হিজরি সনের প্রথম মাস ঘটনাবহুল মহররম

ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। মহররম অর্থ সম্মানিত। পবিত্র কোরআনে রয়েছে, ‘আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর নিকট মাসের সংখ্যা ১২। এর মধ্যে চারটি মাস (মহররম, রজব, জিলকদ, জিলহজ) সম্মানিত।’(৯: ৩৬)। হাদিস শরিফে মহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলা হয়েছে। (মাজহারী)।

হিজরি সনের নামকরণ: মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর হিজরতের বছরকে প্রথম বছর ধরে এই সন গণনা শুরু করা হয়েছে বলে এর নাম হিজরি সন। হিজরি সনের সঙ্গে মুসলিম উম্মাহ তাহজীব তামাদ্দুন ও ঐতিহ্যগতভাবে সম্পৃক্ত। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি–কালচারে ও মুসলিম জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম।

আশুরা অর্থ দশম তারিখ। মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। আল্লাহ তাআলা এদিনে জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেছেন। এদিনে নুহ (আ.)–এর প্লাবন সমাপ্ত হয়। এদিন ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে ৪০ দিন পর নিরাপদে মুক্তি পান

আল–কোরআনে সৌরবর্ষ ও চান্দ্রবর্ষ: হিজরি সন চান্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষ—উভয়ভাবে গণনা করা হয়। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘আর সূর্য ও চন্দ্র হিসাবমতো চলে।’ (৫৫: ৫) ‘আমি রাত্রি ও দিবসকে করেছি দুটি নিদর্শন; রজনীর নিদর্শনকে আচ্ছাদিত করেছি এবং দিবসের নিদর্শনকে আলোকোজ্জ্বল করেছি; যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পারো এবং তোমরা যাতে বর্ষসংখ্যা ও হিসাব জানতে পারো।’ (১৭: ১২) ‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং উহার গমনপথ নির্ধারণ করেছেন; যাতে তোমরা বৎসর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো।’ (১০: ৫)

চান্দ্রমাসের তারিখ নির্ধারণপদ্ধতি: ওআইসির ফিকহ একাডেমিসহ বিভিন্ন ইসলামি গবেষণাকেন্দ্র ও মুসলিম পণ্ডিতেরা চান্দ্রতারিখ নির্ধারণের তিনটি পদ্ধতি ব্যবহারে স্বীকৃতি দিয়েছেন। যখন যোগাযোগব্যবস্থা অনুন্নত ছিল, তখন স্থানীয়ভাবে নতুন চাঁদ দেখে তারিখ নির্ধারণ করা হতো। নির্ভরযোগ্য উন্নত যোগাযোগব্যবস্থায় বিশ্বের যেকোনো স্থানে প্রথম নতুন চাঁদ দেখার ভিত্তিতে সারা বিশ্বে একই বারে একই তারিখ নির্ধারিত হতে পারে। অথবা সৌরপঞ্জির মতো চন্দ্রের আবর্তনের হিসাবের মাধ্যমে স্থায়ী চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসরণ করা; যেমন সৌর সময়কে হিসাব করে উদয়, অস্ত এবং নামাজ, ইফতার ও সাহ্‌রির স্থায়ী সময়সূচি তৈরি হয়েছে এবং ঘড়ি–ঘণ্টায় রূপান্তর করা হয়েছে।

হিজরি নববর্ষ উদ্‌যাপন: মুসলমানদের ধর্মীয় বিধিবিধান ও ইবাদত–বন্দেগি চান্দ্রতারিখের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই চান্দ্রতারিখের হিসাব রাখা ফরজে কিফায়া। উদাসীন জনগণ চান্দ্রতারিখের হিসাব কজনই রাখে! সুতরাং আরবি তারিখ চর্চায় রাখার জন্য হিজরি নববর্ষ উদ্‌যাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হিজরি নববর্ষ উদ্‌যাপন প্রিয় নবীজি (সা.)–এর হিজরতের বিরহ–বিচ্ছেদযন্ত্রণাকে স্মরণ করিয়ে দেয়; নবীপ্রেমে উজ্জীবিত করে।

আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব: আশুরা অর্থ দশম তারিখ। মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। আল্লাহ তাআলা এদিনে জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেছেন। এদিনে নুহ (আ.)–এর প্লাবন সমাপ্ত হয়। এদিন ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে ৪০ দিন পর নিরাপদে মুক্তি পান। এদিন ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। এদিনে আইয়ুব (আ.) রোগমুক্তি লাভ করেন। এদিনেই সুলাইমান (আ.) তাঁর হারানো রাজত্ব ফিরে পান। এদিনে ইয়াকুব (আ.) হারানো পুত্র ইউসুফ (আ.)-কে ৪০ বছর পর ফিরে পান। এদিনে ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং এদিনেই তাঁকে দুনিয়া থেকে আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়।

আশুরার আমল: আগে মুসলমানদের জন্য আশুরার রোজা ফরজ ছিল। দ্বিতীয় হিজরিতে শাবান মাসে রমজানের রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা সুন্নাত রয়ে যায়। তবে সুন্নাত রোজার মধ্যে আশুরার রোজা সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ। (তিরমিজি)। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট আমি আশাবাদী, তিনি পূর্বের এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ)। নবীজি (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে তার পরিবারের জন্য ভালো খাবারের আয়োজন করবে, আমি আশাবাদী আল্লাহ তাআলা সারা বছর তার জন্য ভালো আয়োজন রাখবেন।’(আবু দাউদ)।

শাহাদাতে কারবালা: আশুরার সর্বশেষ সংযোজন ‘শাহাদাতে কারবালা’। তাই দিনটি ‘শুহাদায়ে কারবালা দিবস’। কারবালা ট্র্যাজেডি আশুরাকে শোকাবহ করে তুলেছে। হজরত মুআবিয়া (রা.)–এর ইন্তেকালের পর ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে ইয়াজিদ মসনদে আরোহণ করে চক্রান্তকারীদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়। ফলে মক্কা, মদিনা, কুফাসহ বহু অঞ্চলের মানুষ তাকে খলিফা হিসেবে অস্বীকৃতি জানান। জনগণ হজরত হোসাইন (রা.)-কে খলিফা হিসেবে দেখতে চান। তাঁরা শত শত চিঠি পাঠিয়ে হোসাইন (রা.)-কে কুফায় এসে নিজেকে খলিফা ঘোষণার জন্য আমন্ত্রণ জানান। মহানবী (স.)-এর ওফাতের অর্ধশতাব্দী পর ৬১ হিজরির ১০ মহররম শুক্রবার নবীদৌহিত্র আলীর দুলাল ফাতেমা নন্দন জান্নাতের সরদার হোসাইন (রা.) শাহাদতবরণ করেন। (আল বিদায়া)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]