'এখনই আমাদের জেগে ওঠার সময়'

.
.

সারাহ রোজ নামের মার্কিন এক নারী ওয়াশিংটনের হলোকাস্ট মিউজিয়াম দেখতে গিয়েছিলেন জানুয়ারির শেষে। সেখানে একটি পোস্টার তাঁর নজর কাড়ে। পোস্টারের শিরোনাম ‘আর্লি ওয়ার্নিং সাইন অব ফ্যাসিজম’। বাংলায়; ফ্যাসিজমের বিপদের আগাম সংকেতগুলো। সেখানে একে একে ১৪টি পরিবেশ ও পরিস্থিতির কথা বলা হয়েছে। কোনো দেশে ফ্যাসিবাদ চেপে বসার আগে এই পরিস্থিতিগুলো বিরাজ করে। রোজ পোস্টারটির ছবি দিয়ে টুইট করেছেন; ইন দ্য ইউএস হলোকাস্ট মিউজিয়াম; আই অ্যাম শক্ড।
সারাহ রোজ কেন ‘শক্ড’ হয়েছেন, তা বোঝার জন্য পোস্টারটিতে উল্লেখ করা ফ্যাসিবাদের ১৪ লক্ষণ বিবেচনায় নিতে হবে। ধারাবাহিকভাবে এগুলো হচ্ছে: ১. শক্তিশালী ও ধারাবাহিক জাতীয়তাবাদ ২. মানবাধিকারের প্রতি ঘৃণা ৩. নিজেদের একতার জন্য শত্রু চিহ্নিত করা ৪. সামরিক বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব ৫. লিঙ্গবৈষম্য বৃদ্ধি ৬. নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ৭. জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে ঘোরগ্রস্ততা ৮. সরকার ও ধর্ম মিলেমিশে যাওয়া ৯. করপোরেট শক্তির জন্য নিশ্চিত সুরক্ষা ১০. শ্রমজীবী শক্তির প্রতি দমনমূলক অবস্থান ১১. বুদ্ধিজীবী ও শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অবজ্ঞা ১২. অপরাধ ও শাস্তি নিয়ে আচ্ছন্নতা ১৩. অবাধ দলবাজি ও দুর্নীতি এবং ১৪. প্রতারণামূলক নির্বাচন।
সারাহ রোজের পোস্ট করা এই টুইট খুব দ্রুতই ভাইরাল হয়েছে। লাখ লাখ লোক তা শেয়ার করেছেন। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, পোস্টটি যে-সংখ্যক শেয়ার হয়েছে, তা ট্রাম্প ও হিলারির অনেক টুইটের চেয়েও বেশি। বোঝা যায়, সারাহ রোজ যে কারণে ‘শক্ড’ হয়েছেন, তা আরও অনেককেই স্পর্শ করেছে, ট্রাম্প যুগের লক্ষণগুলোর সঙ্গে তাঁরা এই লক্ষণগুলোর মিল খুঁজে পাচ্ছেন। ফ্যাসিবাদের আগাম লক্ষণগুলোর সঙ্গে যখন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতি মিলে যায়, তখন শুধু সে দেশের নাগরিকেরা কেন, সমগ্র দুনিয়ার মানুষেরই ‘শক্ড’ হওয়ার কথা।
এই ১৪ লক্ষণের মধ্যে মাত্র দুটি (নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ও প্রতারণামূলক নির্বাচন) এখনো যুক্তরাষ্ট্রে দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। সেটাই সম্ভবত একমাত্র ভরসা। সারাহ রোজের টুইটে একজন লিখেছেন, ‘তাঁর (ট্রাম্পের) আর মাত্র দুটি জিনিস করা বাকি আছে। এখনই আমাদের জেগে ওঠার সময়।’ এরপর তিনটি হ্যাশট্যাগ দিয়ে লিখেছেন, রেজিস্ট, অপোজ ও ইমপিচ দিস মনস্টার। ফ্যাসিবাদের যে দুটি পূর্বলক্ষণ এখনো যুক্তরাষ্ট্রে দেখা দেয়নি, সেটাই আসলে সবচেয়ে বড় ভরসা। সম্ভাব্য কোনো ফ্যাসিবাদ ঠেকানোর জন্য এই দুটিই আসলে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। গণমাধ্যম বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর কোপ পড়েনি বলে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ টুইটে প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ করে লিখতে পারেন, ‘ইমপিচ দিস মনস্টার’। ‘ফ্যাসিবাদ’ যাতে কায়েম না হতে পারে, সে জন্য সংগঠিত হওয়ার সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের এখনো রয়ে গেছে। এর বিরুদ্ধে জনমত কার্যকরভাবে সংগঠিত হলে নিশ্চিতভাবেই সম্ভাব্য বিপদকে ঠেকানো যাবে। আর নির্বাচনী ব্যবস্থা নষ্ট না হওয়ায় সেখানকার জনগণ পরের নির্বাচনে এর জবাব দেওয়ার সুযোগও নিশ্চয়ই পাবেন।
কিন্তু দুনিয়ায় এখন এমন অসংখ্য দেশ পাওয়া যাবে, যেখানে এই ১৪ লক্ষণই মিলে যাবে। যেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত আর নির্বাচনী ব্যবস্থাও প্রতারণামূলক। এসব দেশের ভবিষ্যৎ কী? ফ্যাসিবাদের লক্ষণগুলো বিবেচনায় নিয়ে এর বিপদ রুখতে যেখানে জনগণের সংগঠিত হওয়ার আপাত কোনো সুযোগ নেই বা ভোটের মাধ্যমে জবাব দেওয়ারও আশা-ভরসা নেই, সেসব দেশ কি তবে ফ্যাসিবাদ জেঁকে বসার ঝুঁকির মুখে?
দেশে দেশে জাতীয়তাবাদ ও লোকরঞ্জনবাদের উত্থানের মধ্য দিয়ে আসলে ফ্যাসিবাদের পূর্বলক্ষণগুলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। বিশ্বের অনেক দেশেই লোকরঞ্জনবাদী শাসন কায়েম হয়েছে এবং হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। এটাকে এখন আর কোনো দেশের একক সমস্যা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। ওয়াশিংটন ডিসির ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনে সম্প্রতি দেওয়া এক ভাষণে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেছেন, জাতিরাষ্ট্র ও এর পক্ষে দাবি তোলার মাধ্যমে মূলত সমগ্র পৃথিবীতে সীমান্তগুলোর বিচ্ছিন্নতা ও বিভাজনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া ও একটি প্যান-ন্যাশনাল আন্দোলন সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। তিনি বলেছেন, ‘ব্যাপারটা এমন যে আমরা যেন সবাই একসঙ্গে পরিচয়সংকটে পড়েছি। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে যে পরিবর্তন ঘটে চলেছে, তার অনিবার্য পরিণতি হিসেবেই এমনটি হচ্ছে।’ ফলে বিশ্ববাসীকে এখন এটা ঠিক করতে হবে যে তারা কি আসলে একসঙ্গে থাকতে চায় নাকি দেশে দেশে বিচ্ছিন্নতা ও বিভাজনকেই বাস্তবতা হিসেবে মেনে নেবে?
ফ্যাসিবাদের আগাম লক্ষণগুলো যদি সত্যিই ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার ইঙ্গিত দেয়, তার অর্থ দাঁড়ায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু ইতিহাসের কি হুবহু পুনরাবৃত্তি সম্ভব? এ নিয়ে কার্ল মার্ক্সের বহুল আলোচিত মন্তব্যটি আমরা স্মরণ করতে পারি; ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়, প্রথমে যা ট্র্যাজেডি, পরে তা আসে পরিহাস হিসেবে। ফলে আমরা সামনে যার মধ্যে ঢুকে যাওয়ার ভয় করছি, কার্ল মার্ক্সের মন্তব্যকে বিবেচনায় নিলে সেটা আসলে পুরোনো ফ্যাসিবাদ নয়, এর বিকৃতি বা পরিহাস। আমরা আসলে এক বিকৃত ফ্যাসিবাদের ঝুঁকির মুখে আছি।
নিজের দেশ আমেরিকায় ফ্যাসিবাদের পূর্বলক্ষণগুলো দেখে সারাহ রোজ ‘শক্ড’ হয়েছেন। লাখ লাখ মার্কিন তাঁর সঙ্গে শামিল হয়েছেন। আওয়াজ তুলেছেন, ‘এখনই আমাদের জেগে ওঠার সময়।’ বিশ্বের সীমান্তগুলোর বিচ্ছিন্নতা ও বিভাজনকে যতই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা হোক না কেন, কোনো দেশের মানুষের ‘জেগে ওঠার’ বিষয়টিকে বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার আর সুযোগ নেই। বিশ্ববাসীর সামনে এটাই এখন আশার জায়গা। কোনো আওয়াজ দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে এখন আর সময় লাগে না। আমরা দেখছি, লোকরঞ্জনবাদের এই জোয়ারের মধ্যে এর বিপদটা নিয়েও দেশে দেশে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে, আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। এই জোয়ার হয়তো এখনই থামবে না, কিন্তু বিশ্বজুড়ে সচেতনমহলে এ নিয়ে যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে, তা এই জোয়ারে ভাটা আনতে নিশ্চয় সহযোগিতা করবে। জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, যদি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এবং সব সময় অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে থাকে, তবে বুঝতে হবে যে অভিজ্ঞতা থেকে শেখার ক্ষেত্রে মানুষ কতটা অসমর্থ। অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্ববাসী কতটা শিখেছে, সেটা বোঝার জন্য আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
[email protected]