হেফাজতের চাওয়ামতোই ছাপব পাঠ্যবই?

বিদ্যালয়ের শিশু-কিশোরেরা কী পড়বে, কী পড়বে না, সেটি ঠিক করার মালিক কে?

আমরা এত দিন জেনে এসেছি, দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তারা ঠিক করে, পাঠ্যবইয়ে কী থাকবে। কিন্তু ২০১৭ সালে এসে জানলাম, শিক্ষাবিদেরা নন, শিশু-কিশোরেরা কী পড়বে, কী পড়বে না, সেটি ঠিক করবে হেফাজতে ইসলাম নামের একটি সংগঠন।

গত বছর তারা পাঠ্যবইয়ে ২৯টি বিষয় সংযোজন ও বিয়োজনের কথা বলেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সরকার বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা বিলম্ব না করে সব দাবি মেনে নিয়েছে। তাদের একবারও মনে পড়ল না, ২০১৩ সালের ৫ মে এই সংগঠনের নেতা-কর্মীরা কী কাণ্ড করেছিল। হেফাজতের অনুসারী হাজার হাজার লোক ঢাকায় এসে মহাতাণ্ডব চালিয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, বিএনপি-জামায়াত হেফাজতের সঙ্গে হাতে মিলিয়ে সরকার উৎখাতের চেষ্টা করছে। অর্থাৎ বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজত এক মোহনায় এসে মিলিত হয়েছিল। কিন্তু সেই সমীকরণ অনেকটাই বদলে গেছে। বিএনপি ও জামায়াতের সখ্য অটুট আছে। আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে নতুন করে বন্ধুত্ব গড়েছে হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটি। কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দেওয়ায় তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে।

হেফাজতের দাবি অনুযায়ী সরকার গত বছর পাঠ্যবইয়ে যে কাঁচি চালিয়েছে, তার উপশম সহজে হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তারপরও যাঁরা আওয়ামী লীগকে সেক্যুলার ও অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে দেখতে চান, তাঁরা মনে-প্রাণে আশা করেছিলেন, চলতি বছর স্কুলের পাঠ্যবইয়ে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে, সেগুলো সরকার সংশোধন করবে এবং আগামী বছর পাঠ্যবইয়ে বাদ দেওয়া গল্প-কবিতাগুলো পুনঃস্থাপিত হবে। কেননা, বাদ দেওয়া গল্প-কবিতার কোনোটিতে আপত্তিকর কিছু ছিল না। সত্যেন সেন প্রতিষ্ঠিত প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী এ বছর পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া লেখাগুলো নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করে সুধীজনদের কাছে পাঠিয়েছে। পড়ে দেখলাম, এসব লেখায় ধর্মের বিরুদ্ধে একটি কথাও নেই।

হেফাজতে ইসলামের পরামর্শক্রমে সরকার কোনো কোনো লেখা বাদ দিয়েছে লেখক হিন্দু সম্প্রদায়ের বলে। এভাবে পৃথিবীর কোথাও কি সাহিত্যের গুণাগুণ বিচার হয়? যাঁরা পাঠ্যবই থেকে হিন্দু লেখকদের রচনা বাদ দিয়েছেন এবং যাঁরা সুপারিশ করেছিলেন, তাঁদের জানার কথা যে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন বাংলা ভাষায় প্রথম অনুবাদ করেছেন ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন। তিনি মুসলমান নন, হিন্দু। বাংলাদেশের নরসিংদীতেই তাঁর জন্ম।

অনেকেই আশা করেছিলেন, বাতিল হওয়া লেখাগুলো পুনঃসংযোজন করা হবে। এই আশাবাদ আরও পোক্ত হয়েছিল যখন পাঠ্যবই নিরীক্ষণে শহীদজায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির প্রধান হিসেবে তিনি বাদ দেওয়া রচনাগুলো সংযোজনের সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর সুপারিশগুলো নাকচ হয়ে গেছে।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, বিশেষজ্ঞ প্রস্তাব ও বিভিন্ন মহলের দাবি থাকলেও পাঠ্যবই থেকে হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী বাদ দেওয়া বিষয়গুলো পুনঃস্থাপন করা হচ্ছে না। বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন ছাড়াই আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সংস্থাটির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহার ভাষ্যমতে, এবার পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুতে কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা যে ১২টি বই নিয়ে কাজ করেছেন, সেগুলোয় শুধু পরিমার্জন করা হয়েছে। এর ফলে ছোটখাটো ভুলত্রুটি থাকবে না।

