হামাসের ‘বিজয়ে’ লাভ-ক্ষতির যোগফল কী দাঁড়াল?

১১ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলে প্রায় তিন হাজার রকেট ছুড়েছে হামাস

হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের এ পর্যন্ত চার দফা যুদ্ধ হলো। কেন এসব যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেটা সবার জানা। কিন্তু কেন উভয় পক্ষ যুদ্ধ থামায়, সেটা প্রবল প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। এবারও ১১ দিনের যুদ্ধ শেষে উভয় পক্ষ এখন যুদ্ধবিরতিতে গেছে। উভয় পক্ষ সন্তুষ্ট নিজ নিজ ‘অর্জন’ নিয়ে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা কী পাবে এ রকম অর্জনের ভেতর দিয়ে, সে আলোচনা স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে আছে।

চক্রাকারে ‘যুদ্ধ’ এবং ‘যুদ্ধবিরতি’: ফিলিস্তিনিদের প্রাপ্তি অস্পষ্ট
ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম বহুদিনের পুরোনো। হামাস সে তুলনায় নবীন। ফিলিস্তিনিদের এত সশস্ত্র-নিরস্ত্র সংগঠন থাকার পরও হামাসের কেন জন্ম হলো, সেটা আজও বড় এক অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে আছে। বলা হয়, মুসলিম ব্রাদারহুডের ভাবাদর্শিক প্রভাবে হামাসের জন্ম।

ফিলিস্তিনিদের প্রাথমিক প্রতিরোধগুলোতে স্থানীয় ব্রাদারহুডের সক্রিয়তা ছিল সামান্য। ১৯৮০-এর পর থেকে ব্রাদারহুডের আহমেদ ইয়াসিন গাজায় বিভিন্ন দাতব্য কাজের আড়ালে রাজনৈতিক কাজও জোরদার করেন। ইসরায়েল তখন এসবে বাধা দেয়নি। কোনো কোনো ইসরায়েলি কর্মকর্তার এমনও দাবি, তাঁরা ইয়াসিনের কাজে সহায়তাও দিয়েছেন। কিন্তু ২০০৪ সালে ইসরায়েল আহমেদ ইয়াসিনকে সন্ত্রাসী হামলার আদলে হত্যা করে। ইয়াসিনকে প্রাথমিকভাবে কাজ করতে দেওয়ার ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়, মূলত পিএলও এবং র‍্যাডিকেল অন্যান্য সংগঠন থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে আনতে তাঁকে কাজের সুযোগ দেয় ইসরায়েল। যখন তাঁর সংগঠন সম্ভাব্য আরেক প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে শুরু করে, তখনই তাঁকে ‘নিষ্ক্রিয়’ করা হয়। সঙ্গে হামাসের যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা আবদেল আজিজকেও।

এর মধ্যেই গাজায় ইসরায়েলের জুলুমে অসহ্য হয়ে ব্রাদারহুডের তরুণ কর্মীদের ভেতর থেকে হামাসের জন্ম ১৯৮৭ নাগাদ প্রথম ইনতিফাদার সময়। ইয়াসিনের সম্মতি ছিল তাতে। সায় ছিল ব্রাদারহুডেরও। ফিলিস্তিনিদের ইনতিফাদা তখন এত বিকশিত অবস্থায় ছিল যে কেবল সেবামূলক কাজে ব্রাদারহুডের পক্ষে গাজা ও পশ্চিম তীরে সংগঠন ধরে রাখা সম্ভব ছিল না। ব্যবহারিক বাস্তবতার কারণেই হামাসের আবির্ভাবে রাজি হতে হয় তাদের। এরপর থেকে গত প্রায় ২৫ বছরে হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের ‘যুদ্ধ’ এবং ‘যুদ্ধবিরতি’ চলছে চক্রাকারে।

ব্রাদারহুডের আহমেদ ইয়াসিনের সম্মতিতে ১৯৮৭ নাগাদ হামাসের জন্ম

যুদ্ধ গাজায়: বড় ‘অর্জন’-এর দাবি ইরানের!
হামাস সুন্নি ঘরানার সংগঠন। কিন্তু এখন তাদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু শিয়াশক্তি ইরান। এটা একই সঙ্গে দারুণ দৃষ্টান্ত এবং বিস্ময় উদ্রেককারী। ১৯৯০-এর পর থেকে এই দুই পক্ষের সম্পর্ক বিকশিত হচ্ছে। লেবাননে থাকা হামাসের নেতারা হিজবুল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে ইরানের সঙ্গে এই যোগাযোগ গড়ে তোলে। ব্রাদারহুডের শাখা হয়েও হামাসকে নিজের বন্ধু করে নিতে পারা ইরানের কৌশলগত উদারতা ও দক্ষতার বড় সাক্ষ্য।

সিরিয়ার যুদ্ধে এই দুই শক্তির স্বার্থ ভিন্নপথ নিয়েছিল কিছুদিন। সেই দূরত্ব আবার তারা কমিয়ে এনেছে। সিনাইয়ের ভেতর দিয়ে হামাসের কাছে সমরাস্ত্র পাঠাতে মিসরের ব্রাদারহুড দাতা-গ্রহীতাকে সহায়তা করে বলে ধারণা করা হয়।

হামাস মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব অনেক বাড়িয়েছে। যেমনটি করেছে লেবাননের শিয়া-হিজবুল্লাহ। হামাসকে মদদ দেওয়ার মাধ্যমে দেশের ভেতরেও ইরানের শাসকদের জনসমর্থন ধরে রাখতে সুবিধা হয়েছে। এটা একই সঙ্গে সৌদি-অক্ষশক্তির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তার গুরুত্ব বাড়াচ্ছে। গাজায় এবারের ১১ দিনের যুদ্ধেও কোনো সৈন্য না হারিয়ে ইরানের অর্জন বিপুল। নেতানিয়াহুরও রাজনৈতিক লাভ বড় কম হয়নি এতে। এক যুদ্ধে এত শক্তির বিজয়ে ধাঁধায় রয়েছে কেবল বিধ্বস্ত ফিলিস্তিন।

হামাস ও ইসরায়েল: আলোচনা নেই ‘যুদ্ধবিরতি চুক্তি’ আছে!
হামাস বর্তমান ইসরায়েল, গাজা ও পশ্চিম তীর নিয়ে একটা ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ কায়েম করতে চায়। হামাস ততটুকু জায়গা নিয়েই ভাবে, যতটুকু নিয়ে রাষ্ট্র গড়তে তৎপর ইসরায়েলের শাসকগোষ্ঠী। হামাসের লক্ষ্য ইসরায়েলের অস্তিত্বের অস্বীকৃতি। যেভাবে ইসরায়েলের সম্প্রসারণবাদী নীতি ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বহীনতার প্রধান কারণ। কিন্তু হামাসের জন্য কাতারের সহায়তা ইসরায়েলের মাধ্যমেই এসেছে দীর্ঘকাল। কাতার যখনই কোনো কারণে সহায়তা বন্ধ করতে গিয়েছে, ইসরায়েল তা চালু রাখতে অনুরোধ করেছে। অর্থাৎ ইসরায়েল গাজায় হামাসের দাপট খাটো করতে চেয়েছে বলে দেখা যায়নি। পাশাপাশি, হামাসের রাজনৈতিক লক্ষ্য এবং সামরিক কৌশলের মধ্যে ফিলিস্তিন সমস্যার কী ধরনের বাস্তব সমাধানের সুযোগ আছে, তা-ও পুরো স্পষ্ট নয়। ১৯৮৮ সালের ‘হামাস চার্টার’-এ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জিহাদের কথাই বলা আছে এবং সেই সনদ অনুযায়ী ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে ‘আলোচনা’র সুযোগ নেই। তবে ওই একই ইসরায়েলের সঙ্গেই হামাস যুদ্ধবিরতি ‘চুক্তি’ করছে বারবার!

