা সবাই জানি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির মূল হোতা কে ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেও আছে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নাম। কিন্তু দুর্নীতি প্রতিরোধ সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্কই খুঁজে পেল না। আবার সোনালী ব্যাংক এখনো হল-মার্ক কেলেঙ্কারির পর থেকে পুরোপুরি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। অথচ দুদক রহস্যের কোনো কিনারাই করতে পারেনি। হল-মার্ক ঘটনায় বর্তমান সাংসদ এক ব্যাংক পরিচালকের নাম থাকলেও দুদকের মামলায় তাঁর নামই নেই। এ রকম রহস্যময় ব্যাংক ডাকাতির অসংখ্য উদাহরণ দেশে আছে।

ব্রিটিশ সরকার চায়নি ১৯৭১ সালের লয়েডস ব্যাংকের ডাকাতির রহস্য উদ্ধার হোক। বাংলাদেশেও একই কারণে অনেক ব্যাংক ডাকাতির রহস্য উদ্ধার হয় না। যেমন হল-মার্কের টাকা কোথায় এবং কার কাছে গেছে, আবদুল হাই বাচ্চু কোথায় এবং কাকে কত টাকা দিয়েছেন, তা বের করা কঠিন ছিল না। ব্যাংক লেনদেন খুঁজলেই তা পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়েও রহস্যময় কারণে তা প্রকাশ করেনি সরকার। আবার সবধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েও কোন ধরনের ব্যাংক ডাকাতির কারণে সুদের হার কমছে না, তা-ও সরকার খুঁজে দেখছে না।

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা আসলে ব্যাংক ডাকাত, তাঁদের কারও বিরুদ্ধে কখনোই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কোনো সরকার। বরং তাঁদের নানাভাবে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ পুরস্কার হচ্ছে ঋণখেলাপিরা ৯ শতাংশ সুদ দিয়ে ঋণ নিয়মিত করতে পারবেন। অথচ ঋণ নিয়মিত হলে সুদের হার হবে আরও বেশি। অতএব, হে ভালো ভালো গ্রাহক, আপনাদের জন্য শিক্ষা হচ্ছে, ব্যাংক ডাকাত হওয়াই ভালো, এতে সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। আর ঋণখেলাপিদের প্রতি এই যে রাষ্ট্রের ভালোবাসা, এর রহস্যের সমাধান করাও সম্ভবত বারণ। যেমন বারণ ছিল লয়েডস ব্যাংকের রহস্যময় ডাকাতির সমাধান করা।

সবশেষে, ব্যাংক ডাকাতি নিয়ে সবার জানা কৌতুকটাই আবার বলি। অনেক দিন আগের কথা, ডাকাতেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্যাংক ডাকাতি করত। তাতে ডাকাতদের খুব কষ্ট হতো। এরপর তারা সবাই মিলে একটা বুদ্ধি করে নিজেরাই একটা ব্যাংক তৈরি করে ফেলল। তারপর সব মানুষ সেই ব্যাংকে টাকা রাখতে এল। আর ডাকাতেরা ব্যাংকে বসেই তাদের ডাকাতি চালাতে থাকল।

শওকত হোসেন: প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক
[email protected]