'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই'

‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। বাংলার মধ্যযুগের এক কবি বড়ু চণ্ডীদাস উচ্চারণ করেছিলেন মানব-ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক বাণী।

সমগ্র বিশ্ব যখন হিংসায় উন্মত্ত, রক্ত ঝরছে যখন পৃথিবীর নরম শরীর থেকে, তখন এই বাংলার এক কবি বিশ্বকে শুনিয়ে ছিলেন মানবতার অমর কবিতা।

আমরা তাঁরই উত্তরাধিকার। আমরা উত্তরাধিকার ‘চর্যাপদ’ থেকে ‘গীতাঞ্জলি’।

পদ্মা, গঙ্গা, বঙ্গোপসাগরের কূলে কূলে সহস্র বছর ধরে যে মানুষের বসবাস, তাদের সংগ্রামী জীবনের উত্তরাধিকার আমরা। সে জীবন অবিভাজ্য মানুষের। সে জীবন শ্রম ও আনন্দের। শান্তি ও সমন্বয়ের। প্রকৃতি ও পুরানের সংশ্লেষে গঠিত।

সেই জীবনের সংস্কৃতি সততই প্রেমের জয়গান গায়। জীবনের জয়গান গায়। যুগে যুগে মানবের কল্যাণ কামনায় গীত হয় সাম্যের গান। জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সংস্কৃতি হয়ে ওঠে মানুষের জীবন ও জাতিসত্তা নির্মাণের প্রধানতম নিয়ামক। সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা বিলুপ্ত হয় মানবজীবন থেকে উৎসারিত ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কাছে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ধর্মীয় বিভাজন অনুমোদন করে না। আর তাই এই অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ অনেক মানবিক ও শান্তি মুখাপেক্ষী।

দেশজ সংস্কৃতি ও ভাষার অসাম্প্রদায়িক চেতনার শক্তিতে জাতিসত্তার বিকাশ ঘটে। এই বিকাশের ধারায় রয়েছে বিশাল বাংলার বিচিত্র বৃক্ষরাজি, বনভূমি, ষড়্ঋতুর মোহনীয় আকাশ, শত নদীর সহস্র জলজ প্রাণী ও শ্রমজীবী কৃষকের জীবনাচার, আখ্যান-উপাখ্যান। রয়েছে উয়ারি-বটেশ্বর, পুণ্ড্র, পাহাড়পুর। রয়েছে কান্তজির মন্দির ও ষাট গম্বুজের অপরূপ শৈলী। ইতিহাস-ঐতিহ্য ও প্রকৃতিসংলগ্ন মানুষের ভাষা এবং সংস্কৃতিভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ তাই স্বাভাবিকভাবেই সর্বপ্রাণবাদী। জগৎ ও জীবনচক্রের প্রাকৃতিক যে আবর্তন, তারই সংশ্লেষণে যে মানবসভ্যতা, সেই সভ্যতাই তো গুহামানবকে পৌঁছে দিয়েছে মুক্ত মানুষের নবতর জীবনান্বেষণে। এই অন্বেষণের ধারায় নতুন সংযুক্তি বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ইতিহাস এই সাক্ষ্য দেয় যে বাঙালির নিজস্ব ভূখণ্ড ছিল, কিন্তু স্বশাসিত দেশ ছিল না। রাষ্ট্র তো ছিলই না। প্রথম স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের অভ্যুদয় ঘটেছিল খ্রিষ্টীয় ৫২৫ সালে। এক বাঙালি রাজা গোপ চন্দ্র যা প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন। সেই প্রথম এক বাঙালি রাজা যিনি বাঙালিদের রাজ্য পত্তন করেন। ৭৫ বছর স্থায়ী হয়েছিল গোপ চন্দ্রের বংশের শাসন। ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ অবধি। তারপর উত্থান ঘটে রাজা শশাঙ্কের। কিন্তু তাঁরা কেউ বাঙালি ছিলেন না। সেন বা পালরা ও নন। কিন্তু রাজা গোপ চন্দ্রের প্রথম স্বাধীন বঙ্গরাজ্য তো সাম্রাজ্য ছিল। প্রজাতন্ত্র ছিল না। বাঙালি প্রথম প্রজাতন্ত্রের সাক্ষাৎ পায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। হাজার বছরের স্বপ্ন বাঙালির নিজস্ব স্বাধীন রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে। কিন্তু সে তো সাম্প্রতিক সময়ের কথা। তারও আগে শত শত বছর ধরে ঘটেছে নানা ঘটনা, যা জাতিসত্তা বিনির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়াশীল উপাদান।

মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিমের তীব্র তীক্ষ্ণ কবিতা, ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি’ আমাদের এ কথা জানান দেয় যে এক কঠিন সংগ্রামের ভেতর দিতেই আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। ১৯০৫-এর বাংলা ভাগের ব্রিটিশ ষড়যন্ত্র ও বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের সংস্কৃতিতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপিত হয়। স্বয়ং কবিগুরুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। কবিগুরু রচনা করেন বাঙালি জাতিসত্তার প্রধানতম সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’সহ অমর সব সংগীত। সেই শিক্ষায় সব বৈরিতার মধ্যেও এ জাতি তার অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বহাল রেখেছে। যদিও ব্রিটিশ শাসকদের কূটচাল সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে জাতিকে বিভক্ত করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ছিন্নভিন্ন ভারত বাংলাদেশের মানুষ ক্ষণিককাল বিভ্রমে এক ঐতিহাসিক ভুল সিদ্ধান্তে নেয়। ১৯৪৭-এ সৃষ্টি হয় এক অসার রাষ্ট্র পাকিস্তানের। কিন্তু বাঙালি তার বিভ্রম থেকে বেরিয়ে এসে পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র সাত মাসের মাথায় ১৯৪৮ সালে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সূচনা করে। ১৯৫২-এর রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে জাতিসত্তা বিনির্মাণের নবপ্রয়াস শুরু হয়, সেই জাতিসত্তা হাজার বছরের বাঙালির সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের চূড়ান্ত রূপ। তারপরের ইতিহাস তো বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস। সেই ইতিহাস রক্তাক্ত, কিন্তু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সাফল্যের ইতিহাস। এই প্রথম বাঙালি তার হাজার বছরের ইতিহাসে প্রজাতন্ত্রের মালিক হলো। আর এই প্রজাতন্ত্র অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সকল মানুষের সম-অধিকারের বাংলাদেশ। এই প্রথম শাসকের নয়, ব্রাত্যজনের ভাষায় রাষ্ট্র পরিচালনার সিদ্ধান্তে হলো। বাংলা ভাষায় সংবিধান রচিত হলো। সেই ১৯০৫-১৯০৬ বঙ্গভঙ্গ রদ ও স্বদেশি আন্দোলনের সময় আমরা প্রথম আমাদের প্রাণের উচ্চারণ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শুনতে পাই। অসাম্প্রদায়িকতার এক অবিনাশী উচ্চারণ। সেই ১৯০৫-এ রচিত সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা...’ স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত আর ‘জয় বাংলা’ আমাদের জাতীয় স্লোগান। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ যখন সকল বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে আধুনিক মানবিক রাষ্ট্র নামানো সচেষ্ট, তখন মানবতার শত্রু পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি নতুন কৌশলে নবীন এ রাষ্ট্রের সকল অর্জন ধ্বংসের নিমিত্তে নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে বাংলাদেশকে পুনরায় একাত্তরের মতো রক্তাক্ত করতে চাইছে। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সমগ্র দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমে সচেষ্ট। সংস্কৃতির বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমকে ইসলাম পরিপন্থী আখ্যা দিয়ে বাঙালির আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রার পথ রুদ্ধ করতে উদ্যত। মানব-ইতিহাসের সমান বয়সী ‘ভাস্কর্যশিল্প’কে মূর্তি আখ্যা দিয়ে তা ধ্বংসে লিপ্ত। আবহমান বাংলার নববর্ষ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠান ও মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইসলামবিরোধী চিহ্নিত করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। অন্য ধর্মের মানুষের মনে ভীতি ঢুকিয়ে সমাজকে বিভক্ত করতে চাইছে। সমগ্র দেশে মধ্যযুগীয় আবহ তৈরিতে তারা বদ্ধপরিকর। কিন্তু আমরা তা হতে দিতে পারি না। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করেছি। জীবন দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করব। আর এ লড়াইয়ে নতুন প্রজন্মের মানুষ নেতৃত্ব দেবে।

তাই এই বাংলা ১৪২৪ বঙ্গাব্দ বরণ প্রাক্কালে বলি—

হে নবীন, হে নতুন প্রজন্মের মানুষ, মন থেকে এ গৌরব কখনো মুছে ফেলো না যে তোমাদের এক সমৃদ্ধ অতীত আছে। এক বর্ণাঢ্য ইতিহাস-ঐতিহ্য রয়েছে। সকল ধর্ম-বর্ণ-জাতিনির্বিশেষে বিশ্বমানব হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। তোমাদের লালন, রবীন্দ্র, নজরুল আছে। তোমরা নূরলদীন আর সূর্যসেন-প্রীতিলতার উত্তরাধিকার। তোমরাই মাওলানা ভাসানী, মণি সিং ও বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার। তোমাদের হাতেই তো সকল শক্তি ন্যস্ত করেছে মহাকাল। জ্বলে ওঠো। ছিন্নভিন্ন করো বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী মৌলবাদের হিংস্র থাবা।

নতুন বছর ১৪২৪ বরণকালে লাখো কণ্ঠে নিনাদিত হোক বাঙালির চিরন্তন সাম্যের বাণী—‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’।

নাসির উদ্দীন ইউসুফ: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব