ফাঁদে পড়া পুতিনকে উদ্ধারে পশ্চিমা বন্ধুরা কতটা এগিয়ে আসবে

একটি অন্তহীন সময় ধরে সামরিক অভিযানে আটকে পড়াটা পুতিনকে সামর্থ্যহীন করে তুলবে কি?
ছবি: রয়টার্স

ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে মূলত নিজের জন্য এক বিপর্যয়জনক ফাঁদ তৈরি করেছেন। এখন সেই ফাঁদ থেকে মুক্তি পেতে তাঁকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনে তাঁর বিশেষ সামরিক অভিযান নিয়ে নির্বিকারই ছিলেন। কিন্তু সেখানে অনির্দিষ্টকালের অচলাবস্থা তিনি প্রত্যাশা করেননি। তিনি আশাই করেননি, মস্কোতে গাড়িবোমা হামলা হবে এবং তাঁর অন্যতম দুর্গ ক্রিমিয়া অপমানজনকভাবে আক্রমণের শিকার হবে।

মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করে, এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত অন্তত ৮০ হাজার রুশ সৈন্য হতাহত হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হচ্ছে পুতিনের ‘মহান রাশিয়া’ গঠনের প্রচেষ্টাও, যে স্বপ্ন দেখেছিলেন পিটার দ্য গ্রেট। তাঁর সুনাম ক্ষয় হতে এখন একজন হত্যাকারী বা অপরাধী পর্যায়ে নেমে গেছে। একটি অন্তহীন সময় ধরে সামরিক অভিযানে আটকে পড়াটা পুতিনকে সামর্থ্যহীন করে তুলবে, যেহেতু ক্রমবর্ধমান পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা তাঁর অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিচ্ছে এবং তার সামরিক বাহিনী ও সরঞ্জাম ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। তাহলে তাঁর এখন উপায় কী?

তিনি চাইলে আচমকা বিজয় ঘোষণা করতে পারেন। দাবি করতে পারেন যে ন্যাটোর যে হুমকি ছিল, সেটি রুখে দেওয়া গেছে এবং রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চলগুলো স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে একটি মীমাংসায় আসার প্রস্তাব দিতে পারেন। কিন্তু তিনি অবশ্যই জানেন যে কিয়েভ স্বেচ্ছায় তাঁর এ প্রস্তাব নিতে রাজি হবে না। তিনি তখন যুদ্ধক্ষেত্রটা আরও বড় করার জুয়া খেলতে পারেন। যেমন বেলারুশকে দিয়ে কিয়েভের উত্তর দিকে দ্বিতীয় যুদ্ধক্ষেত্র খুলতে পারেন, ফেব্রুয়ারিতে যে অঞ্চল দখলে নিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। তবে এতে তাঁর জেনারেলরা ইচ্ছুক কি না, সেটির ওপর নির্ভর করবে।

আরও পড়ুন

পুতিন অবশ্যই পিছু হটার পাত্র নন। কিন্তু কোনো সমাধানে আসতে তাঁর ওপর বাড়তে থাকা চাপ মোকাবিলায় তিনি তখন তাঁর সর্বোত্তম উপায় হিসেবে ইউক্রেনের ওপর আরও ব্যাপকভাবে হামলা চালিয়ে যাবেন, যার মাধ্যমে কিয়েভের প্রতিরোধকে দুর্বল করে দেওয়া সম্ভব হবে। তিনি ইতিমধ্যে সেটি শুরু করেছেনও। ব্রিটিশ, ফরাসি ও জার্মানির নেতারা গত সপ্তাহে ঘোষণা দিয়েছেন, ইউক্রেনে দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতা চালিয়ে যাবেন তাঁরা। তাঁরা জানেন, পুতিন মূলত তাঁদের মাথা নত করাতে বাজি ধরেছেন। এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপে জ্বালানি ও জীবনযাত্রার সংকট নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকবে। বিশেষ করে যখন রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। তখন শীতকালটি সত্যিকার অর্থে এমন শীতলযুদ্ধ নিয়ে আসতে পারে, যা ইউরোপকে রীতিমতো পঙ্গু করে দিতে পারে।

যদিও পুতিন সবে খেলা দেখানো শুরু করেছেন। পশ্চিমা শক্তির ঐক্যে চিড় ধরাতে এবং ক্ষমতায় থাকতে তাঁর কাছে অনেক উপায় আছে। সোভিয়েত আমল থেকেই ইউরোপে সম্ভাব্য নানা ভূরাজনৈতিক ফাটল বিরাজমান। যার কারণে রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ইউরোপের মানচিত্রজুড়ে রাশিয়ার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মিত্র ও সমব্যথী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এখন পুতিনের পশ্চিমা বন্ধুরা কীভাবে তাঁকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন? বেলারুশের আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কো ইতিমধ্যে পুতিনের পকেটেই আছেন। ২০২০ সালে নির্বাচন ‘চুরি’ করার পর দেশব্যাপী জোরালো বিক্ষোভের পরও এই স্বৈরশাসককে ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা দিয়েছে মস্কো। লুকাশেঙ্কো তা-ই করেন, পুতিন যা বলেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতরে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর অরবানকে দেখা হয় পুতিনের ‘ট্রোজান হর্স’ হিসেবে। ইউরোপের অতি ডানপন্থী অনেক নেতার মতো ওরবানও পুতিনের অসহিষ্ণু জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রশংসা করেন এবং তাঁর সমকামীবিরোধী ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করেন। ওরবান রাশিয়ার ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞায় বারবার বাধা দিয়েছেন। তবে গত মাসে তিনি ক্রেমলিনের সঙ্গে একতরফা গ্যাস চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ফলে ওরবানকে স্পষ্টভাবে বিশ্বাস করা যায় না।

জুন মাসে বুলগেরিয়ার সংস্কারপন্থী সরকারের পতন এবং পরবর্তীকালে দেশটির মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের আলোচনার ফলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। যার মাধ্যমে মূলত পুতিন ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বিভক্ত করার সুযোগ পাচ্ছেন। ইতালিতেও পুতিনের প্রচুর সমর্থক আছেন। সেখানকার অতি ডানপন্থী দুটি দলের নেতারা ক্ষমতাসীন জোটে যোগ দিতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে দিয়ে অনেক বছর পর দেশটির সরকার ও মস্কোর মধ্যে আবার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। ইতালিতে এসব নেতার মধ্যে একজন মাত্তিও সালভিনি, যার দল নর্দান লিগ ২০১৭ সালে পুতিনের দল ইউনাইটেড রাশিয়ার সঙ্গে একটি জোট গঠন করেছিল। আরেকজন সিলভিও বেরলুসকোনি হচ্ছেন পুতিনের ব্যক্তিগত বন্ধু, ফোরজা ইতালিয়া দলের এই নেতা দেশটির কয়েক দফা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ও মিডিয়া টাইকুন।

ইইউ এবং যুক্তরাজ্য আশঙ্কা করছে যে অস্থির পশ্চিম বলকানের পুরোনো দ্বন্দ্বগুলোকে পুতিন উসকে দিতে পারেন এবং সেগুলোকে ইউক্রেন থেকে মনোযোগ সরানোর জন্য ব্যবহার করতে পারেন। কসোভোতে আবারও সার্ব জাতিগত আন্দোলন তৈরি হচ্ছে। বুচিচ গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষীদের হস্তক্ষেপের জন্য আহ্বানও করেছে। তিনি বলেন, যদি ন্যাটো এটা করতে না চায়, আমরা আমাদের জনগণকে নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষা করব।

ইউরোপীয় অন্যান্য অতি দক্ষিণ বা বামপন্থী সশস্ত্রবাদী বা জনতুষ্টিবাদী দলগুলোও বিভিন্ন মাত্রায় পুতিনের আদর্শ ও রক্ষণশীল সামাজিক মূল্যবোধকে সমর্থন করে থাকে। তাদের সঙ্গে আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস ২০১৬ সালে তাদের এক সমীক্ষায় দেখিয়েছে, জার্মানির অলটারনেটিভ ফর জার্মানি, ফ্রান্সের ফ্রন্ট ন্যাশনাল (বর্তমানে ন্যাশনাল র‌্যালি), অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টি এবং বেলজিয়ামের ভালামস বেলাং হচ্ছে রুশপন্থী দল। সেই সমীক্ষায় বলা হয়, এসব দল ক্রেমলিনের নীতির বৈধতা দেয় এবং রাশিয়ার অপপ্রচারকে ছড়িয়ে দেয়। একটা সময় গিয়ে তারা ইউরোপের অভ্যন্তরীণ বিতর্কগুলো রাশিয়ার পক্ষে নিয়ে যেতে পারে। এখন পুতিনের জন্য প্রভাব বিস্তার করার জন্য এসব চ্যানেল গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার বুচিচের ওপরও পুতিন চাইলে নির্ভর করতে পারেন। কারণ, বুচিচ তাঁর প্রতি যথেষ্ট সহমর্মী। বুচিচকে তাঁর প্রতিপক্ষরা ‘ছোট পুতিন’ হিসেবেও আখ্যা দিয়ে থাকে। রাশিয়ার সঙ্গে সার্বিয়ার গভীর ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে এবং স্লাভিক জাতিগত ও ধর্মীয় সম্পর্কও। পাশাপাশি ন্যাটোর ওপর সার্বিয়ারও একটি অবিশ্বাস কাজ করে। কারণ, ১৯৯৯ সালে বেলগ্রেডে ন্যাটোর বোমা হামলাটি দেশটির পক্ষে কখনো ভোলার নয়।

ইইউ এবং যুক্তরাজ্য আশঙ্কা করছে যে অস্থির পশ্চিম বলকানের পুরোনো দ্বন্দ্বগুলোকে পুতিন উসকে দিতে পারেন এবং সেগুলোকে ইউক্রেন থেকে মনোযোগ সরানোর জন্য ব্যবহার করতে পারেন। কসোভোতে আবারও সার্ব জাতিগত আন্দোলন তৈরি হচ্ছে। বুচিচ গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষীদের হস্তক্ষেপের জন্য আহ্বানও করেছে। তিনি বলেন, যদি ন্যাটো এটা করতে না চায়, আমরা আমাদের জনগণকে নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষা করব। মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বসনিয়ার সার্ব নেতারা বসনিয়া-হার্জেগোভিনাতে নতুন ভাঙনের হুমকিও দিয়েছেন। এমনকি পুতিনপন্থী বসনিয়ান সার্বদের কোনো কোনো গোষ্ঠী ইউক্রেনে পুতিনের অভিযান চালানোতে উল্লাসও করে।

মলদোভা ও জর্জিয়ায় রুশ জাতিগোষ্ঠীর অবস্থানের কারণে সেখানকার মানুষের মধ্যে বিভক্তি রয়েছে। একইভাবে সেসব দেশের মাটিতে রাশিয়ার সেনার উপস্থিতিও আছে। আর ন্যাটো প্রতিবেশী পোল্যান্ড ও লিথুয়ানিয়ার মাঝখানে রুশ প্রদেশ কালিনিগ্রাদে তো পুতিন গত মাসে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করেছেন। অন্যদিকে এস্তোনিয়ায় রুশরা জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে সেখানে লক্ষ্যবস্তুর শিকার হতে পারে। সব মিলিয়ে এসব দেশেও উত্তেজনা তৈরি হওয়ার সুযোগ আছে।

আরও পড়ুন

ভাঙন, ভীতি, অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক পীড়া তৈরি করতে পুতিনের সুযোগ থাকার কারণে দেশগুলো রাশিয়ার বিরোধিতা করার বিষয়ে দুবার ভাবতে বাধ্য হবে। বিষয়টি ইউরোপের বাইরেও বিস্তৃত। কারণ, অনেক সময় রাশিয়ার ভেটোর কারণে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও স্থবিরতা তৈরি হয়। এখন পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বালিতে আগামী নভেম্বরে মহামারি-পরবর্তী জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনকে ইউক্রেন ইস্যুর পক্ষে বনাম বিপক্ষের শোডাউন হিসেবে তৈরি করতে চান।
তবে পুতিনের বেপরোয়াভাবে ইউক্রেনের জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দখল করার মধ্য দিয়ে এটিই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি জয়ের জন্য যেকোনো ঝুঁকি নিতে রাজি আছেন। তিনি দিন দিন আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠছেন।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ রাফসান গালিব

  • সিমন টিসডাল দ্য গার্ডিয়ান-এর সহকারী সম্পাদক এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে কলামলেখক