কথাটা বেশ সাহস করে বলছিলেন পোশাককর্মী তাসলিমা। সেদিন প্রথম আলোর কার্যালয়ে গোলটেবিল বৈঠকে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি এসেছিলেন। পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পথে বাধাবিপত্তি ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল। তাসলিমার সমস্যা হলো তাঁদের সুপারভাইজার একজন পুরুষ। মাসিকের সময় হয়তো কখনো শরীর একটু খারাপ থাকে। ছুটি দরকার। কিন্তু একজন পুরুষ কর্মকর্তার কাছে মুখ ফুটে মাসিকের কথাটা আর বলা হয় না। তাই অসুস্থ শরীরেই তাঁকে কাজ করতে হয়।
বিশিষ্ট অতিথি ছিলেন সাংসদ শিরীন আখতার। তিনি বললেন, ‘নেপালে মাসিকের জন্য মাসে দুই দিন ছুটির ব্যবস্থা আছে।’ আমরা কি নেপালের চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছি? না, তা নয়। তবে এখানে একটা কথা আছে। সেটা বিজিএমইএর সভাপতি ও আলোচকদের মধ্যে কয়েকজন পরিষ্কার করে দিলেন। তাঁদের অনেকেই উন্নত মানের পোশাকশিল্পের মালিক।
প্রতিষ্ঠিত শিল্পমালিকেরা বললেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনার পর গত তিন বছরে পোশাকশিল্পে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের অনুসন্ধান ও সহযোগিতামূলক পদক্ষেপের ফলে এবং বিশেষভাবে মালিকদের আন্তরিক চেষ্টায় এখন ২ হাজার ২৩১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান কমপ্লায়েড। প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ করেই কারখানাগুলো কাজ করছে। সেখানে মাসিকের সমস্যা নেই। নারী শ্রমিকদের জন্য পরিষ্কার টয়লেট, সেখানে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা, সরকারি আইন অনুযায়ী চার মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা আছে। এমনকি কোনো কোনো কারখানায় নারী সুপারভাইজার আছেন। কোথাও আবার প্রোডাকশন লাইনে ‘স্বাস্থ্যসখী’ আছেন। তাঁদের কাছে নারী শ্রমিকেরা নিজেদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত যেকোনো সমস্যা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে পারেন। প্রতিকার ও চিকিৎসারও সুব্যবস্থা আছে।
এ কথাগুলো উৎসাহিত হওয়ার মতো। সত্য যে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তাহলে কি তাসলিমা ভুল বলেছেন? না, তাঁর কথাও ঠিক। কারণ, বিজিএমইএর সভাপতি জানিয়েছেন, দেড় হাজারের মতো মাঝারি ও ছোট কারখানা ইন্সপেকশন করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে হয়তো ৪০০ থেকে ৫০০ কারখানা শেষ পর্যন্ত টিকবে। বাকিগুলোতে কিছু সমস্যা থেকে যাবে। বিজিএমইএ এখন কমপ্লায়েন্সের ব্যাপারে কঠোর। কোনো ছাড় দেবে না। সবাইকে কমপ্লায়েড হতে হবে।
এই ছোট কারখানাগুলো হয়তো কিছু বড় প্রতিষ্ঠানের সাব-কন্ট্রাক্ট নিয়ে কাজ করে। সেখানেই এ ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে। তাই দেখতে হবে, সাব-কন্ট্রাক্ট দিলে সেখানে যেন নারী শ্রমিকদের যৌন ও প্রজনন সমস্যার দিকগুলো দেখা হয়। তাঁদের স্বাস্থ্যসেবা যেন নিশ্চিত করা হয়।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার একটা জরুরি বিষয় সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, শ্রম বিধিমালায় রাত ১০টার পর কোনো কারখানায় নারী শ্রমিকদের কাজ করা নিষেধ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে আমাদের পোশাক শিল্পকারখানাগুলো কতটা সচেতন? আইনটি ভালো। কিন্তু সবাইকে অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে। তিনি আরেকটি খবর দিয়েছেন। ২০১৯ সালে মজুরি কমিশন হবে। এতে পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন-ভাতা কিছু বাড়বে আশা করা যায়। সেই সঙ্গে বাড়বে নারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ-সুবিধা।
