
বাংলাদেশের লোকজন বরাবরই রাজনীতি-সচেতন। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এর স্বীকৃতি মিলেছে। বছর তিনেক আগে আমেরিকান গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপে রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশিরা জায়গা করে নিয়েছিল। বিশ্বের ৩৩টি উন্নয়নশীল ও উদীয়মান দেশের ওপর এই জরিপ চালানো হয়েছিল। সেই জরিপ বলছে, বাংলাদেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ উচ্চমাত্রায় ও ২৯ শতাংশ মানুষ মধ্যম মাত্রায় রাজনীতিতে সক্রিয়। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, সব মিলিয়ে নব্বই ভাগের বেশি মানুষ কোনো না কোনো মাত্রায় রাজনীতিতে সক্রিয়! পুরোনো এই প্রসঙ্গ টেনে আনার কারণ বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকান রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকার। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মতো এমন রাজনীতিতে আচ্ছন্ন দেশ আমি আর দেখিনি।’ (লাইভ মিন্ট, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬)
এই যে বাংলাদেশের মানুষ এই মাত্রায় রাজনীতিতে সক্রিয়, এটা দেশটির জন্য ভালো না খারাপ? রাজনীতিতে জনগণের সক্রিয়তার সঙ্গে রাজনীতি-সচেতনতার সম্পর্ক রয়েছে। রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখলে এটা অবশ্যই ইতিবাচক। জনগণ রাজনীতি-সচেতন হলে সাধারণভাবে কোনো দেশে অপশাসন বা দুঃশাসন সুবিধা করতে পারার কথা নয়। বাংলাদেশে অতীতে আমরা তা দেখেছিও। রাজনীতিতে সক্রিয় ও সচেতন জনগণ দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নব্বইয়ে সামরিক স্বৈরাচার ও সেনাশাসনকে বিদায় করেছে। এরপর গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের সহিংসতার মধ্যে বছর দুয়েকের জন্য এই যাত্রা ব্যাহত হলেও ২০০৮ সালে আবার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পথে নতুন যাত্রা শুরু হয়। এরপর তা আবার হোঁচট খায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের সহযোগী দলগুলোর নির্বাচন বর্জন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন এই নির্বাচন দেশের রাজনীতির দৃশ্যপট পাল্টে দেয়।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে অতিমাত্রায় সক্রিয় বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ে একটি ভুল হিসাব কষেছিল নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি ও জামায়াত জোট। নির্বাচনের এক বছরের মাথায় আন্দোলনের নামে তারা এক চরম হঠকারী কর্মসূচি গ্রহণ করে। তাদের এই আন্দোলনের সময় মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা সরকারকে কঠোর হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। সেই ধারাবাহিকতা এখনো বজায় রয়েছে। আর সেই হঠকারিতা ও ভুল রাজনীতির খেসারত বিএনপি এখনো দিয়ে চলেছে। বলা যায়, দেশের রাজনীতিকেও দিতে হচ্ছে।
আমরা দেখছি, সবকিছু মিলিয়ে বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে যে বাস্তবতা বিরাজ করছে তাতে রাজনীতিতে ‘অতিমাত্রায় সক্রিয়’ জনগণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের রাস্তাগুলো বন্ধ হয়ে আসছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের তিন বছর আগের সেই জরিপের ফল অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪৮ শতাংশ মানুষ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেয়, ৩৭ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন ধরনের বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নেয়, ৩২ শতাংশ মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় সদস্য, ৩১ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন ধর্মঘটে অংশ নেয়। কোনো জরিপের ফলই শতভাগ নির্ভুল হয় না, পিউ রিসার্চ সেন্টারের এই জরিপও নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের রাজনীতি-সচেতনতা ও সক্রিয়তা নিয়ে তো কারও সন্দেহ থাকার কথা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, যে দেশের মানুষ এই হারে রাজনীতি-সচেতন ও রাজনীতিতে সক্রিয়, তারা এখন কীভাবে সময় পার করছে? তারা কি সবাই রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়েছে? তিন বছরেই পরিস্থিতি এত পাল্টে গেল!
লেখাটির শুরুতে বার্নিকাটের যে সাক্ষাৎকার থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছি, সেটি ছাপা হয়েছে ভারতের বিজনেস দৈনিক লাইভ মিন্ট-এ। বাংলাদেশের রাজনীতি ও জঙ্গিবাদের বিপদ নিয়েই কথা হয়েছে সাক্ষাৎকারে। সেখানে বার্নিকাট বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেশটির রাজনীতিতে উৎসাহী ও সক্রিয় জনগোষ্ঠীর ভূমিকা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে, সে আশঙ্কা তুলে ধরেছেন। বলেছেন, আইএস ও আল-কায়েদার কাছে প্রাধান্য পাওয়া একটি দেশ এখন বাংলাদেশ।
‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কীভাবে উগ্রবাদকে প্রভাবিত করছে?’—এমন এক প্রশ্নের জবাবে বার্নিকাট যা বলেছেন, তা অনেকটা এ রকম: আইএসের নিজেদের প্রকাশনাগুলো যদি দেখেন, তবে খেয়াল করবেন যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভক্তির পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার ধারণা রয়েছে। নিজেদের মধ্যে এসব বিচার-বিশ্লেষণের পর তারা বুঝতে পেরেছে যে বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক বিভক্তি সেখানকার জনগণকে র্যাডিকালাইজড করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই সেখানকার জনগণ র্যাডিকালাইজড হচ্ছে বা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ভোট দিতে না পারার কারণে জনগণ সন্ত্রাসী হচ্ছে, বিষয়টি তা নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে জনগণ র্যাডিকালাইজড হচ্ছে না, তবে এটা একটা ভূমিকা পালন করছে। বার্নিকাট মনে করেন, যারা রাজনৈতিক সহিংসতায় যুক্ত হচ্ছে, তারা আসলে ভাড়া করা অস্ত্রের মতো। তারা হয়তো গত সপ্তাহে কোনো রাজনীতিকের পক্ষে কাজ করেছে, আবার আইএস যদি পয়সা দেয়, তবে এই সপ্তাহে তারা আইএসের হয়ে কাজ করবে।
আইএস কীভাবে বাংলাদেশে কাজ করার চেষ্টা করছে, তা ব্যাখ্যা করেছেন বার্নিকাট। বলেছেন, যারা র্যাডিকালাইজড হয়েছে, তাদের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখবেন যে তারা ক্ষতিগ্রস্ত কেউ নয়। আইএসের রিক্রুটিং পলিসি অনেক নমনীয় আল-কায়েদার তুলনায়। তারা সমাজের মধ্যে ঢুকছে আক্ষরিক অর্থেই কম্পিউটারের মাধ্যমে। তারা এমন লোকজন খোঁজে, যারা সামাজিকভাবে কিছুটা বিচ্ছিন্ন। এ ধরনের লোকজনকে টার্গেট করে ধীরে ধীরে তাদের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটায়। সেই সূত্র ধরে বার্নিকাটের ধারণা, বাংলাদেশে যারা রাজনৈতিক সহিংসতায় অংশ নেয় বা এখন যারা মনে করছে যে তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে পুরো বিচ্ছিন্ন, তারা অনলাইনে জঙ্গিদের নানা আহ্বান শুনতে ও এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।
জঙ্গিবাদের হুমকিতে বিশ্বের অনেক দেশই রয়েছে এবং এর শিকারও হচ্ছে নানা দেশ। বাংলাদেশের জন্য কেন বিষয়টি বেশি বিপদের, তার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন বার্নিকাট। তাঁর মতে, বাংলাদেশ নিয়ে বাড়তি উদ্বেগের তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশ ও এর সব অংশীদারের জন্য যেটা সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় তা হচ্ছে, আল-কায়েদা ও আইএস—দুটোই বাংলাদেশকে তাদের প্রাধান্যের তালিকায় রেখেছে। ফলে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে তারা এখানে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করবে।
দ্বিতীয়ত, এই সংগঠন দুটি পরস্পরের শত্রু হলেও বাংলাদেশে তারা একসঙ্গে কাজ করে। তামিম চৌধুরীর মতো লোক দুই পক্ষের জন্যই কাজ করেছে। এটা খুবই বিপজ্জনক, কারণ এ ক্ষেত্রে তারা তাদের পরস্পরের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগাতে পারবে।
তৃতীয়ত, তরুণদের নিখোঁজ হওয়া এখনো অব্যাহত এবং যারা নিখোঁজ হয়েছে, তারা কোথায় গেছে তা জানা যাচ্ছে না। এর অর্থ, রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়া সাফল্যের সঙ্গেই চলছে।
লাইভ মিন্ট একটি বিজনেস পত্রিকা। বার্নিকাটের কাছে তারা এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সম্ভাব্য বিনিয়োগের বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক সহিংসতাই হোক বা জঙ্গি তৎপরতাই হোক, আমেরিকান ব্যবসায়ীরা স্থিতিশীলতা চান। তাঁরা যদি দেখতে পান যে সরকার এ ব্যাপারে কঠোর, স্বচ্ছ ও কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না, তাহলে তাঁরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার ভাববেন। ফলে সন্ত্রাস দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদক্ষেপের পাশাপাশি রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনাও জরুরি।
এটা আমরা সবাই দেখেছি যে হলি আর্টিজান ঘটনার পর সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিদের খুঁজে বের করতে যথেষ্ট তৎপর। তাদের বিরুদ্ধে অনেক সফল অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। এখনো বিভিন্ন স্থান থেকে সন্দেহভাজন জঙ্গি আটক, অস্ত্র উদ্ধার—এসব ঘটছে। কিন্তু এই বিপদ থেকে আমরা মুক্ত হয়েছি—এটা কি বলা যাবে? বাংলাদেশ বা বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বা আইএস ও জঙ্গি দমন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও কৌশল নিয়ে অনেকের মনে নানা সন্দেহ-অবিশ্বাস রয়েছে। এবং তার অনেক যৌক্তিক কারণও নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু আমেরিকান রাষ্ট্রদূত তাঁর সাক্ষাৎকারে যে দিকগুলো নিয়ে কথা বলেছেন বা যে উদ্বেগগুলো তুলে ধরেছেন, সেগুলোকে কি আমরা একেবারেই নাকচ করে দিতে পারি?
রাজনীতি নিয়ে যে দেশের লোকজনের এত উৎসাহ ও সক্রিয় অংশগ্রহণ, সে দেশের মানুষ যদি স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হয়, সেই পরিস্থিতি কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারে না। এর কোনো না কোনো প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য। সব ধরনের বিচ্ছিন্নতাই বিপজ্জনক, সামাজিক বা রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা। আর এখন তো রাজনীতির দেশ-বিদেশের ফারাকও কমে গেছে। আফগানিস্তান বা ইরাকে মার্কিন হামলা আমাদের জনগণকে ক্ষুব্ধ করে। ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন আমাদের ব্যথিত করে, সিরিয়ার জনগণের দুর্দশায় আমাদের প্রতিক্রিয়া হয়। মার্কিন নির্বাচনে কে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন বা হচ্ছেন না, তা নিয়েও আমাদের উদ্বেগের শেষ নেই। এখন রোহিঙ্গাদের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চলছে, তার তো সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের ওপর। দেশের রাজনীতির বর্তমান ধারা বজায় থাকলে বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হলে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির এসব পরিস্থিতি বজায় থাকলে (যার ওপর আমাদের হাত নেই) আইএস বা আল-কায়েদার সদস্য রিক্রুটের কাজটি যে সহজ হয়ে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বালুতে মুখ গুঁজে রেখে এই বিপদ সামাল দেওয়া যাবে না।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com