২০২৩ বিশ্বকাপ জিততে পারে বাংলাদেশ, যদি...

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এই কথাটা খুবই সত্য। আপনি যদি বড় স্বপ্ন না দেখেন, তাহলে আপনি বড় হবেন না। বড় স্বপ্ন দেখলেই বড় হওয়া যায় না; কিন্তু স্বপ্ন না দেখে, পরিকল্পনা না করে, প্রস্তুতি না নিয়ে, সাধনা না করে, ত্যাগ স্বীকার না করে কেউ বড় কিছু অর্জন করেছে, তা-ও হয় না। কাজেই স্বপ্ন বড় হতে হবে।

২০২৩ আইসিসি ছেলেদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতবে বাংলাদেশ, এই স্বপ্নের কথাই বলছি। আমরা যদি এই স্বপ্ন এখন থেকেই দেখতে থাকি এবং সে লক্ষ্যে এখন থেকে পরিকল্পনা করে কঠোর সাধনা করে যেতে থাকি, এটা খুবই সম্ভব যে ভারতে অক্টোবর-নভেম্বর ২০২৩-এ অনুষ্ঠিতব্য এই বিশ্বকাপ আসরে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হতে পারে।

কিশোর আলোর অনুষ্ঠানে এসে সাকিব আল হাসান বলেছিলেন, স্বপ্ন এটা না, যা বাস্তবে ঘটে থাকে। আমি ডাক্তার হব বা আমি আমেরিকা যাব, এটা স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন হতে পারে, আমার পাখা আছে, আমি আকাশে উড়ব। আমরা জানি, মানুষ একদিন স্বপ্ন দেখেছিল সে আকাশে উড়বে, এখন শুধু আকাশে নয়, মহাকাশে মানুষ উড়ছে। আমরা বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হব, এই স্বপ্ন আমাদের বহুদিনের। ২০২৩ সালে এটা খুবই অর্জনযোগ্য একটা লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। এবং নিকট ভবিষ্যতে আমাদের জন্য ভালো করার শেষতম সুবর্ণ সুযোগ ২০২৩ বিশ্বকাপ। সাকিব, তামিম, মুশফিক ও রিয়াদের সম্ভবত এটা শেষ বিশ্বকাপ।

প্রথমে আশার কথাগুলো বলে নিই। এই মুহূর্তে ওয়ান ডে সুপার লিগের পয়েন্ট তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এক নম্বর। ১৮টা ম্যাচ খেলে ১২টায় জিতে বাংলাদেশের পয়েন্ট ১২০। দুই নম্বরে আছে ইংল্যান্ড। ১৫ খেলা খেলে ৯টায় জয়লাভ করে তাদের পয়েন্ট ৯৫। ভারত আছে তিন নম্বরে। যদিও আইসিসি ওডিআই র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ নম্বর। তবে র‌্যাঙ্কিং দিয়ে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায় না। খেলা হয় মাঠে, পরিসংখ্যান তাকে জেতায়ও না, হারায়ও না।

আমি সম্প্রতি ভারতীয় চলচ্চিত্র এইটি থ্রি (৮৩) দেখেছি। ১৯৮৩ সালে কপিল দেবের নেতৃত্বে যখন ভারত ইংল্যান্ডে যাচ্ছিল বিশ্বকাপে অংশ নিতে, তখন কোনো ভারতীয়ও বিশ্বাস করত না যে এই দল চ্যাম্পিয়ন হতে পারে। আমাদের মনে পড়বে, যে-ভারত দল ১৯৪৮ সালে অলিম্পিকে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ফুটবল ম্যাচ খেলতে নেমেছিল, তাদের অনেকের পায়ে জুতা ছিল না। ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপযাত্রার সময় ভারতীয় ক্রিকেট দলের আর্থিক অবস্থা এবং তাদের প্রতি দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর আশা-ভরসা এ রকমই গরিবি হালের ছিল। তাদের কোনো কোচ ছিল না। ম্যানেজার লন্ডনে গিয়ে লর্ডসের ফাইনাল খেলা দেখার পাস চেয়েছিলেন; কর্তৃপক্ষ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিল, ভারত তো আর ফাইনাল খেলবে না, কাজেই এই পাসের দরকার নেই। যদি ভারত ফাইনালে যায়? তাহলে অবশ্যই লর্ডসের পাস দেওয়া হবে, এই ছিল উত্তর।

এইটি থ্রি নামের সিনেমায় দেখানো হয়েছে, ভারতীয় দল লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে নেমেছে, তাদের বরণ করে নেওয়ার জন্য কেউ নেই, খেলোয়াড়েরা এয়ারপোর্টের বাইরে এসে এদিক-ওদিক বিভ্রান্তের মতো তাকাচ্ছে, বাস কোথায়! আর দুইবারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল যখন পা রাখল বিমানবন্দরে, শত শত ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক, ফ্লাশ লাইট চোখ ঝলসে দিচ্ছে। ভারতীয় খেলোয়াড়েরা পাউন্ড গুনছেন ছোট্ট খামে, কী খাবেন, তারও ঠিক নেই। কেউ নিরামিষভোজী, তাদের খাওয়ার কিছু নেই, প্রায় না খেয়ে কাটানোর অবস্থা। প্রবাসী ভারতীয়দের বাড়িতে নেমন্তন্ন পেলে তারা বর্তে যায়। ভারতীয় দলের এই গরিবি হালের কারণ ছিল এর আগে ভারত বিশ্বকাপে একটা মাত্র ম্যাচ জিতেছিল, তাও পূর্ব আফ্রিকা নামের একটা চার দেশের জোড়াতালি দেওয়া টিমের সঙ্গে। ডেভিড ফ্রিথ নামের বিখ্যাত ক্রিকেট ভাষ্যকার বলেছিলেন, যদি ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়, তিনি তাঁর কথা গিলে খাবেন। সেই ভারত সে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এবং অন্তত সিনেমায় দেখানো হয়েছে, ডেভিড ফ্রিথ তাঁর কথা ছাপানো কাগজটা চিবিয়ে খাচ্ছেন।

আমরা শুধু বলব, বড় স্বপ্ন রচনা করুন, ২০২৩ সালে আমরা বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হব। এটা যদি হয়, পুরো দেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে, এই সাফল্য অন্য অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য ছিনিয়ে আনার প্রেরণা হয়ে দেখা দেবে। আর যদি চ্যাম্পিয়ন না হই? তাতেও কোনো ক্ষতি নেই। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চেষ্টা করে চ্যাম্পিয়ন হতে না পারার মধ্যে কোনো অগৌরব নেই, কিন্তু আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে আসিনি--এ রকম ভাবাটা শুধু অগৌরবের নয়, অপরাধ বলে গণ্য হওয়া উচিত।

আমরা ধারণা করতে পারি, আমাদের ক্রিকেটাররা এই সিনেমাটা দেখেছেন। দেখুন বা না দেখুন, বাংলাদেশ ক্রিকেটকর্তাদের উচিত, পুরো টিমকে একসঙ্গে করে অন্ধকার ঘরে বসিয়ে এই সিনেমাটা একবার দেখানো। তারপর বলা, সেই আশা-ভরসাহীন ভারত যদি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, আমরা কেন পারব না?

আমাদের আছেন পৃথিবীর এক নম্বর অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। আমাদের আছেন পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল। বিশ্বকাপের বড় মঞ্চ মোস্তাফিজের জাদু দেখার অপেক্ষা করছে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ তো বড় মঞ্চেরই নায়ক। মুশফিক হলেন অধ্যবসায়ী ভালো ছাত্র, কঠোর অনুশীলন আর প্রতিজ্ঞা বিশ্বকাপের মঞ্চ তাঁর সেরাটাই দেখানোর জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠবে। আমাদের লিটন দাশের ব্যাটিং তো দেখার মতো। তাসকিন, শরিফুলের মতো পেসাররা সম্প্রতি খুবই ভালো করছেন। আমাদের স্পিনাররা চিরকালের সম্পদ। মেহেদী হাসান মিরাজের মতো টগবগে খেলোয়াড়েরা যেমন মাঠকে উজ্জীবিত রাখেন, তেমনি নতুন আফিফ-সোহান-জয় আমাদের নতুন আশায় বুক বাঁধতে প্রাণিত করেন।

এখন দরকার আমাদের ক্রিকেট-পরিকল্পকদের সঠিক পরিকল্পনা। আমি ক্রিকেটের ‘ক’ও বুঝি না, তাই ক্রিকেটের টেকনিক্যাল দিক নিয়ে আমি একটা কথাও বলব না। তবে অন্যদের কতগুলো অভিজ্ঞতার কথা আমরা আলোচনা করতেই পারি। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, এর মূলে ছিল দুটো জিনিস। এক, বহুদিন ধরে তারা অভিন্ন টিম নিয়ে খেলেছে। ফলে, খেলোয়াড়দের মধ্যে বোঝাপড়া ছিল ভালো। দুই, তারা প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করে প্রথম ১৫ ওভারে বেশি রান তুলে খেলার রকমটাই পাল্টে দিয়েছিল। ব্রাজিলে গিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলে জার্মানি যে ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে হারাল, আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হলো, সেই জার্মান টিম ব্রাজিলের একটা দ্বীপ ভাড়া করে সেখানে বহুদিন একসঙ্গে থেকে অনুশীলন করেছিল। আমাদের ঘরেই আরও ভালো উদাহরণ আছে। ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। আমরা কি ভেবেছিলাম ভারতের মতো দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা? কিন্তু তাই হয়েছে। বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে আকবর আলীর নেতৃত্বে অসংখ্য প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ দল। একসঙ্গে খেলেছে দীর্ঘদিন। খেলার ধরন, শরীরী ভাষাতেও ছিল আক্রমণাত্মক ভাব, যা ফাইনালে চমকে দিয়েছিল ভারতকে। ভারতও তো ছেড়ে দেওয়ার মতো দল নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল বাংলাদেশ। হারার আগে হেরে যায়নি।

আমাদেরও এখন থেকেই বিশ্বাস করতে হবে যে আমরা ২০২৩ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হতে পারি। সে জন্য যা যা দরকার, সরকার-বিসিবি তা দেবে। কোচ নিয়োগ করে তাঁকে স্বাধীনতা আর সমর্থন দেবে। আর দেবে অনুপ্রেরণা। আমরা যারা সাধারণ দর্শক, আমাদেরও ইতিবাচক হতে হবে। আজকাল ভিডিও দেখে সব খেলোয়াড়ের দুর্বলতা-সবলতা আগে থেকে জেনেবুঝেই সব দল খেলতে নামে, হয়তো নতুন কাউকে নামানো কাজে দিতে পারে। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারেন, আমাদের ডানহাতি লেগ স্পিনার লাগবে কিনা!

সর্বশেষ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে আমরা বোধ হয় একটু বেশি আগে গিয়ে বেশি প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিন জাতি ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হলাম, সেই গতিতে প্রথম খেলায় ভালো করলাম, কিন্তু শেষের দিকে এসে আমাদের শারীরিক মানসিক বল কমই অবশিষ্ট ছিল, খেলোয়াড়দের ভারত ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচে ক্লান্ত-অবসন্ন দেখাচ্ছিল। যা হোক, ক্রিকেটীয় কৌশল কী হবে, এটা ঠিক করবেন বিশেষজ্ঞরা।

আমরা শুধু বলব, বড় স্বপ্ন রচনা করুন, ২০২৩ সালে আমরা বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হব। এটা যদি হয়, পুরো দেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে, এই সাফল্য অন্য অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য ছিনিয়ে আনার প্রেরণা হয়ে দেখা দেবে। আর যদি চ্যাম্পিয়ন না হই? তাতেও কোনো ক্ষতি নেই। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চেষ্টা করে চ্যাম্পিয়ন হতে না পারার মধ্যে কোনো অগৌরব নেই, কিন্তু আমরা চ্যাম্পিয়ন হতে আসিনি--এ রকম ভাবাটা শুধু অগৌরবের নয়, অপরাধ বলে গণ্য হওয়া উচিত।

মিরাকল ক্যান হ্যাপেন, হোয়েন ইউ বিলিভ। বিশ্বাস রাখতে হবে যে আমরা চ্যাম্পিয়ন হব। টিম বাংলাদেশের মধ্যে এই স্বপ্নের পরশমণি ছড়িয়ে দিন। বাংলাদেশ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হতে পারে যদি আমরা বিশ্বাস করি যে আমরা পারব। আর সে লক্ষ্যে সাধনা করব।
বিজয় আসছে...

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক।