'এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে'

রোববার দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনা খবরে দেখে খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম। ভাবতাম, এই বয়সী ছেলেমেয়েরা এখনো বাবা-মায়ের আঙুল ছাড়া আর কিছুই চেনে না। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! বাস্তবজ্ঞানশূন্য একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, যাদের অভিজ্ঞতা বলে কোনো জিনিস থাকবে না। একলা পথচলার মতো যোগ্যতা থাকবে না, নিজেদের চেনা কোনো পথ, কোনো গন্তব্য থাকবে না। অথচ তখনো কি ভেবেছিলাম মেঘ উঠবে? বৃষ্টি নামবে? তখনো কি ভেবেছিলাম মায়ের হাতের আঙুল অগ্রাহ্য করে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড তুলে নেবে? যে হাতের মুঠোই শক্ত হয়নি, সে হাত প্রতিবাদে মুঠো করতে পারে কখনো ভাবিইনি। রক্ত ঝরছে, নামছে কাঁদানে গ্যাসের শেল, জলকামান। কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে পথে নামতেই হবে। কী দৃঢ় সে অঙ্গীকার, কী দৃঢ় সেই কণ্ঠস্বর। আহা, সবেই তো গলার স্বর ভারী হলো এদের। এই তো মুখে দাড়ি-গোঁফের চিহ্ন। এই তো সবে তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচাতে শিখেছে মেয়েটা। ভ্রম হয়, ঠিক দেখছি তো? এরাই তো তারা, যারা চুলগুলো ওপরের দিকে সটান করে জেল মাখে, ফাস্ট ফুডের দোকানে গিয়ে মুখ বাঁকিয়ে সেলফি তোলে, বাংলা-ইংরেজি মিশেল করে কথা বলে, সারা দিন কোচিং সেন্টার ও আর্টের ক্লাসে বসে থাকে!
ভুল হওয়ার তো কোনো কারণ নেই। এই যে ছাইরঙা মেঘের মতো ইউনিফর্ম, এই যে সমুদ্রসফেন ক্রস-বেল্ট, এই যে জেল দেওয়া চুল, এই যে বিনুনি গাঁথা চুল। চোখে জল আসে। সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) ‘বাংলাদেশ হেলথ ইনজুরি সার্ভে-২০১৬ (বিএইচআইএস)’ শিরোনামের এক জরিপে উঠে এসেছে, প্রতিবছর বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ১৬৬ জন নিহত হয়৷ আর তাতে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয় ৬৪ জন৷ শুধু সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ৬৪ জন নিহত হয়। আমরা গুনি এক দুই তিন, সংখ্যা। কাউকে চিনি না, কারও খোঁজ নিই না। তারা প্রত্যেকেই কারও না কারও স্বজন। কিন্তু আমরা তাদের কেউ নই। নিজের পরিবারের, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউ না ঝরলে আমরা কোনো দুর্ঘটনায় বিচলিত হই না। আমাদের কোনো দরকার পড়ে না আসলে।
এই যে প্রতিদিন এত এত দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তারপর হাসপাতাল, তারপর মর্গ, তারপর বড়জোর থানা-পুলিশ। একটা রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিদিন এত এত মানুষের রক্তের ওপর পিচ ঢেলে ভাঙা রাস্তা শক্ত করে যাচ্ছে। তার নতুন নতুন রুট পারমিট দিচ্ছে, গাড়ি নামছে, নতুন নতুন দুর্ঘটনা ঘটছে। কেউ সে রক্ত ছুঁয়ে, দেখে বুক টান টান করে রাস্তাটার ওপর এসে দাঁড়াচ্ছে না কেবল। বলছে না, রক্ত না শুকানো পর্যন্ত আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব।
সবাই যে যার মতো ঘরে ফিরে গেছে, দুবেলা কেঁদে, দুদিন দুঃস্বপ্ন দেখে ভুলে গেছে কী যেন হয়েছিল? কে যেন ছিল? কার যেন থাকার কথা ছিল! কিন্তু এই ছোট ছোট কিশোর-কিশোরী ঠিকই জেনেছে, কোথায় তাদের দাঁড়াতে হবে? কোথায় গিয়ে বাধা দিতে হবে। ইউনিফর্ম পরা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা জোয়ারের মতো সকাল হলে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়, সূর্যের তাপে ফুলেফেঁপে ওঠে। রক্ত তেতে ওঠে, স্লোগানে স্লোগানে ভারী হয়ে ওঠে একটা পুরো শহর। গোটা শহরকে সুকান্তের কবিতার মতো মনে হয়।
‘তব আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে’
কদিন আগেও সুকান্তকে বোকা মনে হতো, ধুর, কী সব লিখে গেছে। এখন ওসবের কোনো অর্থই নেই। কিন্তু সব গতানুগতিক ধারণাকে লোপাট করে দিয়ে আঠারো কি আঠারোর বৃত্তে ঘুরতে থাকা তাজা তাজা প্রাণ জ্বলে উঠছে। প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কাঠফাটা রোদে পুড়ে খাঁটি হয়ে উঠছে ওরা।
পুলিশের উচ্চপদস্থরা যখন লাঠিপেটার ফরমান দিয়েছেন, জলকামান এনে রেখেছেন, ওরা তখন হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বড় স্যারের হুকুম তামিল করতে যখন স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ওপর তাঁরা চড়াও হচ্ছেন, ঠিক তখন প্রিন্সিপাল স্যারের পক্ষ থেকে আসা টিসির ভয় জড়ানো হুমকির মুখে লজেন্স ঢুকিয়ে মার খাচ্ছে, প্রিজন ভ্যানে উঠে বসছে। দেখছি আর ভাবছি, কার মেরুদণ্ড বেশি শক্ত? এই শিক্ষার্থীদের বয়সী সন্তান ঘরে রেখে এসে যারা অন্যের সন্তানের ওপর চড়াও হয়, তারা নাকি অচেনা সহপাঠীদের জীবনকে মূল্যবান মনে করে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে জোয়ারের মতো গর্জন করতে থাকা শিশু-কিশোরদের?
প্রশাসন নিজেই বলছেন, এই কোমলমতিরা কিছু না বুঝে রাস্তায় নেমেছে। তো শিক্ষার্থীরা কিছু না বুঝেই যদি এসব করে থাকে, তাহলে কি ধরে নেওয়া যায়, তাদের এই ‘কিছু না বুঝে’র ওপর প্রশাসন বুঝেশুনেই আক্রমণ চালাচ্ছে!
বাবা-মায়েদের পিঠ চাপড়ে দেওয়াটাও একেবারেই অমূলক হবে না বোধ হয়। যে সন্তানকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল হতে দেননি, হঠাৎ একদিন সকালে সে সন্তানকে অনিশ্চিতের মুখে ছেড়ে দেওয়াটাও চাট্টিখানি কথা নয়। এ প্লাস পাওয়ার চেয়েও এই সন্তানদের নিয়ে অপরাপর গর্বের জায়গাটা আরও বেশি প্রশস্ত হলো। ‘মায়ের নির্দেশ, খালি হাতে আমি যেন বাড়ি না ফিরি’ স্লোগান শিমুল তুলোর মতো ভয়ের দিনগুলোতে উড়িয়ে নেয়। বড়দের মুখে মুখে শোনা গল্পগুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে, রাস্তায় নামলেই চোখের সামনে সব দৃশ্য চোখে পড়ে যায়।
যে চেতনা বেচে এখন মানুষ ব্যবসা করে, কথায় কথায় যারা জামায়াত-শিবির তকমা বিলি-বণ্টনে ব্যস্ত সময় কাটান, তাঁরা এসবের কীই-বা বোঝেন! ব্যবসা করা আর ধারণ করা, লালন করার মধ্যে বিস্তর ফারাক। বাঙালির ইতিহাস বলে, বাঙালি কখনো মাথা নোয়ায় না। ৫২-র আগে, ৭১-এর আগে বিস্তীর্ণ পটভূমি আছে। পড়ে পড়ে মার খেতে খেতে একদিন সবাই মেরুদণ্ড সোজা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। এই শিক্ষার্থীরা সেই ঘটনা মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয়, ১৪৪ ধারা জারি উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে আসা। যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখছি। চাটুকারদের কখনো ইতিহাস মনে রাখে না, স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া সামান্যদের কেউ ইতিহাসের পাতায় জায়গা দেয় না। ৫০০ বছরের ইতিহাস ৫০ পাতায় লেখা হয় কি না! তাই এখানে টিকতে হলে তেলাপোকার মতো শুধু পড়ে থাকলেই চলে না, ডাইনোসরের মতো প্রকাণ্ড হয়ে ধ্বংস হয়ে যেতে হয়।
যাঁরা মরে গেছেন—কেউ সংসারের বোঝার তলে পিষ্ট হয়ে, কেউ কর্মক্ষেত্রে দুই টাকা কেজিতে মাথা বেচে দিয়ে, কেউ বড়কর্তার কাছে মেরুদণ্ডটার বদলে লবণ কিনে—তাঁদের নিয়ে কেউ কোনো দিন স্বপ্ন দেখেনি। স্বপ্ন দেখেছে তরুণ-কিশোরদের নিয়ে। ভাবতে ভালো লাগে, এই শিক্ষার্থীরা একদিন বড় হবে, দেশের ইঞ্জিনটা পাল্টে শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরবে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এই সময়টার কথা মনে করে সচেতন হবে, রাষ্ট্রযন্ত্রের মরিচায় তেল দিয়ে ঝকঝকে করে ফেলবে। চোখ খুলেই দেখতে পাচ্ছি, একঝাঁক পাখি উড়ে আসছে। শরতের নীল আকাশ থেকে রক্তবৃষ্টি শেষে স্বস্তি নামছে। আমার আবারও সুকান্ত মনে পড়ে—
‘এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়-
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।’
বীথি সপ্তর্ষি: লেখক ও সাংবাদিক
bithysoptorshi@gmail.com