মধ্যপ্রাচ্যে তেহরানের প্রভাব আরও বাড়ল; লাভ নেতানিয়াহুরও
হামাসের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বড় এক অর্জন তাদের সামরিক সক্ষমতার বৃদ্ধি। গাজায় তারা সমরাস্ত্র উৎপাদনের নিজস্ব অনেক কাঠামো গড়তে পেরেছে, যেকোনো প্রতিরোধ-সংগ্রামের জন্যই যা জরুরি। ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার সংগ্রামে পাথরের জায়গায় রকেটকে প্রতিস্থাপন হামাসের বড় অর্জন। এবারের ১১ দিনের যুদ্ধে তারা ইসরায়েলে প্রায় তিন হাজার রকেট ছুড়েছে। তাতে স্পষ্টই ইসরায়েল রাষ্ট্রে নিরাপত্তাহীনতার বোধ বেড়েছে। তবে, পাশাপাশি এ প্রশ্নও উঠেছে, হামাসের এই সমর-সক্ষমতায় মূল লাভ কার হচ্ছে? ইরানের? নাকি ফিলিস্তিনিদের?

ইরানের লাভের ইসরায়েলকে ঘিরে ফেলায়। কিন্তু ফিলিস্তিনের দরকার মাতৃভূমির জমিজমা ফেরত পাওয়া। সর্বশেষ যুদ্ধ শেষে তুরস্ক ও সৌদি আরবকে পেছনে ফেলে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে প্রধান একটি পক্ষ হিসেবে নিজেকে মোটাদাগে প্রতিষ্ঠা করেছে। আরব আমিরাত ও বাহরাইনের মতো দেশগুলো ইসরায়েলের বন্ধুত্ব বিকাশের যে পথ নিয়েছে, তাতে সর্বশেষ যুদ্ধ বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলল তাদের। এও ইরানের আঞ্চলিক লাভই বটে। এ লাভের বিপরীতে গাজায় ২৩০ জন গাজাবাসী মারা গেছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৭০ জন শিশুও। আহত প্রায় ২০০০। অনেক দেশই এখন গাজার পুনর্গঠনে নামছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার বিষয় আলোচনায় আসছে না।

হামাসের হামলায় ১২ জন ইসরায়েলিও মারা গেছে এবার। যুদ্ধে কেবল ফিলিস্তিনিরাই মরবে, সে ধারণা ক্রমে ভাঙছে। কিন্তু হামাসের সশস্ত্র উপস্থিতি ও চলমান সক্রিয়তায় ইরানের শাসকদের মতোই কৌশলগত বড় সুবিধাভোগী ইসরায়েলের শাসকরাও। হামাসের অনেক কাজ ইসরায়েলি শাসকেরা নিজেদের সমরবাদের ন্যায্যতা হিসেবে দেখান। ইসরায়েলের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অতিদক্ষিণপন্থীরা যখন জনসমর্থন খোয়াতে থাকে, তখনই তারা গাজায় একটা সংঘাত বাধায়। এতে তাদের জনসমর্থন বেশ খানিকটা বাড়ে। দক্ষিণপন্থী উপদলগুলোর ঐক্যে এটা বেশ জ্বালানি হিসেবে কাজ করে সেখানে এবং ফিলিস্তিন প্রশ্নে উদারনৈতিক দলগুলো তখন মাঠে দুর্বল হয়। পুরোদস্তুর বর্ণবাদের ওপর ভর করে এ কালে একটা দেশ শাসন করে যাওয়া কোনো গোষ্ঠীর পক্ষে সহজ নয়। ইসরায়েলের ভেতর গত দুই বছরে চার দফা নির্বাচন সেই সংকটেরই একটা দিক। সর্বশেষ গাজাযুদ্ধ ওখানকার বর্ণবাদীদের ওই সংকট থেকে জনতার চোখ অন্যদিকে সরাতে সাহায্য করছে।

হামাস-ফাত্তাহ বিভক্তিতে ব্যাপক স্বস্তিতে ইসরায়েল
ফিলিস্তিনের তরুণ-তরুণীদের কাছে হামাস জনপ্রিয়। সময়মতো ইসরায়েলকে তাৎক্ষণিক কিছু ‘জবাব’ দিতে পারছে হামাস। কিন্তু পাশাপাশি এ-ও সত্য, হামাসের আবির্ভাব ও তাদের রাজনৈতিক কৌশল ফিলিস্তিন আন্দোলনকে দুই ধারায় ভাগ করে ফেলেছে। বিভক্ত ফিলিস্তিন ইসরায়েলের শাসকদের জন্য বড় এক আশীর্বাদ। বিশেষ করে হামাস ও ফাত্তাহ যখন একপর্যায়ে রক্তাক্ত ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।

এই সংঘাতের সামরিক ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও হামাস রাজনৈতিকভাবে ফাত্তাহকে অনেক জটিল পরিস্থিতিতেই ফেলে দিয়েছে। ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হিসেবে হামাসের মূল প্রস্তাব ইসরায়েল রাষ্ট্রের নিশ্চিহ্নকরণ। এ রকম অবস্থান পিএলওকে ইসরায়েলের সঙ্গে যেকোনো আলোচনাতেই রাজনৈতিক ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। যেহেতু হামাস মানচিত্র থেকে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে মুছে দিতে আগ্রহী, সে কারণে পিএলওর পক্ষ থেকে ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে ‘এক দেশ’ বা ‘দুই দেশ’ বা অপর কোনো সমাধান-চিন্তা ‘আপস’ হিসেবে চিহ্নিত হতে বাধ্য। ফাত্তাহ এখন ঠিক এই রাজনৈতিক ফাঁদে আটকে আছে। ফাত্তাহর এই রাজনৈতিক পঙ্গুত্ব ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ স্বস্তি দিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে কাউকে ‘নিশ্চিহ্নকরণ’ তত্ত্বের খুব একটা ভালো সম্ভাবনা থাকে না। ইসরায়েল সহজে এখন দুনিয়াকে দেখাতে পারছে, ‘সমস্যার সমাধানে ফিলিস্তিনিরা আলোচনা চায় না।’ হামাস চার্টার তুলে ধরে ইসরায়েল নিজেদের বর্বরতারও আড়াল তৈরি করে। ফিলিস্তিন প্রশ্নে কথা বলতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে স্যান্ডার্স কিংবা করবিনের মতো পরিবর্তনবাদী রাজনীতিবিদদেরও তখন বেশ অস্বস্তিতে পড়তে হয়।

হামাস এবার যখন যুদ্ধ শুরু করে এবং যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়, সব সিদ্ধান্ত একাই নিয়েছে তারা। এবারের যুদ্ধ শুরুর বড় পটভূমি ছিল ইসরায়েলের ভেতর বিভিন্ন শহরে আরবদের বিরল এক গণ-আন্দোলন। হামাসের যুদ্ধবিরতি সেসব গণ-আন্দোলনকে সংবাদমাধ্যম থেকে অনেকাংশে মুছে দিয়েছে এখন। অথচ এর মধ্যেই গাজা ও তেহরানে ‘বিজয়’ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। অতীতেও অনেকবার হামাস এভাবে নিজেদের ‘বিজয়ী’ দাবি করেছে কিন্তু তাতে সংকীর্ণ অর্থে গাজায় এবং সামগ্রিক অর্থে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামে অর্জন কী দাঁড়াল, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা মিলছে না।

ফিলিস্তিনিদের আরও কার্যকর কোনো রণনীতি খুঁজে পেতে হবে
হামাস এবার যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি তেল আবিবেও সম্প্রসারিত করতে পেরেছে, যা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষকে উদ্দীপ্ত করে। এটা ইসরায়েলের আকাশ দুর্ভেদ্য থাকার মিথও ভেঙেছে অনেকখানি। কিন্তু আবার একই সঙ্গে সত্যি হলো, তাতে ফিলিস্তিনিদের নিত্যদিনের দুর্ভোগের বিপরীতে কোনো আশার ছবি যুক্ত হয়নি। তার দায় মোটেই হামাসের একার নয়। কিন্তু তাদের ‘বিজয়-উৎসব’-এর কোনো মানেও বোঝা যায় না তাতে। ফিলিস্তিনিদের হয়তো আরও কেজো কোনো রণনীতি খুঁজে পেতে হবে ভবিষ্যতে।

আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক