আমরা কি ইতিহাসের আরেকটা ক্রান্তিলগ্ন পার করছি

যুদ্ধবিরতির পর গাজায় ফিরছেন ফিলিস্তিনিরাছবি: রয়টার্স

আজকের পূর্ব ইউরোপ থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত যুদ্ধের আগুন জ্বলছে। আমাদের সমাজে বিভাজন ক্রমেই গভীর হচ্ছে। আর এ সময় ‘সংকট মুহূর্ত’ নামের ধারণা নিয়ে আলোচনা বিশ্ব রাজনৈতিক অঙ্গনে বারবার উঠে আসছে। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েনসহ বিশ্বনেতারা এই ধারণাকে ব্যবহার করছেন দুনিয়াজোড়া বর্তমান দ্বন্দমুখর পরিস্থিতির গুরুত্ব তুলে ধরতে।

স্বৈরাচারী শক্তির উত্থান, গণতন্ত্রবিরোধী প্রবণতা, ইউক্রেন, গাজা ও তাইওয়ানের ভূখণ্ডগত সংঘাত, জলবায়ু সংকট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নতুন অনিশ্চিত শিল্পবিপ্লব—এসব মিলিয়ে বর্তমান বিশ্ব এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে এসে হাজির হয়েছে।

এই সংকট মুহূর্ত বা মোড় পরিবর্তন বলতে কী বোঝানো হয়? এর মানে ইতিহাসের এমন গুরুত্বপূর্ণ সময় বা ঘটনা যা আমাদের জীবনকে গভীরভাবে পরিবর্তন করে দেয়। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, মুহূর্তগুলো একবার পার হয়ে গেলে মানুষের পৃথিবীর আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক নেতারা বরাবরই নিজেদের স্বার্থে জনগণকে এক করতে বা ইতিহাসে নিজেদের সময়কালকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরতে এ ধরনের মোড় পরিবর্তনের গুরুত্বকে সামনে নিয়ে আসেন।

সংকট মুহূর্তগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া প্রয়োজন। তবে শুধু মুহূর্ত বা ঘটনাগুলোর ওপর অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া উচিত নয়। কারণ, মোড় পরিবর্তনের দৃশ্যমান ঘটনাগুলোর পেছনে লুকিয়ে থাকে গভীর কাঠামোগত পরিবর্তন। সেগুলো অনুধাবন করতে পারলে ঘটনার প্রকৃত কারণ বোঝা যাবে না।

ইতিহাসবিদ ফের্নাঁ ব্রদেল বলেছেন, সংকট মুহূর্তগুলো ইতিহাসের প্রবহমান জোয়ারের পিঠে ভেসে থাকা ফেনার মতো। কিন্তু প্রকৃত পরিবর্তনগুলো যুগের পর যুগ ধরে ধীরে ধীরে ঘটে। নির্দিষ্ট কিছু ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই, মোড় পরিবর্তনের ঘটনা নয়, বরং সেগুলোর পেছনের দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন ও গতিবিধি বোঝাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

ইতিহাসবিদেরা দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া ঘটনাগুলোর ওপর বেশি মনোযোগ দিয়ে আসছেন। এসব ঘটনা মানে যুদ্ধ, সংকট, বিপ্লব, কূটনৈতিক চুক্তি এবং ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ড। এই মনোভাব সমালোচনার মুখেও পড়েছে। এর অন্যতম সমালোচক ছিলেন কার্ল মার্ক্স।

মার্ক্স ১৮৫২ সালে লেখা ‘দ্য এইটিন্থ ব্রুমেয়ার অব লুই বোনাপার্ট’ লেখায় বলেছেন, ‘মানুষ নিজেদের ইতিহাস নিজেরাই তৈরি করে। কিন্তু তারা তা নিজেদের ইচ্ছেমতো তৈরি করতে পারে না। তারা তা এমন পরিস্থিতিতে তৈরি করে না, যা তারা নিজেরাই বেছে নিয়েছে। বরং তারা তা তৈরি করে এমন পরিস্থিতিতে, যা অতীত থেকে পাওয়া, গড়ে ওঠা এবং স্থানান্তরিত হওয়া অবস্থা দিয়ে নির্ধারিত।’

রাজনৈতিক ঘটনা ও সামরিক পরাজয়কে আসলে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এগুলোর তাৎপর্য তার চেয়ে কম। ইতিহাসে আকস্মিক পরিবর্তন প্রায় অসম্ভব। মার্ক্স সতর্ক করেছিলেন যে কেবল দৃশ্যমান ঘটনাগুলোর ওপর মনোযোগ দিলে সেগুলোর অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো আড়ালে থেকে যায়; যদিও সেগুলো আসলেই এসব পরিবর্তনের জন্য দায়ী।

আসলেও, অনেক মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনাকে একসময় তাৎপর্যপূর্ণ মনে হলেও, পরে দেখা গেছে যে এগুলো ছিল কেবল গভীর কাঠামোগত রূপান্তরের বহিঃপ্রকাশ। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমরা এর অন্তর্নিহিত বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তনগুলোর দিকে নজর না দিই, তাহলে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবকে বোঝা অসম্ভব।

একইভাবে ১৯৮৯ সালের পরিবর্তনটিও হঠাৎ আসেনি। এর মূল কারণ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক স্থবিরতা, পূর্ব ইউরোপের নেতৃত্বে প্রজন্মগত পরিবর্তন এবং দুনিয়াজোড়া আদর্শিক পরিবর্তন।

৯/১১-কে বোঝার জন্য আমাদের অবশ্যই জাতীয়তাবাদ, ইসলামবাদ এবং গ্লোবাল সাউথের (বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চলের) পশ্চিমবিরোধী মনোভাবের দীর্ঘ ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এভাবেই, প্রতিটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনার পেছনে থাকা কাঠামোগত বাস্তবতাগুলো বোঝা প্রয়োজন।

তবে কাঠামোগত বিশ্লেষণের ওপর অতিরিক্ত জোর দেওয়া নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন যে যদি ইতিহাসকে শুধু কাঠামোগত নিয়মের বন্দী হিসেবে দেখা হয়, তাহলে ব্যক্তির ভূমিকা বা মানবীয় সিদ্ধান্তের জন্য খুব বেশি জায়গা থাকে না। তা ছাড়া ইতিহাসে নায়ক-খলনায়ক এবং নাটকীয় ঘটনাবহুল কাহিনি পড়তে বেশি উপভোগ্য। সেই তুলনায় কাঠামোগত বিশ্লেষণ নিতান্ত নিরস।

তাই দেখবেন ইতিহাস নিয়ে বই লেখা হলেও, সেগুলো আবর্তিত হয় ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা নিয়ে। যেমন রুশ বিপ্লব মানে ১৯১৭। ফরাসি বিপ্লব মানে ১৭৮৯। তবে যা প্রয়োজন তা হলো, মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করতে সেগুলোর গভীরতর কারণগুলোও বিবেচনায় নেওয়া।

যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনকারী বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে হলে বুঝতে হবে, ব্রিটেনের নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত, হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ এবং জাপানের পার্ল হারবারে হামলা। বুঝতে হবে যুদ্ধে জড়িত নেতারা কী ধরনের কাঠামোগত বাস্তবতার ভেতরে থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে ঘটনা ও কাঠামো একে অপরের বিপরীত নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুটোরই গুরুত্ব স্বীকার করা উচিত। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোই ঘটনাগুলোকে রূপ দেয়। কিন্তু রাজনৈতিক বিপ্লব বা বড় ধরনের যুদ্ধের মতো কিছু নির্দিষ্ট মুহূর্তে এসব ঘটনাই কাঠামোয় গভীর পরিবর্তন আনতে পারে। যখন কোনো ঘটনা কাঠামোগত তাৎপর্য অর্জন করে, তখন সেটিই একটি ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনকারী মুহূর্তে পরিণত হয়।

আজ আমরা এক বৈশ্বিক সংকটের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তবে একে পুরোপুরি বুঝতে এবং সমাধান করতে হলে, এর গভীরতর কাঠামোগত কারণগুলো এড়িয়ে গেলে চলবে না। এই সব ঘটনার শিকড় ঠান্ডা যুদ্ধের সমাপ্তির আরও আগে গিয়ে খুঁজতে হবে। এই শিকড় অনুসন্ধানের মধ্যে পড়বে জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থান, বদলে যাওয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং প্রতিশোধস্পৃহা, বৈষম্য সৃষ্টি করা অসংযত উদারপন্থী বাজারব্যবস্থা ও শোষণ এবং নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ক্ষয়। এসব কারণই সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে এবং সমাজকে বিভক্ত করছে।

আমরা এক মোড় পরিবর্তনকারী মুহূর্তের সম্মুখীন, কেবল এটুকু বোঝাই যথেষ্ট নয়। একে অতিক্রম করতে হলে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে কাঠামোগত সমস্যাগুলো। আর এর কোনো শর্টকাট নেই। এ এক দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। নাটকীয়ভাবে তার সমাধান হয় না। কারণ, ইতিহাস গড়ে ওঠে দীর্ঘ সময় নিয়ে।

  • ডেভিড মোটাডেল লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের আন্তর্জাতিক ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া ইংরেজির সংক্ষেপিত অনুবাদ জাভেদ হুসেন