হুদা মডেলের আরেকটি নির্বাচন কমিশন নয়

পাঁচ বছরে নূরুল হুদা কমিশন হাজার হাজার নির্বাচন করেছে। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে এসব নির্বাচন ছিল সহিংস, সংঘাতময় ও জবরদস্তিমূলক

আজ ১২ ফেব্রুয়ারি। ১৪ ফেব্রুয়ারি কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। এরপরই এ কমিশনের পদাধিকারীরা সাবেক হয়ে যাবেন। ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁরা দায়িত্ব নেন। তাঁদের আগমন ও নির্গমনপর্বের মধ্যে বিরাট ফারাক। পাঁচ বছর আগে এ কমিশন যখন দায়িত্ব নেয়, মানুষের মধ্যে আশা ছিল হয়তো তাঁরা ভেঙে পড়া নির্বাচনী ব্যবস্থাটি পুরোপুরি মেরামত করতে না পারলেও চেষ্টা করবেন।

পাঁচ বছরে নূরুল হুদা কমিশন হাজার হাজার নির্বাচন করেছে। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে এসব নির্বাচন ছিল সহিংস, সংঘাতময় ও জবরদস্তিমূলক। আবার কোনো কোনো নির্বাচন ছিল ভোটারবিমুখ। এ কমিশনের অধীন সর্বশেষ নির্বাচন হয় গত বৃহস্পতিবার মাত্র সাতটি ইউনিয়নে; যা শেষ হয়েছে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, নির্বাচন কমিশন অফিস, গাড়ি ভাঙচুরে, ব্যালট পত্রে পাইকারি সিল মারার মধ্য দিয়ে। এর আগে সাত দফা ইউপি নির্বাচনে ১০১ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ১৩ বছরের এক শিশু গিয়েছিল ভোট দেখতে। কেন্দ্রের বাইরে সন্ত্রাসীরা তাকে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে। অথচ নির্বাচনী কেন্দ্রের নিরাপত্তা কিংবা জনশৃঙ্খলা নিয়ে ইসির কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তফসিল ঘোষণা ও নির্ধারিত সময়ে ফলাফল ঘোষণার মধ্যে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সীমিত ছিল। এ অবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল ও প্রার্থীরা যে যেখানে পারেন, জবরদস্তি করেছেন। চর দখলের মহড়া দিয়েছেন।

আমরা যখন নূরুল হুদা কমিশনের সালতামামি করছি, তখন তঁাদের অভিষেকের সময়ের কথাও মনে পড়ছে। বাংলাদেশের মানুষ বরাবর আশাবাদী। রকিব কমিশনের বিপুল ব্যর্থতা সত্ত্বেও তাঁরা আশা করেছিলেন যে হুদা কমিশন অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্তত নির্বাচনটি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন। হুদা কমিশন দায়িত্ব নিয়ে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপও করেছিল। এ রকম একটি সংলাপে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য এই কলাম লেখকেরও হয়েছিল। সে সময় সাংবাদিকেরা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করা এবং ইসিকে নিরপেক্ষ থাকার বিষয়ে অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন। সিইসি নূরুল হুদা সহকারীদের ওপর নির্ভর না করে নিজেই সেসব নোট নিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তাঁরা সেসব পরামর্শের ধারেকাছে যাননি। কাজ করেছেন ওপরের নির্দেশ অনুযায়ী। থানা-পুলিশে একটি কথা বেশ চালু আছে। কেউ গ্রেপ্তার হওয়ার পর কারণ জানতে চাইলে তাঁরা মুখস্থ জবাব দেন, ‘ওপরের নির্দেশ আছে।’ বাংলাদেশের সবকিছু চলে ওপরের নির্দেশে। তাই বলে যে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির ওপর ১১ কোটি ভোটারের ভোট আমানত, তাঁরাও ওপরের নির্দেশে চলবেন?

নূরুল হুদা কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারেনি, এ কথা সবার জানা। কিন্তু যেটি প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে গেছে, সেটি হলো বাজারদরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে ইভিএম কেনা, নির্বাচনী কর্মশালার রুটিন দায়িত্ব পালন করে পদাধিকারীদের মোটা অঙ্কের সম্মানী নেওয়া ইত্যাদি। শেষবেলায় এসে আদালত অবমাননা মামলারও মুখোমুখি হতে হলো সিইসি কে এম নূরুল হুদাকে।

সত্য যে সরকার বা নির্বাহী বিভাগ না চাইলে দেশে সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা প্রায় অসম্ভব। নির্দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে যে কয়টা নির্বাচন হয়েছে, সেখানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল না বলেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। মানুষ আস্থা রেখেছে। ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনের আগে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ বলেছিলেন, নির্বাচন নিয়ে কেউ মাস্তানি করলে তিন গুণ মাস্তানি দিয়ে কমিশন তা মোকাবিলা করবে। তারপরও তিনি সেই মাস্তানি বন্ধ করতে পারেননি। তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। আওয়ামী লীগ আমলে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে কারচুপির ঘটনা ঘটলে সিইসি মোহাম্মদ আবু হেনা গেজেট প্রকাশ স্থগিত রাখেন। এই দুই সিইসি চেষ্টা করেও ক্ষমতাসীনদের ভোট কারচুপি ঠেকাতে পারেননি। আর হুদা কমিশন একবারের জন্য সে চেষ্টাও করেনি।

নির্বাচনে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা, কারচুপি, জবরদখল নিয়ে সিইসির দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেছেন, ‘আমরা কী করতে পারি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তঁারা অন্তত নির্বাচনটি স্থগিত করতে পারতেন।’ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও পরে কমিশন পিছু হটে। সিইসি যুক্তি দেখিয়েছেন, সেখানে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা নিরাপদে ফিরে আসতে পারতেন না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রশাসন তো তাদের অধীনেই ছিল। প্রশাসন শক্ত হলে যে দলীয় মাস্তানি নিমেষে থেমে যায়, সেটি তো পরে বরিশালের ডিসি ও সদর উপজেলার ইউএনও প্রমাণ করেছেন। নির্বাচন কমিশনের কাছে সব দল ও প্রার্থীই সমান।

আরও পড়ুন

নূরুল হুদা কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারেনি, এ কথা সবার জানা। কিন্তু যেটি প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে গেছে, সেটি হলো বাজারদরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে ইভিএম কেনা, নির্বাচনী কর্মশালার রুটিন দায়িত্ব পালন করে পদাধিকারীদের মোটা অঙ্কের সম্মানী নেওয়া ইত্যাদি। শেষবেলায় এসে আদালত অবমাননা মামলারও মুখোমুখি হতে হলো সিইসি কে এম নূরুল হুদাকে। মামলা করেছেন জনসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি। গণসংহতি আন্দোলন রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন চেয়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ইসির কাছে আবেদন করে। ২০১৮ সালের জুন মাসে ইসি চিঠি দিয়ে জানায় নিবন্ধন করা যাবে না। পরে জোনায়েদ সাকির করা রিটের জবাবে উচ্চ আদালত ২০১৯ সালের এপ্রিলে ৩০ দিনের মধ্যে নিবন্ধন দেওয়ার আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। এরপরও ইসি কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় ১১ ফেব্রুয়ারি মামলাটি করা হয়।

আরও পড়ুন

নূরুল হুদা কমিশন নিয়ে যখন এই কলাম লিখছি, তখন নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে তোড়জোড় চলছে। সার্চ কমিটি বিভিন্ন দলের কাছে নাম চেয়েছে। অনেকে নাম দিয়েছে। আবার কেউ কেউ নাম দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও সার্চ কমিটির বৈঠক করার কথা আছে। অন্যদিকে শত শত ‘যোগ্য মানুষ’ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। কেউ কেউ সকাতর কণ্ঠে বলছেন, ‘আমার বিষয়টি একটু দেখবেন।’ তাঁদের বেশির ভাগই সাবেক আমলা।

যেখানে সার্চ কমিটি পাঁচজন ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে দেশে হঠাৎ করে এত যোগ্য লোকের আবির্ভাব ঘটল কীভাবে? যাঁরা সার্চ কমিটির কাছে নিজেদের নাম জমা দিয়েছেন, তাঁদের কেউ গত পাঁচ বছরে নির্বাচন নিয়ে একটি কথাও বলেননি। তাহলে এখন কমিশনার হওয়ার খায়েশ হলো কেন? সেটি কি নির্বাচন কমিশনকে সঠিক পথে আনার জন্য, না অবসরজীবনে পাঁচ বছর জনগণের অর্থে আরাম-আয়েশ করার জন্য? তঁারা হয়তো ভাবছেন, হুদা কমিশন যখন নানা অনাচার করে পার পেয়ে গেছে, তাঁদেরও জবাবদিহি করতে হবে না। হঠাৎ নির্বাচন কমিশনার হওয়ার খায়েশ যাঁদের জেগেছে, তঁাদের একটি কথাই বলতে চাই, দেশবাসী হুদা মডেলের আর কোনো কমিশনকে মেনে নেবে না। তারা এমন নির্বাচন কমিশনই চায়, যারা সত্যিকারভাবেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে পারবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে সেটি পারলে অন্তত পদত্যাগ করার সাহস দেখাবেন। জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না।

বন্ধুদের অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে এত লেখালেখি, এত সমালোচনায় লাভ কী হলো। লাভ একেবারে হয়নি তা বলা যাবে না। লেখালেখির কারণে তাঁদের ‘ফুলের মতো পবিত্র’ চরিত্রটি জাতির সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে। ভবিষ্যতে যঁারাই কমিশনের দায়িত্ব নিন না কেন, হুদা মডেলে চলতে পারবেন না।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

    [email protected]