সম্পর্কের ৫০ বছর: মুক্তিযুদ্ধে, উন্নয়নে, সহযোগিতায় জার্মানি

বাংলাদেশ জার্মানির সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও জার্মানির পররাষ্ট্রসচিব টুবিয়াস লিন্ডনার

হলভর্তি মানুষ। রাজধানী বার্লিনের একটি বনেদি হোটেলে বাংলাদেশ-জার্মানির সম্পর্কের অর্ধশতাব্দী পূর্তি অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে। জার্মানির বিভিন্ন শহর থেকে এসেছেন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়কার সহমর্মী, সাবেক ও বর্তমান কূটনীতিকেরা ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতেরা। অতিথিরা বাংলাদেশের উন্নয়ন, সাম্প্রতিক রাজনীতি, মানবাধিকার, পরিবেশ বা বাণিজ্য—নানা বিষয়ে কথা বলছেন।

স্বাধীনতার পরপরই বাঙালি জাতিসত্তার নবীন রাষ্ট্রটির জন্য যখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতির প্রয়োজন হয়েছিল, তখন সাবেক পূর্ব জার্মানি ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ ইউরোপের প্রথম আর বিশ্বের তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আর সাবেক পশ্চিম জার্মানি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় প্রায় তিন সপ্তাহ পর ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২। সেই থেকেই সম্পর্কের শুরু। অবশ্য এর পরপরই ইউরোপের অন্যান্য দেশসমূহ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করে।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাসংগ্রাম চলাকালে পশ্চিম জার্মানি তাদের মার্কিন লেজুড়বৃত্তিভিত্তিক রাজনীতির কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো ভূমিকা না রাখলেও পূর্ব জার্মানি নানাভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছিল। অবশ্য ওই সময় উভয় দেশের পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানের বর্বর নির্যাতন ও ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এ ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিমের কিছু রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, কিছু প্রবাসী বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে কাজ করেছিলেন।

এঁদের মধ্য অন্যতম ছিলেন তৎকালীন পূর্বে অবস্থিত, হ্যালে-ভিটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্য প্রত্নতত্ত্ব, রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ ও ভারতবিদ অধ্যাপক হেইঞ্জ অ্যাডলফ মোডে। যুদ্ধকালে তিনি হ্যালে-ভিটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে das Haus am Padma বা ‘পদ্মা পাড়ের বাড়ি’ নামে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন এই ছাত্র, নামকরণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহের বাড়ির কথা স্মৃতিচারণা করেছিলেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপর ৭০ এবং ৮০-এর দশকে এই সম্পর্ক ছিল কেবলই দাতা ও গ্রহীতার। তখন অনেক ক্ষেত্রেই জার্মানি বা ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় ২০ বছর পর, ১৯৯০ সাল থেকে এই সম্পর্কের মাত্রা ভিন্ন রূপ নিয়েছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে জার্মানি বর্তমানে বাংলাদেশের দ্বিতীয় অংশীদার দেশে পরিণত হয়েছে।

পূর্ব জার্মানিতে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালিদের আরেক সুহৃদ ছিলেন ঝালকাঠির সুনীল দাশগুপ্ত ও তাঁর জার্মান স্ত্রী বারবারা দাশগুপ্ত। বার্লিনের উলান্ড স্ট্রাসের হিন্দুস্তান হাউসের প্রেক্ষাপটে লেখা হয় সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত ‘চাচা কাহিনি’ গল্পটি।

এই বইয়ের চাচা নলিনী গুপ্ত ছিলেন সুনীল দাশগুপ্তের আপন চাচা। একাত্তরের জুন মাসে নিজের কর্মস্থল ইলেকট্রিক কোম্পানিতে জার্মান ও অন্যান্য বিদেশি অতিথিদের সহযোগিতায় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে মুক্তিযুদ্ধ ও শরণার্থীশিবিরের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন। ১৯৭১ সালে পশ্চিম জার্মানিতে স্বল্পসংখ্যক বাংলাদেশির বাস ছিল। পশ্চিম জার্মানিপ্রবাসী বাঙালিরা সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে তহবিল গড়ে তুলেছিলেন। তাঁরা মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের সপক্ষে কাজ করতেন। সেই সময়গুলোতে এই সব কাজের পুরোধা ছিলেন মাইনটালে বসবাসরত অনীল দাশগুপ্ত।

১৯৭২ সালে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানিতে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত ছিলেন মুক্তাকিম চৌধুরী এবং হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী। আর বাংলাদেশে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির রাষ্ট্রদূত ছিলেন লোথার ভেনজেল ও এডভিন ইউংফ্লাইস। ১৯৭২ সালে পূর্ব জার্মানির সহযোগিতাই মুনীর বাংলা টাইপ করার মেশিন, বাংলাদেশের পাসপোর্ট তৈরি হয়েছিল। সেই সময় বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল মেজর আমিন আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে চিকিৎসার জন্য পূর্ব বার্লিনে এসেছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তি দিয়ে দেশটির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপর ৭০ এবং ৮০-এর দশকে এই সম্পর্ক ছিল কেবলই দাতা ও গ্রহীতার। তখন অনেক ক্ষেত্রেই জার্মানি বা ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় ২০ বছর পর, ১৯৯০ সাল থেকে এই সম্পর্কের মাত্রা ভিন্ন রূপ নিয়েছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে জার্মানি বর্তমানে বাংলাদেশের দ্বিতীয় অংশীদার দেশে পরিণত হয়েছে।

জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘জার্মানি ও বাংলাদেশ: দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক’ বিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলেছে, জার্মানি ছিল প্রথম ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম, যারা ১৯৭২ সালে পাকিস্তান থেকে বের হয়ে যাওয়া সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কূটনৈতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। আর সেই দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার এখন জার্মানি। এ ছাড়া বাংলাদেশের উন্নয়নে জার্মানি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য দাতাদেশ হিসেবে বিবেচিত। জার্মানি বাংলাদেশের জন্য অন্যতম বৃহৎ রপ্তানি বাজার এবং দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। জার্মান উন্নয়ন সহযোগিতার বিষয়ে তারা জলবায়ু এবং বিকল্প জ্বালানি, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, সুশাসন বা টেক্সটাইলশিল্পে উপযুক্ত কাজের পরিস্থিতি এবং পরিবেশগত মানের চর্চা ইত্যাদি বিষয়ে কাজ করছেন বলে জানিয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের সমর্থনে মানবিক সহায়তাও দিচ্ছে জার্মানি। জার্মানির অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমেই উন্নতির দিকে। করোনা মহামারি সত্ত্বেও দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। জার্মানি ও বাংলাদেশের মধ্যে একাডেমিক আদান-প্রদান ছাড়াও প্রতিবছর ছাত্র এবং তরুণ বিজ্ঞানীদের জন্য অসংখ্য বৃত্তি প্রদান করছে। জার্মানিতে ক্রমেই বাংলাদেশের তরুণ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের দ্বার খুলে যাচ্ছে। জার্মানির কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এই মুহূর্তে প্রায় ৩৫ হাজার বাংলাদেশি জার্মানিতে বসবাস করছেন।

বাংলাদেশ জার্মানির সম্পর্কের ৫০ বছর অনুষ্ঠানে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া উদ্বোধনী বক্তব্যে অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশ-জার্মানির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও সহযোগিতার কথা বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আগত জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব টুবিয়াস লিন্ডনার বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসাসহ বংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা, মানবাধিকার ও সুশাসন ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, দ্রুত উন্নয়নশীল অঞ্চলে বাংলাদেশ এখন জার্মানির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অংশীদার।

জার্মানিতে বসবাসের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কয়েক বছর আগে পর্যন্তও বাংলাদেশবিষয়ক যেকোনো সংবাদে জার্মানির মিডিয়া তা টেলিভিশন হোক বা প্রিন্ট মিডিয়া হোক, বাংলাদেশকে নিয়ে যেকোনো সংবাদে নেতিবাচক কথা বলে সংবাদের শুরু করত। বলা হতো বন্যাপীড়িত ও পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ বাংলাদেশে অমুক ঘটনা ঘটেছে। আর এখন বাংলাদেশ জার্মানির সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে জার্মানির পররাষ্ট্রসচিব টুবিয়াস লিন্ডনারের বাংলাদেশকে নিয়ে প্রশংসা, কিছুটা হলেও আমাদের পুরোনো আক্ষেপের লাঘব ঘটিয়েছে।

  • সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি। ইমেইল: [email protected]