
জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের ওপর আণবিক বোমা হামলা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সাত দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। দীর্ঘ এই যাত্রাপথে জাপানের সেই দুই শহর এখন বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানুষের সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের সবচেয়ে পরিচিত এবং সবচেয়ে আবেগতাড়িত প্রতীকী শহর হিসেবে গণ্য। পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা কোনো এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে আমাদের ধরিত্রীকে ঠেলে দিতে পারে, সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ ৭০ বছর আগে জাপানের সেই দুই শহরের ভোগ করতে হওয়া মর্মান্তিক পরিণতির দিকে তাকিয়ে সহজেই তা আঁচ করে নিতে পারেন। সেদিক থেকে হিরোশিমা–নাগাসাকি এখন হচ্ছে শান্তির প্রতীক এমন দুই শহর, যা কিনা বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা হানাহানি আর পারমাণবিক অস্ত্রের লাগামহীন প্রতিযোগিতা বন্ধ করে শান্তির সন্ধানে মানুষের নিবেদিত হওয়ার বার্তা আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়। তবে কথা হচ্ছে, সেই বার্তা আমরা শুনতে পাচ্ছি কি?
বাইরের বিশ্বের কথা আমরা নাহয় বাদই দিলাম। স্বয়ং জাপানেও এখন অনেকেই আবারও নতুন করে এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। জাপানে সাম্প্রতিক সময়ে প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের প্রশাসন কোনোরকম রাখঢাক ছাড়াই দেশকে আবারও সমর প্রস্তুতির দিকে ঠেলে দেওয়ার জোর উদ্যোগ গ্রহণ করায় দেশের নাগরিকদের এই প্রশ্নটি ভাবিয়ে তুলছে। সে রকম দুর্ভাবনা থেকেই প্রায় সব বয়সী নারী-পুরুষ রাজপথে নেমে এসে নতুন করে সমরসজ্জা ও যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছেন। হিরোশিমা–নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞের ৭০তম বার্ষিকী ও সেই সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাপানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের সাত দশক পূর্ণ হতে যাওয়ার পূর্বক্ষণে এই প্রসঙ্গটি এখন জাপানজুড়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। সন্দেহ নেই, হিরোশিমা–নাগাসাকির মর্মান্তিকতার স্মরণে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান সেই বিতর্ককেই আরও জোরালো করে তুলবে।
জাপানের দুটি শহরকে মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে আণবিক বোমা হামলার শিকার হতে হলেও আণবিক বোমার ভয়াবহতা এবং ভয়াবহ সেই পরিণতি এড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে জনমত সৃষ্টি ও প্রচারের বেলায় হিরোশিমার নাম নাগাসাকির চেয়ে অনেক বেশি উচ্চারিত হতে শোনা যায়। শুধু তা-ই নয়, আণবিক বোমা যে মর্মান্তিক পরিণতি নাগরিক জীবনে নিয়ে এসেছিল, সেসব কাহিনির বর্ণনায়ও হিরোশিমা অনেক বেশি উপস্থিত। এর প্রধান কারণ অবশ্যই হচ্ছে নাগাসাকির চেয়ে মাত্র তিন দিন আগে (৬ আগস্ট ১৯৪৫) বিশ্বের প্রথম শহর হিসেবে হিরোশিমার আণবিক বোমা হামলার পরিণতি সইতে হওয়া। তবে তাই বলে নাগাসাকির ক্ষয়ক্ষতি এবং ধ্বংসের বিস্তৃতি কিন্তু হিরোশিমার চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না।
৭০ বছর আগে ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট নাগাসাকি শহরের ক্যাথলিক গির্জার ঠিক ওপরে ফেলা আণবিক বোমা সেই দিনই ৭০ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিকের প্রাণ হরণ করেছিল এবং দীর্ঘমেয়াদি সময়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল আরও অনেক বেশি। হিরোশিমার মতোই প্রাণে বেঁচে যাওয়া অনেককেই দীর্ঘকাল ধরে সইতে হয়েছে নানা রকম শারীরিক ও সামাজিক প্রতিকূলতা। কিছুদিন আগেও এমন এক সময় জাপানে ছিল, ‘হিবাকুশা’ নামে পরিচিত আণবিক বোমা হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোকজন যখন তাঁদের দুঃখ আর বেদনার কথা প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করতেন। যুদ্ধের ঠিক পরপর যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি দখলে জাপান থাকার সময় আণবিক বোমাসংক্রান্ত সব রকম খবর প্রচারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এবং পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সামাজিকভাবে করুণার দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতা এঁদের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখার মনোভাব জাগিয়ে তুলেছিল। ফলে নিজেদের দুঃখের কথা অন্যদের বলায় এঁদের মধ্যে অনাগ্রহ ছিল।
তবে পরবর্তী সময়ে অবশ্য বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী আন্দোলন আরও অনেক বেশি জোরালো হয়ে ওঠার মুখে জাপানেও সেই ঢেউ এসে লাগে এবং দেশের অনেকেই আণবিক বোমা হামলার সরাসরি শিকার যাঁদের হতে হয়েছিল, তাঁদের মুখ থেকে সেই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা শুনে নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সে রকম অনুকূল পরিবেশ ‘কাতারিবে’ নামে পরিচিত কথক বা গল্প বলার বোমা হামলার শিকার লোকজনের আবির্ভাবের সুযোগ করে দিয়েছিল, অনেকটা নিয়মিতভাবে যাঁরা এখন বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁদের সেই দুর্দশার স্মৃতি তুলে ধরছেন। তবে এঁদের মধ্যে যাঁরা এখনো জীবিত, তাঁদের সবাই বয়োবৃদ্ধ হয়ে পড়ায় সেই স্মৃতি মানুষের কাছে কথা বলার মধ্য দিয়ে পৌঁছে দেওয়ার লোকজন অল্প কয়েক বছর পর আর হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই অভাব পূরণ করে নিতে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান অবশ্য তরুণদের প্রতি সেই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছে, হিবাকুশাদের কাছ থেকে তাঁদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে নিয়ে ঠিক সেভাবে মানুষের কাছে তা বলার চর্চা যাঁরা এখন করছেন। ফলে হিবাকুশাদের চলে যাওয়ার পরও তাঁদের স্মৃতি অম্লান রাখার কাজ জাপানে ঠিকই এগিয়ে চলেছে।
আণবিক বোমা হামলার ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি জাপানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পর থেকে বেশ কিছুকাল নিষিদ্ধ একটি বিষয় হিসেবে গণ্য ছিল। ম্যানহাটন প্রকল্প নামে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক বোমা তৈরির গবেষণার প্রধান যিনি ছিলেন, সেই মার্কিন জেনারেল লেসলি গ্রোভস যেমন মার্কিন সিনেটের এক শুনানিতে বলেছিলেন যে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এসে মৃত্যুবরণ করা কার্যত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রণা ভোগ না করে মারা যাওয়া এবং সত্যিকার অর্থে সেভাবে মারা যাওয়া হচ্ছে বেশ সুখকর এক অভিজ্ঞতা। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকেরা বাস্তবিক অর্থেই বিশ্বকে সেই ধারণা দিতে চেয়েছিলেন বলেই হিরোশিমা–নাগাসাকির মর্মান্তিকতার ঘটনা চেপে রাখা তাঁদের জন্য আবশ্যকীয় হয়ে দেখা দিয়েছিল।
জন হার্সির লেখা হিরোশিমার বোমা হামলা পরবর্তী সময়ের মর্মান্তিক বিবরণ সারা বিশ্বের পাঠক জেনে যাওয়ার পরও নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে জাপানি পাঠকেরা অনেক দিন ধরে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সেই বই পাঠ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তবে মার্কিন দখলদারির অবসানের পর থেকে ধীরে সেই নিষিদ্ধ দুয়ার উন্মোচিত হয় এবং এখন অনেকেই আগ্রহ নিয়ে হিবাকুশা এবং এঁদের মধ্যে যাঁরা আবার গল্পের আকারে সেই মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরতে পারদর্শী, তাঁদের মুখ থেকে সরাসরি সেই ইতিহাস জেনে নিতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। পাশাপাশি হিরোশিমা আর নাগাসাকি দুই শহরই স্মৃতি ধরে রাখা এবং পারমাণবিক অস্ত্র বিশ্ব থেকে বিলুপ্ত করার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার নানা রকম উদ্যোগ নিয়মিতভাবে গ্রহণ করে চলেছে। হিরোশিমার বিধ্বস্ত গম্বুজ তো এখন অনেকটাই যেন পরমাণুমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার এক প্রতীক হয়ে উঠেছে।
নাগাসাকির সে রকম ব্যতিক্রমী একটি উদ্যোগ হচ্ছে শহরের কেন্দ্রস্থলে গড়ে ওঠা শান্তি পার্ক। পার্কের পরিচিত প্রতীক হলো ১৯৫৫ সালে আণবিক বোমা হামলার দশম বার্ষিকীতে সেখানে বসানো ১০ মিটার উঁচু ভাস্কর্য, এক হাত প্রসারিত করে এবং অন্য হাত আকাশের দিকে সোজা উঁচু করে ধরে রেখে যে ভাস্কর্য একই সঙ্গে পরমাণু অস্ত্রের হুমকি এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে। ভাস্কর্যটির নকশা করেছেন সেইবো কিতামুরা এবং জাপান ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ-সাহায্যে সেটা তৈরি করা হয়।
এই ভাস্কর্যকে ঘিরে গড়ে ওঠা উদ্যানটি হলো নাগাসাকির শান্তি উদ্যান। নাগাসাকি নগর কর্তৃপক্ষ উদ্যানের আন্তর্জাতিক আকার দেওয়ার জন্য ১৯৭৮ সালে সেখানে শান্তি ভাস্কর্য স্থাপনের আহ্বান বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতি জানিয়েছিল। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেই একই বছর প্রথম সেখানে শান্তির প্রতীক একটি ভাস্কর্য স্থাপন করে পর্তুগালের পোর্তো নগরী। পোর্তোর সঙ্গে নাগাসাকির রয়েছে সিস্টার সিটি বা সহোদরা শহর চুক্তি। এ ছাড়া পর্তুগিজরা ছিল নাগাসাকিতে বাণিজ্যঘাঁটি গড়ে নেওয়া প্রথম বিদেশি, যদিও অল্প কিছুকাল পরে সেখান থেকে তাদের বিতাড়িত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আরও প্রায় ১৫টি দেশ ও শহর সেখানে ভাস্কর্য স্থাপন করায় নাগাসাকির শান্তি উদ্যান পেয়েছে ভিন্ন এক আন্তর্জাতিক চেহারা।
বছর দু-এক আগে টোকিওর বাংলাদেশ দূতাবাস বাংলাদেশের একটি ভাস্কর্য সেখানে বসিয়ে নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে নাগাসাকি শহর কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের সেই উদ্যোগে আনন্দের সঙ্গে সাড়া দেয়। বাংলাদেশের ভাস্কর্যের নকশা এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। ফলে আশা করা যায়, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নাগাসাকির শান্তি উদ্যানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও ভিন্ন এক আঙ্গিকে শান্তির প্রতি দেশের প্রত্যয়ের প্রকাশ তুলে ধরবে। আর আমাদের সেই ভাস্কর্যটি হবে এশিয়ার হাতে গোনা কয়েকটি দেশের সেখানে বসানো ভাস্কর্যের একটি। নাগাসাকির শান্তি উদ্যান এখন বাংলাদেশের ভাস্কর্যের আগমনের অপেক্ষায়।
টোকিও, ২ আগস্ট ২০১৫
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক৷