চলতি বছরের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ে, বিশেষ করে বাংলা ও আনন্দপাঠে বিষয়বস্তু পরিবর্তনে হেফাজতে ইসলামের দাবির প্রতিফলন ঘটে। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই সংগঠন ২৯টি বিষয় সংযোজন ও বিয়োজনের কথা বলেছিল, যার সব কটি মেনে নেওয়া হয়। এমনকি সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির দুটি পাঠ্যবই কয়েক লাখ কপি ছাপার পর সেগুলো গুদামে রেখে দুটি লেখা বাদ দিয়ে নতুন করে বই ছাপানোর ঘটনাও ঘটে।

মাধ্যমিকের ১২টি বই নির্ভুল ও সহজ করার জন্য যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়, তার একটির প্রধান নবম-দশম শ্রেণির বাংলা বই থেকে হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী বাদ দেওয়া বিষয়গুলো পুনঃস্থাপন করতে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেন। ওই দুটি শ্রেণির বাংলা বইয়ে হেফাজতের দাবি অনুযায়ী পাঁচটি পদ্য বাদ দেওয়া হয়। সেগুলো হলো জ্ঞানদাসের ‘সুখের লাগিয়া’, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘আমার সন্তান’, লালন শাহর ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা’ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে’। বাদ দেওয়া গদ্যটি হলো ভ্রমণকাহিনি ‘পালামৌ’।

খবর অনুযায়ী, আগামী বছরের পাঠ্যবইয়ে বিষয়বস্তুতে কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না। কেবল প্রাথমিকের পাঠ্যবই থেকে গাছে ওঠানো ছাগলের ছবি নামানো, ‘ও-তে ওড়নার’ বদলে ‘ওজন’ শব্দ ও ছবি অন্তর্ভুক্ত করাসহ কিছু ভুল ও বিতর্কিত বিষয় পরিমার্জনই যথেষ্ট মনে করছে এনসিটিবি।

এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ‘পাঠ্যবই নিয়ে সব সময়ই কিছুটা ভিন্নমত থাকে’ বলে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে মূল সমস্যাটিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেছেন, ‘পাঠ্যবইয়ে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র হওয়া উচিত। কারণ, পাঠ্যবই পড়ে শিশুরা গড়ে ওঠে। সেখানে যদি হেফাজতীকরণ হয়, তাহলে অসাম্প্রদায়িক চরিত্র নষ্ট করে, যা রাষ্ট্রচেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।’ তাহলে পাঠ্যপুস্তকের ক্ষেত্রে কি আমরা পেছনেই হাঁটতে থাকব? এরপর যদি অন্য সংগঠন অন্য কোনো বই সম্পর্কে তাদের ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত লাগার কথা বলে, তখন কি সরকার সেগুলো বাদ দেবে?

সম্প্রতি ভারতের সাংবাদিক প্রতিম রঞ্জন বসু হিন্দু বিজনেস অনলাইনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে লিখেছেন, জনপ্রিয়তা হ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন দল (আওয়ামী লীগ) মনে করে, এর মধ্য দিয়ে মৌলবাদীদের ভোট ব্যাংক বিভক্ত করে তারা বিজয় নিশ্চিত করবে। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ মনে করে, এতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার পার্থক্য কমে গেছে। হয়তো কমতে কমতে একসময় পার্থক্যটিই পুরোপুরি মুছে যাবে।

তখন আর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ-বিপক্ষ বলে কিছু থাকবে না। সব এক পক্ষ হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ সরকার সম্ভবত বাংলাদেশকে ওদিকেই নিয়ে যাচ্ছে?

সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক