ধনী বিশ্বে জন্মহার কেন কমছে?

দক্ষিণ কোরিয়ায় শিশু জন্মহার বিশ্বে সবচেয়ে কমছবি: রয়টার্স

‘ব্যাপারটা মজার হলেও হতাশার। কেননা আমরা নিজেরাই আমাদের বিলুপ্তির পথ করছি।’ বিবিসির প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের উত্তরে দক্ষিণ কোরিয়ার ৩০ বছর বয়সী অবিবাহিত এক নারী এই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। গত সপ্তাহে জনসংখ্যা নিয়ে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ায় ফার্টিলিটি রেট (সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা) সর্বনিম্ন রেকর্ড স্পর্শ করেছে।

বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ায় নারীরা গড়ে মাত্র শূন্য দশমিক ৭২টি শিশু জন্ম দেয়। অথচ একটি দেশের জনসংখ্যা স্থিতিশীল হতে হলে নারীপ্রতি সন্তান জন্মদানের সংখ্যা গড়ে ২–এর কিছুটা ওপরে হতে হয়। 

২০ বছর ধরে নারীরা যাতে বেশি করে সন্তান নেন, সেই চেষ্টা করে আসছে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার। এ জন্য তারা ২২৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রণোদনা দিয়েছে। বিবিসির প্রতিবেদনে মূল মনোযোগ ছিল, ক্যারিয়ার অথবা পরিবার—এ দুয়ের মধ্যে কোনটা বেছে নিচ্ছেন দক্ষিণ কোরিয়ার নারীরা। এ ছাড়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার বিপুল খরচ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক জীবন যে দুর্দশা ডেকে আনছে, প্রতিবেদনে তার ওপরও দৃষ্টি দেওয়া হয়।

যা–ই হোক, ২ হাজার ৫০০ শব্দের প্রতিবেদনটিতে কোথাও একবারের জন্য ‘অসমতা’, ‘দারিদ্র্য’ অথবা ‘অতিদারিদ্র্য’—শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়নি। এমন হতে পারে, ইউরোপের বড় দেশগুলোর (আয়ের ভিত্তিতে) চরম অসমতা প্রকাশ হয়, এমন কোনো শব্দ গণমাধ্যম ব্যবহার করতে আগ্রহী নয়। অথবা এটা এমন মনে করা হতে পারে, লাখ লাখ মানুষের কাছে সন্তান না নেওয়ার ব্যাপারটি যেন শুধু তাদের পছন্দ–অপছন্দের বিষয়।

ধনী দেশগুলোর এ বিষয়টা জানা উচিত যে আমাদের সংখ্যা কমে আসছে। মূল উদ্বেগের কারণ হলো, জলবায়ু বিপর্যয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা সাম্প্রতিক কালে যেসব বিষয় আমাদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি তৈরি করেছে, তার কোনো কারণে এটা ঘটছে না। এর কারণ হলো জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপের দেশগুলোতে কয়েক দশক ধরে শিশু জন্ম কমতে শুরু করেছে। 

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইকোনমিক কো–অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) নিয়মিতভাবে বৈশ্বিক অসমতার পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। সংস্থাটির সর্বশেষ জরিপ বলছে, দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের সবচেয়ে বৈষম্যমূলক দেশগুলোর মধ্যে ১১তম। একটি দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সেই দেশটির শিশু জন্মদানের সংখ্যার মধ্যে সরল সম্পর্ক বের করা কঠিন।

দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে ইসরায়েলে অসমতা বেশি, কিন্তু সেখানে সন্তান জন্মদানের হার ২ দশমিক ৯। যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও প্রকট। অষ্টম স্থান অধিকারী যুক্তরাজ্যে সন্তান জন্মদানের হার ১ দশমিক ৬। সচ্ছল বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র বৈষম্যের দিক থেকে পঞ্চম। দেশটিতে সন্তান জন্মদানের হার ১ দশমিক ৭।

তাহলে কেন দক্ষিণ কোরিয়ায় সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা হার এত কম? ইকোনমিক কো–অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রতিবেদনের প্রতি ইঙ্গিত করে আল–জাজিরা বলছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় নারী ও পুরুষের মধ্যে মজুরির বৈষম্য সবচেয়ে বাজে। রয়টার্স বলতে চাইছে, ২০২২ সালে জাপানে সন্তান জন্মদানের হার সর্বনিম্ন ১ দশমিক ২৬ গিয়ে পৌঁছে। চীনের অবস্থা আরও খারাপ। দেশটিতে জন্মহার ১ দশমিক শূন্য ৯।

জন্মহার কমে যাওয়ায় কেউ যেটা বলছে না এবং যেটা সবার বলা উচিত তা হলো, এই বিশ্বে আমরাই (ধনী দেশগুলো) একা নই। বিশ্বে এখন আমাদের সংখ্যা ৮০০ কোটি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ধরনের গল্পে বারবার করে ধনী দেশগুলোতে কী ঘটছে, সেটাই বলা হয়। যেন অন্য কোথাও মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই।

সামগ্রিকভাবে বিশ্ব শিশু জন্মহারের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠেছিল ১৯৯০ সালে। সেটা ৩৪ বছর আগে। সেই শিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে সন্তান জন্ম দিতে শুরু করলে আরও বড় একটা চূড়া স্পর্শ করার কথা। কিন্তু জাতিসংঘের পূর্বাভাস জানাচ্ছে, আমরা আর শিশু জন্মের সেই বড় চূড়া দেখতে পাব না। বরং ২০৮৬ সাল নাগাদ আমাদের সংখ্যা কমে যাবে। 

সচ্ছল বিশ্বের প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষেরা কীভাবে মনে করছেন যে এই পৃথিবীতে আমাদের সংখ্যা এখন যথেষ্ট, এটা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করার সামর্থ্য আমার নেই। কিন্তু এটা পরিষ্কারভাবে জানি যে বিশ্বের অন্যখানে যথেষ্ট সংখ্যক তরুণ–তরুণী রয়েছেন, যাঁদেরকে আমরা কেবল ‘নৌকা আটকে দিয়ে’ কিংবা ‘কুকুর লেলিয়ে দিয়ে’ ধনী দেশগুলোতে প্রবেশ করতে দিচ্ছি না এই ভেবে যে তাতে আমাদের রক্তের শুদ্ধতা নষ্ট হয়ে যাবে। অথচ এসব তরুণ–তরুণী যে দেশেরই হোক না কেন, তাঁদের সংখ্যা আমাদের সবার ভবিষ্যতের জন্য যথেষ্ট।

ধনী দেশগুলোর এ বিষয়টা জানা উচিত যে আমাদের সংখ্যা কমে আসছে। মূল উদ্বেগের কারণ হলো, জলবায়ু বিপর্যয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা সাম্প্রতিক কালে যেসব বিষয় আমাদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি তৈরি করেছে, তার কোনো কারণে এটা ঘটছে না। এর কারণ হলো জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপের দেশগুলোতে কয়েক দশক ধরে শিশু জন্ম কমতে শুরু করেছে। 

ড্যানি ডরলিং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান জিওগ্রাফির অধ্যাপক

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে অনূদিত