বাংলাদেশে পোশাকশিল্প এখন অর্থনীতির প্রধান খাত। মোট বৈদেশিক মুদ্রার ৮২ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। আশা করা হচ্ছে, ২০২১ সালে এই খাত ৬ হাজার কোটি ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করবে। এই সম্ভাবনাময় খাতটি স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। আরেকটি বিষয় হলো, এই খাতে কাজ করছেন প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক। তাঁদের ৮০ শতাংশই নারী। সব মিলিয়ে দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ এই খাতের সঙ্গে জড়িত। তাঁদের ভালো-মন্দের ওপর দেশের অর্থনীতির অনেক কিছু নির্ভর করে।
এই শ্রমিকদের জন্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা দরকার। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ভালো থাকলে শেষ পর্যন্ত মালিকদেরই লাভ। শরীর ঠিক না থাকলে কাজের মান ও গতি কমে যায়। শেষ পর্যন্ত উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনো কোনো কারখানায় পরীক্ষামূলকভাবে বেসরকারি বিমা প্রতিষ্ঠান পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। কিন্তু সেখানে শ্রমিকদের বছরে কয়েক শ টাকা প্রিমিয়াম দিতে হয়। এই প্রিমিয়ামের টাকাটা যদি কারখানার পক্ষ থেকে দেওয়া হয়, তাহলে শ্রমিকেরা উপকৃত হবেন। না হলে এ ধরনের স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্প সফল হবে না।
আমাদের গোলটেবিল বৈঠকে সহযোগিতায় ছিল এনএসভি নেদারল্যান্ডস ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন। তারা নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সহযোগিতায় বিভিন্ন পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। তাদের কাজে ওই সব কারখানার পরিবেশ অনেক উন্নত হয়েছে। বিশেষভাবে নারী শ্রমিকদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতির উন্নতি চোখে পড়ার মতো। কারখানার মালিকপক্ষ ও সরকারও তাদের উদ্যোগের সঙ্গে আছে। শ্রমিকেরাও খুশি। তিন পক্ষের মিলিত উদ্যোগের ফলে এটা সম্ভব হয়েছে।
এখন সমস্যা হলো, এনজিও সংগঠনগুলো তো চিরকাল প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে না। বিশেষভাবে আগামী কয়েক বছর পর বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে, তখন তো আর বিদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় তহবিল পাবে না। তখনো যেন কাজগুলো চলতে থাকে, সেটা দেখা দরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে যে উন্নতি হচ্ছে, তার ধারা অব্যাহত রাখা, উন্নয়ন টেকসই করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
এই বিষয়টি গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় এসেছে। আমাদের এমনভাবে কাজ করতে হবে যেন আমরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে না পড়ি। কাজটা আমাদের। আমাদেরই করতে হবে। নারী শ্রমিকদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পথে বাধাগুলো দূর করা এবং নারীর কাজের সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমাদের মালিক, সরকার ও শ্রমিকদের যৌথভাবে দায়িত্ব নিতে হবে।
শ্রমিকদেরও দায়িত্ব আছে। তাঁদের সচেতন হতে হবে। একজন নারী শ্রমিক কাজের মধ্য দিয়ে দক্ষতা অর্জন করে সুপারভাইজার পদে যেতে পারেন। সেই চেষ্টা করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, নিজেদের টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য নিজেদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষের উদ্যোগও দরকার।
আমরা যখন বিদেশে যাই, দোকানে যখন একটি শার্ট বা প্যান্টে দেখি ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’, তখন মন ভরে ওঠে। যাঁদের শ্রম ও ঘামে বিদেশে আমাদের পোশাকশিল্পের এত কদর, সেই শ্রমিকদের, বিশেষভাবে নারী শ্রমিকদের প্রতি আমাদের আরও একটু বেশি মনোযোগ দরকার। এটা শুধু মালিকপক্ষেরই না, সরকারেরও দায়িত্ব। কারখানার শ্রমিক যদি ‘লজ্জায় মাসিকের কথা’ বলতে না পারেন, তাহলে অসুস্থ শ্রমিক কি ভালো কাজ দিতে পারবেন?
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।